মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ১৭। বাড়িওয়ালা। লিখছেন আদিত্য ঢালী
বেশ কিছু পর্ব আগে কোনো এক পর্বতে একবার প্রসঙ্গক্রমে এসে গিয়েছিল আমার বাড়িওয়ালার কথা। তখন সে পরিসরে আলোচনা হয়নি। আজ পরিসর পাওয়া গেছে। সেইবারেই বলেছিলাম যে গ্রামের মানুষেরা খুবই সহজ সরল হয় এই আপ্তবাক্য আসলে ভুল। সঠিকটা হল কিছু কিছু গ্রামের মানুষ সহজ সরল হন, সবাই না।
ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়িওয়ালি ছিল। আমার ছিল বাড়িওয়ালা। এমনিতে মালিক ও বাড়িওয়ালার সম্পর্ক যে বরাবরই এই বঙ্গদেশে তিক্ত তা আমরা সকলেই কম বেশি অবগত। ঘর খালি করার জন্য আলাদা করেই আইন করতে হয় সরকারকে। একসময় রীতি ছিল যে যতদিন থাকবে তার জোর ততদিন। দীর্ঘবছর থাকার ফলে একসময় ভাড়াটেরাই মালিক হয়ে যেত, বা মালিকের সমতুল্য হত। এই প্রসঙ্গে আপনার অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘গুলাবো সিতাবো ছবির কথা মনে আসতেই পারে। আমারও এল তাই উল্লেখ করে দিলাম। মেটা ডেটা হয়ে থেকে যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে। আমরা যখন বাড়ি করে এলাম প্রথমবার তখন আমাদের আশপাশের প্লটগুলোতে কোনো বাড়ি ছিল না তখনও। বাড়ির পিছনে একটা পচা খাল আর সামনে জলাজমি। জমির ওপার থেকে আবার রাত হলেই শিয়াল ডাকে। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা জলের তলায়। কোনো দোকানে যেতে হলে মিনিট পনেরো হেঁটে আসতে হবে। তাও রাত আটটার পর এ রাস্তায় কেউ থাকে না। এমনিতেই আমার মা খুব ভিতু। আমারই মতন। তাই মা ঠিক করল যতদিন না অবধি আশেপাশে বাড়ি হচ্ছে ততদিন বাড়িতে একটা ভাড়াটে থাকবে। সেইমত ভাড়া ঠিক করা হল। বাবা-ই ঠিক করল। বাবার পার্টির লোক। বাবা মা আর ছেলে। ভাড়া নেওয়া হবে খুবই কম। শুধুমাত্র বাড়িতে লোক থাকবে সেইজন্যই দেওয়া। আমরা গৃহপ্রবেশ করে আসার দুদিন পরই তারা এল। আসার কথা ছিল তিনজনের। এল পাঁচজন। সাথে ওনার বিবাহিত মেয়ে ও তার কন্যা। কথা হয়েছিল দুটি ঘরের মধ্যে একটিতে তারা থাকবে আর আমরা একটিতে। বাইরের ড্রয়িং রুমে আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা যখন এল তাদের সাথে এত মাল এল যে তাদের ঘরে ঠাঁই হল না। বাধ্য হয়ে ড্রয়িং রুমে একটি সিঙ্গেল বেড খাট পাতা হল। এবং তিন বছর সেটি সেখানেই ছিল। ছেলেটি ওখানেই শুতো। একপ্রকার দখল। যাক গে যা হল তা হল। সেসব নিয়ে বলবে কে!। শুরুর দিন থেকে তারা খুবই ভালো ব্যবহার করতে লাগল। আমার মাকে বউদি বউদি করে আর আমাকে ভাই ভাই করে ডেকে সারা বাড়ি সবসময় মাতিয়ে রাখত। আমার মাও আনন্দে থাকত। ভালোমন্দ রান্না করলে আমাদের দিত। আমরা আঙুল চুষে খেতাম। সে কী দারুণ ব্যাপার চলছিল! কিন্তু সময়ের নিয়মে দারুণ ব্যাপার কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এক্ষেত্রেও হল না। ধীরে ধীরে সম্পর্ক এমন হল যে কেউ কারোর মুখ দেখতে পর্যন্ত চাইত না। যেন একটা কোল্ড ওয়্যার চলত। মাঝখান থেকে আমার ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ওদের ঘরের দরজা সবসময় বন্ধ থাকত। উঁকি মেরেও আমরা কিছু দেখতে পেতাম না। বাচ্চা মেয়েটা যে বছর ঘুরতেই অনেকটা বড় হয়ে গেল সারাদিন প্ল্যাস্টিককে প্যাক্সি প্যাক্সি করে চেঁচিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। আর মায়ের নির্দেশে আমাদের আড়চোখে নজর রাখত। কিছু নজরে পড়লেই সোজা মায়ের কাছে রিপোর্ট করত। ট্রেনিং ছিল দারুণ। এই ঝামেলা শুরু হওয়ার কিছুদিন যাওয়ার পর পরই মা বুঝতে শুরু করল যে আমাদের অবর্তমানে রান্নাঘর থেকে নিত্যদিনের সামগ্রী কিছু কিছু করে লোপাট হচ্ছে। কিন্তু তখন না ছিল আমাদের কাছে মোবাইল না আমরা স্ট্রিং অপারেশনের ব্যাপারে কিছু জানতাম। সিসিটিভি ক্যামেরা তো কোন দূরের কথা। কাজেই মাল লোপাট হওয়া আটকানোর থেকে বাঁচতে আমাদের রান্নাঘরে নতুন দরজা লাগাতে হল। তাতে কিছুটা রেহাই পাওয়া গেল ঠিকই কিন্তু একেবারে রেহাই মিলল না। আমাদের কাছে তখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। কারন চুক্তি অনুযায়ী তিন বছর পর তাদের উঠে যাওয়ার কথা। এর ফলে আমার একটা লাভ হয়েছিল। এতদিন মা নিজেই আমায় সব যায়গায় নিয়ে যেত নিয়ে আসত। সে পড়াতে হোক বা কারোর বাড়ি। এই চুরি আটকানোর জন্য মা সারাক্ষণ ঘরেই থাকত। আমায় আর দিতে বা নিতে আসত না। যার ফলে আমার নতুন ডানা গজালো। সেই যে উড়তে শিখলাম এখনও উড়ে চলেছি। তাই কিছুটা হলেও আমি ভাড়াটেদের কাছে কৃতজ্ঞ। তিন বছর পার হতেই তারা চলে গেল। চুক্তি রিনিউ করার কথা একবার বলেওনি। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
চাকরিতে প্রথমদিন গিয়ে যে বাড়িটা দেখেছিলাম সেটা পছন্দ হয়নি আগেই বলেছিলাম। পরেরদিন আমাদের সাবস্টাফ এসে বলল- “আমার উল্টোদিকের বাড়িটা একবার দেখে আসুন। আমি কথা বলেছি”। আমার সেদিন বিকেলে ফেরার কথা। পরেরদিন থেকে ট্রেনিং শুরু। বাড়িতে ফেরার আগে দেখতে গেলাম। দোতলায় দুটো ঘর। তার মধ্যে আমায় একটা দেখানো হল। বেশ বড়ই ঘর। রঙ করা। মেঝে করা। বাইরের ঘরে মোজাইক করা। বাথরুমে টাইলস, মার্বেল লাগানো। বেশ ভালোই। পছন্দ হয়ে গেল। বাড়িওয়ালা বলল আগামী সপ্তাহের মধ্যে সে একটা খাট এনে দেবে কোনো অসুবিধে হবে না। চিন্তামুক্ত হলাম। যাওয়ার পথে সাবস্টাফকে ফোন করে বললাম বাড়িটা পছন্দ হয়েছে। কত ভাড়া কী নেবে একটু জানাবেন। সে সম্মতি দিতে বাড়ি ফিরলাম। টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে যেদিন প্রথম বাড়িটায় থাকতে গেলাম, সাথে বাবাও গেলো। আমি অফিসে চলে গেলাম, বাবা বাড়িটায় চলে গেল। বিকেলে অফিস থেকে বের হতেই দেখি বাবা নীচে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই বলল “চল খাট দেখতে যাব”। আমি অবাক হলাম। খাট দেখতে যাবে মানে। জিজ্ঞেস করলাম। বাবা বলল “ওরা তো খাটের কথা কিছু বলল না। যে ঘরটা দেখালো সেখানে তো খাট নেই। তার পাশের ঘরটায় আছে। মালিক তো নিজেই বলল কম দামে খাট পাওয়া যাবে”। আমি বললাম “খাট তো ওদের দেওয়ার কথা তাই তো বলেছিল। এখন খাট কেন কিনব। কথা বলি গিয়ে”। বাবা আরও ভিতু। বলল “আর কথা বাড়িয়ে কী হবে। একটা ছোট খাট নিয়ে নিই চল। এখানে একা একা থাকবি ওদের সাথে কথা বাড়িয়ে কি লাভ বল!” আমি কিছু বললাম না। জানি এখানে বললেও কাজ হবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মায়েরা কখনই বোঝে না ছেলেমেয়েদেরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে সব বিষয়ে, যেমন তাদের থাকে। তাই কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার আগে অন্তত ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে ভাবতে হবে সেটা তারা কখনই বোঝে না। বলা ভালো বোঝার চেষ্টা করে না।
খাটের অর্ডার দিয়ে যখন ফিরে এলাম ঘরে ঢুকে দেখলাম যে ঘরটা আমায় দেওয়ার কথা হয়েছিল সেই ঘরটা না দিয়ে তার পাশের ঘরটা দিয়েছে। তা ঠিক আছে। যে ঘরই দিক আমার তাতে কী! আমি একা থাকব একটু ছোট বড়তে কোনো সময়া হওয়ার কথা নয় আমার। হবেও না যে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু ঘরে একটা শোকেস, একটা আলনা, একটা টেবিল ও চেয়ার রাখা। আলনা, টেবিল, চেয়ার যাও ব্যবহার করতে পারব কিন্তু শোকেস আমার কি কাজের? তবুও কিছু বললাম না। বাড়িওয়ালার একটা ছোটো ছেলে আছে। বয়স ঐ বছর দুয়েক। কাকা কাকা ডাকে আমায় দেখলেই। আমিও আদর করে দিই। শুরুর দিনগুলো ভালোই চলছিল। মাঝে মাঝে রাতে ডেকে খেতে দিত। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে আগে থেকেই বলে রাখত সেদিন যেন থাকি, রাতে যেন ওখানেই খাওয়া দাওয়া করি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও তাদের ব্যাঙ্কের সব কাজই করে দিতাম। ব্যাঙ্কে তাদের আসতে একেবারেই হত না। আমিই করে দিতাম সব। মাস কয়েক ভালোই চলছিল। শুধু একটা বিষয়ই আমার চোখে লেগেছিল। হুটহাট করে বলা নেই কওয়া নেই আমার ঘরে চলে আসত। এটা ওটা সেটা নিতে। আমি মাঝে মাঝেই অপ্রস্তুতে পড়তাম। একদিন এমনও হয়েছে অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে জামাকাপড় বদলাচ্ছি হঠাৎ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এসেছে। আমি একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে কোনোরকমে গামছাটা জড়িয়ে নিজের লজ্জা বাঁচিয়েছি। কিন্তু ভদ্রলোকের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দিব্য ঘরে ঢুকে যেটা নেওয়ার সেটা নিয়ে চলে গেলেন।
হঠাৎ একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরতেই বাড়িওয়ালা উপরে উঠে এসে আমার ঢুকে বলল – “শোনো আমরা আগামী সপ্তাহে থাকব না। ডাক্তার দেখাতে বাইরে যাব। তুমি চাবি কিন্তু সবসময় সাথে রেখো। রাতের বেলায় পাশের বাড়ির ছেলেটা শোবে। ওর কাছেও একটা চাবি আছে”। আমি পড়লাম মহা বিপদে। এমনিতেই ভিতু মানুষ। রাতের বেলা মশারি থেকে নামতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় এমন অবস্থায় সারা সপ্তাহ যদি এই শুনশান বাড়িতে একা থাকতে হয় আমার তো তাহলে পিলে চমকিয়ে যাবে। এমনিতে বাড়িতে আমি কোনো কথাই বলি না। কারণ যে কথা বলে কোনো লাভ হবে না শুধুমাত্র জানাবার তাগিদে তাদেরকে জানিয়ে হবেই বা কী! কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের কে জানালাম। কারণ অনেকদিন ধরেই তারা বলছে এখানে আসবে। থাকবে কটা দিন। এই ভালো সু্যোগ। ঠিক হল বাবা মা দুজনেই আসবে। কিছুটা রিল্যাক্স। সু্যোগের সদ্ব্যবহার করলাম। বড়রা বলে সুযোগ এলে সু্যোগ নিতে হয় নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়। আমি পিছিয়ে পড়তে কোনোকালেই চাইনি।
আমি অফিসে থাকতে থাকতেই বাবা মা চলে এসেছিল। আমি জানতেও পারিনি। বাড়িওয়ালাকে ফোন করে পাশের বাড়ির ছেলেটার থেকে চাবি নিয়ে দিব্য ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ ভালোই কাটল। ওঁরা ফিরে এলেন। ফিরে আসার কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ্য করলাম আগের মত আর কথা বলে না। এমনকি ব্যাঙ্কেও নিজেরাই যায়। আমাকে কিছু করতে বলে না। আমি অত কেয়ার করলাম না। একদিন বাড়িতে কিছু একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, আমি ভাবলাম প্রতিবারের মতো হয়ত আমাকে ডাকবে। হোটেলেও বলে রাখলাম রাতে খাব না। কিন্তু ডাকল না। আমি অনেক ভেবেও কোনো উত্তর পেলাম না। এরপর থেকে আবার আমার রাতের ডায়েট শুরু হল। না, মোটা হওয়ার ভয়ে ডায়েট শুরু করিনি। বাড়ি থেকে হোটেলের দূরত্ব পায়ে হেঁটে প্রায় দশ মিনিট। শীত পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। আমি অফিস থেকে ফিরি ছ-টা পার করে। ফিরে এসেই আর যেতে ইচ্ছে করে না। আমি তাই ঘরেই খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। একটা ইলেকট্রিক কেটলি কিনলাম। রাতের বেলা ওতেই ডিম সিদ্ধ করে দুটো পাউরুটির সাথে খেয়ে নিতাম। কোনো কোনো দিন ওতেই ম্যাগি বানিয়ে নিতাম। এইভাবেই প্রায় তিনমাস চলল। বাড়িওয়ালাকে দেখতাম সবসময় গাল ফুলিয়ে টোল করে রাখত। একটা কথাও বলত না। মাসের ভাড়া দিতে গেলে শুধু টাকাটা নিয়ে চলে যেত। আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না কী হয়েছে। এদিকে শীত চলে গিয়ে গরম পড়ে গেছে। আমার রাতের খেতে যাওয়া শুরু হয়নি। এখন আবার নতুন জুটেছে দুপুরের খাবার। ভিড় এত বেড়েছে যে দুপুরে বেড়িয়ে খেতে যাওয়া আর হয় না। ঐ মুড়ি চিড়ে এসব খেয়েই চালাতে হচ্ছে। আবার রোদের তেজও এত প্রখর যে সেই রোদ পেরিয়ে হোটেলে খেতে যেতেও ইচ্ছে করে না। ঠিক করলাম অনেক হয়েছে আর না। এবারে রান্না করে খেতে হবে না হলে আর চলবে না।
(ক্রমশ)