খড়কুটোর জীবন : কুমোর পাড়ার পিটনিগুলো। পর্ব ১৭। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

কুমোর পাড়া থেকে ভেসে আসা হাঁড়ি পেটানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতো। বুঝে যেতাম ভোর হয়েছে। পাখির ডাক, আজানের সুর আর রাই জাগো রাই জাগো গানের কোরাস ছড়িয়ে পড়ছে নবোদিত সূর্যালোকের সঙ্গে। সে এক অপরূপ ভোর। প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠা। ঘুমন্ত গ্রামকে জীয়ন কাঠির মতো জাগিয়ে তুলতো কুমোর পাড়ার পিটনি গুলো। দিনের বেলা চাক ঘুরিয়ে যে হাঁড়ি বা তাওয়ার মুখগুলো বানানো হয়েছে তা সারাদিন রোদ খাওয়ানোর পর ভোর রাতে তার পিছনে মাটির চাদর লাগানো হলে আবার সকালে রোদে দেওয়া হবে। শুকিয়ে গেলে ধারালো শামুকে সেগুলোর বারতি অংশ কেটে নেওয়া হবে। একদম শুকিয়ে গেলে হাঁড়ি বা তাওয়ার উপরের দিকে পড়বে বর্ণক মাটির পোচ। তারপর কয়েকদিন শুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে পোড়শালে ।

আমাদের গ্রামে ঢুকতেই  পাল পাড়া। কেউ কেউ বলে কুমোর পাড়া। ঘর কুড়ি কুম্ভকারের বাস। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে তাদের উঠানে পোড়ানো বা কাঁচা রোদে দেওয়া মাটির নানান  তৈজসপত্র। নাদা,মালসা,সরা, মুচি, সানকি, ভাতের হাঁড়ি, মুড়ি ভাজার খোলা হাঁড়ি,ঝাঁঝড়ি,তস্তা , প্রদীপ, ধুনুচি, গ্লাস, কলসী, জালা, কুঁয়োর বেড় বা পাট ইত্যাদি। কারোর উঠানে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটির নানান রকম পুতুল, ভাণ্ডার, খেলনাপাতির ছোট্ট কড়াই, হাঁড়ি। কেউ খড়, বাঁশ আর সুতালি জড়িয়ে বেঁধে রেখেছে বিভিন্ন দেব-দেবীর কাঠামো। সে গুলো বায়না মাফিক এক মেটে, দো মেটে, ন্যাকড়া দেওয়ার পর শুকিয়ে রঙ দেওয়া হবে। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে এঁটেল আর বালি মাটির স্তূপ।

বৈশাখ মাসে কুমোর পাড়ার সমস্ত চাক বন্ধ থাকতো। অন্য সময়ে মদন পাল, বিশ্বনাথ পাল, ন্যাড়া পাল, দয়াল পাল, হারান পাল বা নিমাই পালদের চাক ঘুরতো অবিরত। নরম কোমল মাটির তাল চাকের উপর বসিয়ে চাক লড়ি দিয়ে পাক দিয়ে চাক ঘুরিয়ে হাতের কায়দাতে তৈরি হতো হাঁড়ি, কলসী, তাওয়া, গ্লাস প্রভৃতি। সেসব এখন কালগর্ভে নিমজ্জিত। সর্বগ্রাসী সভ্যতার স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিকের নানান পাত্রের যোগান কমিয়ে দিয়েছে মাটির পাত্রের চাহিদা। মৃৎশিল্প আর মৃৎশিল্পী সমাজ আজ গভীর সঙ্কটে
। বর্তমান প্রজন্ম অস্তিত্বের লড়াইয়ে বেছে নিয়েছে অন্য পেশা। অনেকে হাজির হয়েছেন কলকাতার পটুয়া পাড়া কুমারটুলি বা কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণীতে প্রতীমা বা পুতুল তৈরির কাজে।

ছোটো বেলায় কখনো মদন দাদু বা হারাণ দাদুর চাকের সামনে উবু হয়ে বসে যেতাম। অবাক হয়ে দেখতাম নরম মাটির তালকে আঙুলের ছোঁয়ায় কেমন করে নানান পাত্রের আকার দিতেন। আজ যখন পাল পাড়ার সমস্ত চাক বন্ধ তখন মন বলে ফিরে এসো চাকা শিল্পীর আঙুলের চিরন্তন কাব্য হয়ে। সে অনুপম সৌন্দর্য দর্শনের তৃপ্তিতে অভিভূত হয়ে যেতাম। দেখতাম এসব মৃৎশিল্পীদের দিন যাপনের দুঃখ, বেদনা, সৃজনের আকাশচুম্বী আনন্দ আর অযুত সমস্যায় ভারাক্রান্ত জীবনকে। হারাণ দাদুর পরিবারে ছিলো প্রায় পনেরো জন সদস্য। তাদের ভরন-পোষণের জন্য এক মাত্র আয়ের উৎস ছিলো মাটির তৈজসপত্র বিক্রয়কৃত অর্থ। হারাণ দাদু বাঁশের ঝাঁকায় করে হাঁড়ি-কলসী নিয়ে বিক্রি করতে যেতেন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে। চাল, গম, নগদ কিছু অর্থ নিয়ে ফিরে আসতেন। প্রতি রবিবার বড়ো আন্দুলিয়া হাটে যেতেন নিজে এবং ছেলেদের মাথায় মাটির নানান পাত্র ভর্তি জিনিস নিয়ে। মাটির বোঝা টেনে নিয়ে চলতেন তারা প্রায় সাত কিলোমিটার মেঠো জল-কাদা ভর্তি পথ। কুমোর পাড়ার প্রতিটি পরিবারই এভাবে তাদের সৃষ্ট উপাদান বিপণন করতেন। বাড়ি থেকেও বিক্রয় হতো। অনেকে তাদের সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতো। বাকের সর্দার, আমির সেখ,আচের সেখ, বক্কর সেখ -এর মতো কতো মানুষ যাদের বৃত্তি ছিলো এসব মৃৎপাত্র বিক্রি। যারা পুতুল বা খেলনার হাঁড়ি, কড়াই, ভাণ্ডার ইত্যাদি বানাতো তারা সেসব নিয়ে কখনো হাটে যেতো, কখনো স্থানীয় কোনো মেলায়, কখনো বড়ো আন্দুলিয়ায় দুর্গা পূজার বিসর্জনে মেলায় বা ঈদের দিনে পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামের ঈদগাহ ময়দানে।

গ্রামে কোনো পূজা, বিবাহ বা মাঙ্গলিক ক্রিয়াকর্ম হলেই প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র আসতো কুমোর পাড়া থেকে। বিবাহের মঙ্গল ঘট, চিত্রিত পিঁড়ি, ইতু পূজার ঘট, কাঁচা ঘট পূজার ঘট যোগান দিতেন কুমোর পাড়ার মেয়েরা। কেনা হতো গরু বা মহিষের ছানি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আকারের নাদা। ধান ভাপিয়ে ভিজিয়ে রাখার জন্যও ব্যবহৃত হতো নাদা। যাদের বাড়িতে টিউবওয়েল থাকতো না তারা হাত-পা ধোওয়ার জন্য নাদায় জল ধরে রাখতো। কলসী বা ঠিলিতে ভরে রাখা হতো পানীয় জল। গ্রীষ্মে তার শীতলতা প্রাণ জুড়িয়ে দিতো। কেউ মারা গেলে যারা কাছা পরতো তারা মাটির মালসাতে দুটো আতপ চাল ফুটিয়ে খেয়ে মালসাটাকে জলে দিয়ে আসতো। গ্রামে একদিনের হরিনাম সংকীর্তনকে বলা হতো মালসা ভোগ। আসলে মালসাতে  রাধা-কৃষ্ণ আর মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করে ভোজন-আরতী করা হতো। নাম সংকীর্তন বা নাম যজ্ঞে আজো মাটির মালসাতেই ভোগ নিবেদন করা হয়।

কলকাতার গল্প শুনতাম কুমারটুলিতে ঠাকুর গড়ার কাজে যাওয়া মহাদেব পাল, সুদের পাল, ভক্ত পাল, প্রভাত পাল, রাজু পাল-এর মতো মৃৎশিল্পীদের কাছে। আবাক হয়ে যেতাম তিলোত্তমার রূপের বর্ণায়।আর শুনতাম তাদের কর্মস্থল গঙ্গা তীরের পটুয়া পাড়া কুমারটুলির কথা। শুনতাম খড়, মাটি, দড়ি, বাঁশ, তুষ, রঙ ইত্যকার পার্থিব সামগ্রীর সমবায়ে তারা কীভাবে ঈশ্বর নির্মাণ করেন। তারা যাদের টিন বা ত্রিপল এর ছাউনি দেওয়া স্টুডিওতে মূর্তি বানাতেন সেই সব মালিকদের নাম শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে যেতো। ওরা বলতেন এবছর নারাণ পালের ঘরে কাজ করলাম। নারায়ণ রুদ্র পাল আসলে কুমারটুলির একজন প্রতীমা শিল্পী এবং প্রতীমা ব্যবসায়ী। এইরকম বাসু পাল, গণেশ পাল, চায়না পাল, প্রদীপ পাল, রাখাল পাল কত না নাম শুনতাম। কোনো ঘরে বাংলা দুর্গা তো কোনো ঘরে থিমের দুর্গা বানাতেন তারা। দুর্গা পূজার তিন মাস পূর্বে সকলে চলে যেতেন কাজে আর ফিরতেন জগদ্ধাত্রী পূজার পর। মাঝে দুর্গা পূজার অষ্টমী থেকে দশমী পর্যন্ত দিন তিনেকের ঘরে ফেরা। আমরা যখন দুর্গা পূজার ষষ্ঠীর দিন থেকে নতুন জামা পরতাম তখন কুমোর পাড়ার ছেলেরা চেয়ে থাকতো পথের দিকে। অষ্টমীর দিন তারা কলকাতা থেকে আনা নতুন জামা পরে দেখাতো। হাসিতে ভরে উঠতো কুমোর পাড়া। ঘরের ছেলেরা কাজ করে অর্থ নিয়ে ফিরে এসেছে। বর্ষার কয়েক মাস মুদি দোকানে যে ধার বাকি হয়েছে এবার তা শোধ হয়ে যাবে। মহাজনেরা হাজির হতো সুদ-আসল উদ্ধারে।
একদিন কুমোর পাড়ায় উৎসবের মেজাজে থাকতো শহুরে ছোঁয়া। আমরা শুনতাম কলকাতার বড়ো বড়ো পূজার কথা, প্যান্ডেল, লাইট-এর কথা। সেটাই ছিলো আমাদের কলকাতা তথা কলকাতার পূজা পরিক্রমা।

একটা সময় গ্রামীণ অর্থনীতির অপরিহার্য কারিগর ছিলেন কুম্ভকার সমাজ।কিন্তু মৃত্তিকার কারিগরেরা শ্রমের শিল্পী হিসেবে  আজ সংকটের মুখে। সৃজনের শিল্পী হয়ে হয়তো অনেকেই অস্তিত্ব আজো টিকিয়ে রেখেছেন। সর্বগ্রাসী সভ্যতার মুখে সে আর কতক্ষণ? মাটির দিকে ফেরার ঘণ্টাধ্বনি শোনার অপেক্ষায় শুধু পথ চলা।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *