মঞ্চ-আলোকিত মফস্বলের আখ্যান বরুণদেবের ‘শঙ্কর মাস্টার’। লিখছেন গোবিন্দ বিশ্বাস

0

গ্রন্থনামে  চোখ রেখে  পাঠকের মনে এমন ধারণা হতেই পারে যে, ‘শঙ্কর মাস্টার’ আসলে এক ব্যক্তি মানুষের জীবন আখ্যান। তবে গ্রন্থটির নিবিড় পাঠে এ ধারণার অতিরিক্ত কিছু প্রাপ্তি ঘটবে— শেষপর্যন্ত  পাঠক  উপলব্ধি করবেন যে, এ গ্রন্থ শুধুমাত্র শঙ্কর মাস্টারের জীবন আখ্যান নয়, এ গ্রন্থ এক জনপদের আবহমান সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল। যে জনপদ কবিগানে,  কৃষ্ণযাত্রায়,রামযাত্রায়,আলকাপে,বোলানে, গ্রামীণ সংস্কৃতির  নানা ধারায় প্রবাহিত হয়েছে আবহমান কাল ধরে। শঙ্কর মাস্টার কেবল  একটি চরিত্র মাত্র  নয়— শঙ্কর মাস্টার যাত্রাপ্রেমী বহু শিল্পী মনের প্রতিনিধি। গ্রন্থের শুরুতেই লেখক বরুণদেব যখন লেখেন—”আমি আঁজলা ভরে তুলে নিই নদীর জল। জল থেকে উঠে আসে শাহজাহান, দিলদার, হরিপদ, সিরাজেরা। যাত্রার ঝলমলে পোশাকে আবছায়া নদীতটে দাঁড়িয়ে তারা কুর্ণিশ জানায়  এ জনপদকে। কুর্ণিশ জানায় এই প্রবাহকে। সে প্রবাহ নানা ধারায় বয়ে চলে। আমি,এ  জনপদের গত শতাব্দীর সাত-আটের দশকের মুগ্ধ কিশোর এক।” এই কিশোরের  মুগ্ধতা এ জনপদের প্রবহমান সংস্কৃতি  নিয়ে— এই কিশোরের মুগ্ধতা এই জনপদের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে—মুগ্ধতা এই জনপদের প্রবাহমান ভাগীরথী তীরবর্তী প্রকৃতির অমলিন শোভা নিয়ে। আসলে প্রৌঢ়ত্বের  সীমায় এসে দাঁড়ানো লেখক বরুণদেব দাঁড়াতে চেয়েছেন  শৈশব-কৈশোরের উঠোনে। যে মাটির প্রতিটি রেণুতে মিশে আছে তার কিশোর জীবন। গ্রন্থের প্রতিটি পরতে পরতে আছে লেখকের কৈশোরকালের চোখ জুড়ে থাকা সেই অবাক  বিস্মিত সংস্কৃতির আলো। যে আলো স্মৃতির গহবর থেকে বিচ্ছুরিত এই গ্রন্থের অক্ষরে অক্ষরে— “হ্যাজাকের আলোয় মাইক্রোফোনহীন মঞ্চের সেই সময়ে যুবক শিবশঙ্কর ব্যানার্জী দলবল নিয়ে যাত্রায় মেতেছে। অনুজ শঙ্কর সে যাত্রায় শামিল। পাড়ায় পাড়ায় ছকু পণ্ডিত, মোহনচন্দ্র মিশ্র, ঘন্টু চক্রবর্তী,  নারায়ণ বাবাজি… অনেক নাম, প্রবাহের শাখা  প্রশাখা।” এ গ্রন্থের শঙ্কর মাস্টার ইচ্ছে করলেই যাত্রা জগতের ছোটো ফণীর (ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ) হাত ধরে পাড়ি দিতে পারতেন আলোকিত মঞ্চে। পারেননি। কারণ ‘নোঙর পড়ে গেছে তটের কিনারে ‘—সংসারের দায়িত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায় শঙ্কর মাস্টারের। তবু অভিনয় ছাড়তে পারেননি, ছাড়তে পারেননি যাত্রা সংস্কৃতিকে। এ জনপদকে  ভালোবেসে, এ জনপদের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে হাতে তুলে নিয়েছেন  গোল্ডেন ঈগলের খাতা।  সুলেখা কালি আর আর্টেক্স কলমের আঁচড়ে পরিবর্ধন পরিমার্জন করে চলেছেন যাত্রার সংলাপ ও দৃশ্যের— ‘বিনয় বাদল দীনেশ’,  ‘অচল পয়সা’, ‘ হাসির হাটে কান্না’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’র সংলাপে মুখর হয়ে থেকেছে সত্তর-আশির দশকের এ জনপদ ৷ ‘বাণেশ্বরীয় ঢ্যাঁড়ার শব্দে’,’আশরাফীয় প্রচারে’—জেগে ছিল এ জনপদ। হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত মঞ্চ— একটু দূরে কেরোসিন কুপির আলোয় আলোকিত ডালার সামনে বিশ পয়সার এক ঠোঙা চিনেবাদাম কিনে ভিড় জমায় এ জনপদের মানুষ। তারা চেটেপুটে উপভোগ করে আশরাফ আলীর নারী চরিত্রের অভিনয়-নৃত্য, শঙ্কর মাস্টারের দাপুটে সংলাপ। —সেইসব সোনালি দিনগুলি তুলে আনেন বরুণদেব এক সাবলীল অক্ষরমালা নির্ভরে ৷ লেখক বরুণদেব যেমন পদবী বিসর্জন দিয়ে নিজ পরিচয়টাকে নির্মেদ করেছেন। তেমনি এ রচনা  যেন  নির্বাচিত শব্দের এক মেদহীন শরীর।

……………………………

বইয়ের নাম : শঙ্কর মাস্টার (সুপ্রকাশ যাপন গ্রন্থমালা ১)
লেখক : বরুণদেব
প্রচ্ছদ : অদ্বয় দত্ত
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *