পুনর্ভবাপুত্র। ধারাবাহিক উপন্যাস। প্রথম পর্ব। লিখছেন আহমেদ খান হীরক।

1

“পাশের ঝোপে শিব মন্দির

খুব গোপনে ফুটছে জবা

বাতাস বহে বাঁশের শরীরঃ

যাচ্ছে বেঁকে অসম্ভবা

নদীর নামটি পুনর্ভবা

পুনর্ভবা… পুনর্ভবা…”

 

ছোটোগল্পের সমান নদী–এতটুকুন; কিন্তু টানটান। এই বাঁক নিলো তো, এই আবার ফিরে তাকাল, একটু হেসে নিয়েই এই ছুটল তরতরিয়ে!

একদিকে রাইসমিল ফেলে, একদিকে একটানা গহীন আমবাগান ফেলে, পুনর্ভবা ছুটল লালব্রিজটার দিকে। লাল লোহার ব্রিজ। নিঃসঙ্গ। ওটার ওপর দিয়ে ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। মানুষ থাকে না ট্রেনে। থাকে পাথর, চাল, কয়লা আরো কত কি! রহনপুর থেকে সিন্দাবাদ… বাংলাদেশ থেকে ভারত!

তবে সে-সব গল্প থাক। সে-সব তো বড় গল্প। আমরা বরং তাকিয়ে নিই আমাদের ছোট্ট ছোটগল্পটার দিকে। আমাদের পুনর্ভবার দিকে। গ্রামের আর পাঁচটা নদীর মতোই তো সে… তবু এত কেন বিতং তাকে নিয়ে?

ভাবলে অবাক লাগে। বিস্ময় জাগে। নদী কারো এত হয়ে থাকে নাকি?

তাই মাঝে-মাঝেই ভাবতে বসি। কেন রে এমন? একটা নদী জীবনভর তাড়িয়ে ফেরে কেন? ঘুমের ভেতর কুলকুলকুল তার জাগা… জাগার ভেতর চলা… চলার ভেতর এত্ত এত্ত বলা!

হতে পারে পূবের সূর্য উঠলে পশ্চিমে যে ছায়াটা পড়ে, সেইটা আমার পড়ে ওই নদীর গায়ে বলে; হতে পারে

হাফপ্যান্টের শৈশবটা খলসি মাছের মতো খলবলিয়ে রেখেছে সে বলেই; আমার মনে, আমার মাথায়, হা করা এক ক্ষুধা; তার সাথে আবার দেখা হওয়ার। আবার ছুটে যাওয়ার!

জানলা দিয়ে দেখলে তখন নদী তো না… যেন আস্ত একটা মাছ। রূপার মাছ। চোখ ধাঁধানো রূপ। দুই পাড়ের সবুজ জমিন ফেঁড়ে যেন একটা থার্মোমিটার। পারদ শরীর ঝিকমিকিয়ে যায়। আমার তখন জ্বর। আমি চাই ওই নদীতে আবার খেলব কবে! হেল্লু খেলব, সাঁতার দিবো, মাছ ধরব গামছা পেতে। পাথরঘাটে গা শুকানো…গুজরঘাটে নৌকা দিয়ে বানিয়ে রাখা আজব সেতু ঠেলে, আমের দেশে যাবো! কবে যাবো?

আম্মা তখন কবুতরের ঝোল দিয়ে ভাত ঠেলে দেয় মুখে।

বিস্বাদ সব…উফ!

ছয় দিনের জ্বরে কাহিল পড়ে আছি। সকাল থেকে জ্বরটা নেই। কিন্তু চোখ যেন ঘুলঘুলিয়ে যায়। একটু তাকালেই চিলকে ওঠে মাথা। আমি বলতে চাই, খাবো না!

কিন্তু আম্মার থমকানো মুখ দেখে সাহস হয় না। গ্রাস না, ঘাস খাই যেন। আমার চোখে নদী।

আম্মা কিন্তু দৃষ্টি দেখেই বোঝে। গড়গড়ায়–‘ওইখানে সারাটা দিন দাপাদাপি করেই জ্বর বাধিয়েছিস। স্কুল থেকে ফিরে ঘাম শরীরেই নদীতে নামা… আর না! আর ডাকলে বাড়ি ফিরে আসবি এরপর থেকে…বুঝলি?’

তা আম্মা ছাদের ওপর থেকে ডাকলেই শুনতে পাই। পাথরঘাট এত কাছে।

উঁচু ঢাল কেটে বসানো সিমেন্টের সিঁড়ি, তারপর বেশ লালমাটির খটখটে রাস্তা পেরিয়ে গেলে আমাদের পাথরঘাট। আমার এক শান্তির জায়গা।

একটু বড় ক্লাসে পড়তে হতো নামকরণের স্বার্থকতা। কবিতার, গল্পের, নাটকের।

আমাদের এই পাথরঘাটের নামকরণের স্বার্থকতা জ্বলজ্বলে ছিল চোখের সামনে। ঘাটে ছিল হলুদরঙা পাথর। পানি বাড়লে কেউ পাথরটা ওপরে নিয়ে আসত, পানি নামলে নিয়ে যেত নিচের দিকে। পানির সাথে সাথে পাথরটার এমন ওঠা-নামা প্রথম প্রথম বিস্ময় জাগাত। ভাবতাম গভীর রাতে পাথরটা একা একাই যাতায়াত করে বোধহয়। পাথরটাকে আমার জীবন্ত মনে হতো–বা কে জানে, এখনো হয়তো মনে হয়, ওর একটা চলাফেরার জীবন আছে। বোঝাবোঝিরও জীবন আছে! কত কথা, কত মানুষের শ্বাস, হাসি-কান্না ওই পাথরচাপায় আছে।

তো, ঘাটটাজুড়ে ছিল আমাদের পিচ্চিপাচ্চাদের দখল। সঙ্গে অবশ্য পাড়ার বোন-আম্মা-চাচিদেরও যাতায়াত ছিল। পাথর থাকায় সারাদিন সেখানে কাপড় কাঁচত তারা। কেউ কেউ আলাদা করে পিঁড়িও আনত। সাবান ঘষা, ধোয়া, পানি ছাড়ানো তারপর ডালিতে করে কাপড়গুলো রেখে দেয়া। কেউ কেউ ওই ঘাটেই সরু বাঁশ পুঁতে কাপড় শুকানোরও ব্যবস্থা করে ফেলত। আর আমরা সেই কাপড়যজ্ঞে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে খেলে যেতাম নানান খেলা।

সবচেয়ে প্রিয় ছিল হেল্লু।

হেল্লু একটা দারুণ খেলা যে এর অলিম্পিক নাই—হেল্লুর কথা ভাবলে এখন এমনটাই ভাবনা আসে। মনে হয় যে খেলাগুলোর কোনো কাঠামো নেই, প্রতিযোগিতা নেই, অলিম্পিক নেই সেগুলোই আসলে দারুণ খেলা।

হেল্লু খেলা যেত যতজন খুশি ততজন মিলে। যখন যে ঘাটে আসতো, লেগে পড়ত খেলতে।

উপকরণ– একটা শুধু হালকা কোনো শলা। যা পানিতে ভাসবে।

শুকনো কাঠের টুকরা যেমন হতো তেমন হতো গাছের মরা শেকড়। আর এমন কিছু না পেলে পিটালু তো ছিলই!

 

তা পিটালু আমাদের কাজে আসত নানানভাবে; যেহেতু এই পিটালু অন্যদের কোনো কাজে আসত না। মানে বনজ একটা ফল। বনেই জন্মে এলোমেলো। কেউ খায় না। কেউ পোছেই না। কিন্তু আমাদের কত কাজ। কঞ্চির দুই মাথায় দুইটা পিটালু আটকে গাড়ি হয়ে যায়। আবার পিটালু ছুঁড়ে খেলা হয় চোর-পুলিশ। যাকে যখন পারা যায় পিঠ জ্বলিয়ে দেয়া যায় মেরে। আবার এই যে… হেল্লু খেলতে এসে কিছু না পেলে ওই পিটালু দিয়েই শলার কাজ চালানো। পানিতে ছুঁড়ে পানির ভেতর হাত দিয়ে আলোড়ন তুলে পিটালুটাকে একদম গুলিয়ে ফেলা। তারপর সবাই মিলে তা খোঁজা। যে খুঁজে পাবে সে জিতবে, কিন্তু আসলে হারবে না কেউ। খেলা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। লাল হয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। হাতের আঙুলের মাথাগুলো সাদা হতে হতে হাড়ের মতো হয়ে যেতে থাকে। আর তখনই হয়তো আম্মার ডাক শোনা যায় ছাদ থেকে–হীরক…

আমি তো শুনেও না শোনার ভান করি। খেলতে থাকি। পাথরে কাপড় থুপথুপানো রুমা ফুপু কি কচিমুন আপা তখন ডাক দেয়—এই হীরক, আম্মা ডাকছে যে…উঠো পানি থেকে…

বড়দের অমান্য করার মতো যথেষ্ট বেয়াদব তখনও হতে পারি নি। হেল্লু তাই গুলিয়ে যায়। উঠব না উঠব না করেও উঠতে হয়। বলা যায় নদীর মায়া ত্যাগ করে। কিন্তু একেবারে ওঠার আগে একটু সাঁতরে নিতে হয়। পানির দিকে যেতে যেতে, মাঝনদীর দিকে যেতে যেতে, অল্প অল্প ঢেউয়ের আঘাত মুখে নিতে নিতে মনে হয় এমনভাবে সাঁতরে আমি চলেই যেতে পারব অনেক দূর… অনেক অনেক দূর। পুনর্ভবা যেন একটা পঙখীরাজ.. আর আমি রাজপুত্র!

কবে যে আবার সাঁতরাবো?

আম্মা থার্মোমিটার বগলে দেয়। আমি বলি, জ্বর নাই জি আম্মা।

আম্মা বলেন, আর যেন না আসে বাবা। একটা রোজা মানত রেখেছি।

আমার কিছু হলেই আম্মা রোজা মানত রাখে। যেদিন আম্মা রোজা রাখে সেদিন আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আম্মাকে খুব খুশি খুশি দেখায়। প্রাপ্তির একটা আনন্দ তার মুখে খেলা করে। আম্মা থার্মোমিটার দেখে–নাহ! আর আসে নি জ্বর! আল্লাহ, মানিকটার জ্বর আর দিও না!

‘কালকেও যদি জ্বর না আসে তাহলে গোসল করব আম্মা?’

‘হুম।’

আমি হাসি। সে হাসি দেখে আম্মাও হাসে। বলে, দাঁত মেলে দেয়ার কিছু নাই। কলের পানিতে গোসল করবেন কালকে আপনি। আমি করিয়ে দেবো।

আমার হাসিটা মুছে যায়। আম্মার হাতে গোসল করা আর নির্যাতিত হওয়া একই কথা। কেমন যে ডলে ডলে সাবান মাখিয়ে দেয়… মনে হয় গাছের শরীর থেকে বাকল নামানোর ঠেকা নিয়েছে। আমার ছোট্ট বুক ফেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আম্মা থার্মোমিটার গুছিয়ে রাখতে যাবে তখনই বাইরের দরজায় শব্দ। মেজ বোন ঢুকেছে। পুরো শরীর ভেজা। নদী থেকেই আসছে। কাঁপছে!

কী সাঁতারটাই না কেটেছে, ভাবি আমি!

আম্মা বলে, কী হয়েছে রে ইতি, কাঁপছিস ক্যান?

ইতি আপা তাকিয়ে থাকে চুপ করে। কাঁপতেই থাকে। আম্মা তাড়াতাড়ি শুকনো একটা গামছা জড়িয়ে দেয় আপার গায়ে। কাঁপুনি থামে না। হঠাৎই হাউমাউ করে বলে ওঠে–ছবি নাই। ছবি নাই। ছবি হারিয়ে গেছে নদীতে!

আমিও উঠে চলে আসি আঙিনায়। ছবি মানে ছবি আপা। ইতি আপার বুজুম বন্ধু। এক সাথে বড় হয়েছে। পাড়া মাথায় করে তারা দুজনে মিলে একই সাথে। আম্মা বলে, হারিয়ে গেছে মানে?

ইতি আপা আর কোনো কথা বলতে পারে না। ধপ করে বসে পড়ে আঙিনাতেই। আম্মা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। আমি বুঝে উঠতে পারি না কলেজে পড়া ছবি আপা নদীতে কীভাবে হারিয়ে যায়? পাথরঘাট থেকে কীভাবে এই দিনেদুপুরে নিখোঁজ হয়ে যায়!

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “পুনর্ভবাপুত্র। ধারাবাহিক উপন্যাস। প্রথম পর্ব। লিখছেন আহমেদ খান হীরক।

  1. ভালো হচ্ছে হীরক। আমরা যেন তোর সাথে পুনর্ভবায় অবগাহন করছি। এইভাবেই চলতে থাকুক। শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *