খড়কুটোর জীবন : হারিয়ে যাওয়া মুখগুলি । পর্ব ১৪ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

পিঠোপিঠি দুই ভাই হওয়ার কারণে আমি জ্যেষ্ঠ তাই মায়ের দুধের ভাগ ছেড়ে দিতে হয়েছিলো শৈশবেই। রুগ্ন মায়ের তাতে কিছুটা হয়তো মুক্তি মিলে ছিলো। কিন্তু বছর খানেকের আমি দুগ্ধ তৃষ্ণা মেটাতে এর তার বুকের দুধ খেতাম। সেই রকমই আমার এক দুধ-মা পুষি ঠাকুমা। ভালো নাম পুষ্পরাণী। সাহিত্যিক বনফুলের দুধ- মার মতো অনেকটা। পুষি ঠাকুমার স্বামী-সন্তান কিছুই ছিলো না। দাদার সংসারে ভাইপো – ভাইঝিদের নিয়ে দিন কাটাতেন। খেতেন নিজের মতো করো।
বৈষ্ণব ছিলেন পুষি ঠাকুমা। ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য গ্রামেই ভীক্ষা করতেন। কাঁথা দিয়ে বানানো ছোট্ট একটা ভীক্ষার ঝুলি আর হাতে একটা চটের থলে নিয়ে তিনি আমাদের বাড়িতে ভীক্ষা করতে আসতেন। ছোট্ট আমি মায়ের সঙ্গে একবাটি চাল আর আলু নিয়ে গিয়ে সেই ঝুলিতে দিয়ে প্রণাম করতাম। তিনি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতেন। বছর খানেকের যখন আমি তখন তার শুকনো বুকে মাতৃ ধারার সন্ধান করতাম। তিনি নাকি পরম স্নেহে আমার সেই আকুতি মেটাতেন ।
লম্বা-চওড়া কালো কোলো চেহারার পুষি ঠাকুমা সাদা থান পরিধান করতেন। কাঁচা পাকা চুলগুলো বাঁধা থাকতো কালো সরু ফিতে দিয়ে। নতুন পুকুর থেকে স্নান সেরে এক ঘটি জল নিয়ে তিনি ঘরে ফিরতেন। স্কুলে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যেতো তার সঙ্গে। ঘর বলতে তার কঞ্চির বেড়া দেওয়া মাটি লেপা দেওয়াল, উপরে বাঁশের কাঠামোর উপর খড়ের ছাউনি। মাটির মেঝে গোবর আর রাঙা মাটি দিয়ে নিকানো। যেখানে জ্যোৎস্নার চন্দন লাগে পূর্ণিমা রজনীতে। সামনে ছোট্ট উঠানে মাটির তুলসী মঞ্চ। কয়েকটি ফুলের গাছ যার মধ্যে তুলসী, দূর্বা, রঙিন কচু, দোপাটি, গাঁদা, বটকৃষ্ণ , টাইম ফুল, দুপুর চমচমি, মোরগ ফুল আর খড়ের চালে ওঠা তরুলতা । সাক্ষাৎ বৃন্দাবনের কুঞ্জ যেন। নিধুবন কিনা জানিনা।
স্নান থেকে ফিরে তিনি তুলসী মঞ্চে জল ঢালতেন । তারপর তুলসী পাতা ও কিছু ফুল চয়ন করে কুটির মধ্য প্রবেশ করতেন। রাধা-মাধবকে জল-বাতাসা, তুলসী আর ফুল দিয়ে আত্ম নিবেদন করতেন। তার সেই প্রার্থনার মধ্যে লুকিয়ে থাকতো বিদ্যাপতির প্রার্থনা —
‘ মাধব বহুত মিনতি করি তোয়
দেহ তুলসী-তিল সমর্পিলু
দয়া জনু ছোড়বি মোয় । ‘
এরপর তিনি প্রসাদ মুখে দিয়ে জল গ্রহণ করতেন। তারপর তিনি সকালে মাধুকরী করে আনা চাল-সব্জী বসিয়ে দিতেন মাটির হাঁড়িতে মাটির উনানে। সামান্য ভোজনান্তে তিনি একটু বিশ্রাম নিতেন। মাটির মেঝেতে বিছিয়ে নিতেন নিজের বানানো খেজুর পাতার পাটি। কেউ খেজুর গাছ কাটতেই তিনি চেয়ে আনতেন পাতাগুলি। বাড়ি নিয়ে এসে প্রথমে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিতেন ডেগোগুলো। তারপর শুকনো পাতো গুলো ছাড়িয়ে নিয়ে বেঁধে রাখতেন। নির্জন দুপুরে রাধা-মাধবের নাম করতে করতে সেই পাতা দিয়ে বুনে চলতেন খেজুর পাটি। বিনুনির মতো করে বুনে প্রথমে জড়িয়ে রাখতেন। তারপর পাতা দিয়ে জুড়ে জুড়ে বানিয়ে ফেলতেন পাটি।
পুষি ঠাকুমা গোবর কুড়িয়ে নিয়ে এসে জড়ো করে রাখতেন। ঘুঁটে দিতেন কিছুটা । আর বাকিটা তে হতো লেপা-পোঁছার কাজ। জ্বালানির জন্য লোকে যখন নয়নজলিতে পাট ছাড়াতো তিনি চেয়ে আনতেন পাটকাঠি। সেগুলি ঝুঁটি বেঁধে শুকিয়ে ঘরের পাশে পালা দিয়ে রাখতেন। গমের নাড়া, সর্ষের কাচকা চেয়ে আনতেন। কুড়িয়ে আনতেন গাছের ডাল -পালা , পাতা পুতি।
সন্ধ্যার সময় তিনি অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। গ্রামের লোকেরা তার কাছে হাজির হতো জলপড়া,তেলপড়া বা মাদুলির জন্য। কারোর  বাচ্চার দোষেরভাব হয়েছে, কারোর বাচ্চা মায়ের স্তন মুখে নিচ্ছে না, কারোর বাচ্চার হাঁসুলি উঠেছে, তো কারোর বাচ্চা শুকিয়ে যাচ্ছে এসবের মুশকিল আসান পুষি ঠাকুমা। লোকের বিশ্বাসের আশ্রয় ছিলেন তিনি। এগুলিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বুজরুকি মনে হলেও গ্রাম জীবনের সংস্কার আটকায় কার সাধ্য।
এসব করে পুষি ঠাকুমার দু-চার আনা উপার্জন হতো।
বৈষ্ণব হলেও পুষি ঠাকুমার মাঝে মাঝে ভর হতো। মা কালী তার মাথায় ভর করতো। তখন তার অন্য চেহারা। এলো চুলে মাথা ঘোড়াচ্ছেন, চোখগুলো লাল টকটকে।মুখে বিড়ি বিড়ি করে কী সব বলতেন। ছোটো বলে ঠিক বুঝতে পারতাম না। তবে সেই সময় ঠাকুমাকে বেশ ভয় ভয় করতো। লোকে ভরের সময় নানান বিষয়ে ঠাকুমার কাছে জানান দিতো তাদের নানান সমস্যা নিয়ে। চার আনা বা আট আনা সামনে রাখা হতো তার। তারপর গলায় কাপড় দিয়ে মা বলে সম্বোধন করে সমস্যার কথা বলা হতো। স্বয়ং মা কালী তার মুখ দিয়ে কথা বলতেন সবার বিশ্বাস। ঘণ্টা খানেক ভর চলার পর মা কালী ঠাকুমাকে ছেড়ে গেলে তিনি মূর্ছিত হয়ে পরতেন। তখন সকলে জোড়ে জোড়ে মায়ের নাম নিতে নিতে জল ঢালতেন ঠাকুমার মাথায়। তিনি চেতনা ফিরে পেলেই আবার সেই আগের মানুষ।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমার নানান অসুস্থতা
দেখা দিতে থাকে। তখন তিনি আর ভীক্ষায় যেতে পারতেন না। সরকারী জিয়ার বা বার্ধক্য ভাতা পেতেন মনে হয় সামান্য। দাদার বা গ্রাম্য জনেদের সাহায্যে অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটান তিনি অন্তিম সময়গুলো। চিকিৎসার সুযোগ তিনি তেমন পাননি। পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকুরুণের মতো একদিন তার জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। একটা কালের অবসান ঘটে যেন।  দুধের দাম তো শোধ হয় না কোনো কিছুর বিনিময়ে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *