খড়কুটোর জীবন : হারিয়ে যাওয়া মুখগুলি । পর্ব ১৫ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

মাঝে মাঝেই দেখতাম তিনি গেরুয়া পোশাক পরে এক কাঁধে গেরুয়া ঝোলা অন্য কাঁধে বড়ো করাত দোলাতে দোলাতে হন হনিয়ে হেঁটে চলেছেন। তাকে দেখে রাস্তার লোক আলোচনা করে। –‘ পশু মিস্ত্রী এখন চললো মাস খানেকের জন্য। কোনো গ্রামে হয়তো কাজ পেয়েছে। সেখানেই থাকবে, খাবে, কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে। ‘ অন্য কেউ বললো — ‘ বিয়ে-সাদি তো করেনি। ফকির লোক। প্রতিদিন বাড়ি ফিরেই বা কী করবে। ‘
আসলে পশুপতি সূত্রধর সংসারে এক সন্ন্যাসী। একা থাকলেও দাদা, বৌদি, ভাইপো, ভাইঝি এবং বৃদ্ধা মায়ের ভরণ-পোষণের দায় থেকে তিনি নিজেকে মুক্তি দেননি। স্বাধীন ভাবে থাকেন। উপার্জিত অর্থ অধিকাংশই দাদার সংসারে তুলে দিয়ে নিজে ফকিরের মতো জীবন কাটান। সঙ্গী বলতে একটা দোতারা। অসংখ্য বন্ধন মাঝেই তিনি বৈরাগ্যের মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ খুঁজে নিয়েছিলেন।
পশু দাদুর বড়দার নাম কালী মিস্ত্রী। সবাই বলতো কালী পণ্ডিত। তার কিছু বই-পত্র আমি দেখেছি। তবে প্রতি বছর তিনি মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকা কিনতেন। গ্রামের লোক তার কাছে হাজির হতো কবে অমাবস্যা, কবে পূর্ণিমা, কবে একাদশী ইত্যাদি জানার জন্য। এছাড়া অন্নপ্রাশন, সাধ ভক্ষণ, বিবাহের দিনক্ষণ ও অনেকে জেনে নিতেন তার কাছে। নবজাতক বা নব জাতিকাদের নামকরণও তিনি করে দিতেন। তার কাছে রাজশেখর বসুর ‘ চলন্তিকা’ অভিধান ও দেখেছি। তবে তিনি কতদূর পড়াশুনা করেছিলেন তা জানিনা। কালী সিংহের মহাভারত বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ তাকে পড়তে দেখেছি। গোবিন্দ দাস কবিরাজের ‘ চৈতন্য ভাগবত ‘ তিনি নিয়মিত পড়তেন। সে সব পাঠ শোনার জন্য গ্রাম্য বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রত্যহ সন্ধ্যায় তার বাড়িতে হাজির হতো। গ্রাম্য জনেদের মনে জাগা যে-কোনো ধর্মীয় প্রশ্নের তিনি সমাধান দিতেন। তার আর একটা বড়ো ভূমিকা ছিলো গ্রামের গাজন উৎসবের সময়। গাজনের সন্ন্যাসীরা ভক্তির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে কুল কাঠের আগুন করতো সেই কুল গাছ তিনি আগে কাটতেন। তার পর চোখের পাতায় যে সূচের মতো লৌহ শলাকা দিয়ে বাণ ফোঁড়ার হতো সে কাজও কালী দাদু করতেন নিপুণ হাতে। রুগ্ন শরীরের পক্ককেশ লাঠি হাতে কালী দাদুর নেশা ছিলো পান আর তাস। ঠোঁটের কোনটা পানের রসে লাল হয়ে থাকতো। নন্দ দাদুর তাসের আসরে প্রতিদিন বৈকালে তার উপস্থিতি ছিলো নজরকাড়া। বিল্লাল সেখানে বা বক্কর সেখানে বা জোয়ার হালসানাদের সঙ্গে জমে উঠতো টোয়েন্টি নাইন তাসের খেলা। কে কয় ফোঁটা পেল, এক-দুই করে ডাক, ডবল, রিডবল,ট্রাম, ওভার ট্রাম, লাল সেট, কালো সেট এসব শব্দে সরগরম হয়ে উঠতো তাসের আসর। আমরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম তাদের মুন্সীয়ানা।

কালী দাদুকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম যারা সুতো ধরে কাজ করে তাদের সূত্রধর বলে। প্রাচীন যুগে তাদের পূর্বপুরুষরা রথ, মূর্তি , কাঠের আসবাব বানাতেন। তারা দেব বিশ্বকর্মার বংশধর। আগে তারা ব্রাহ্মণদের মতো পৌতা ধারণ করতেন। তাদের অনেকের উপাধী ভাস্কর। তো পশু দাদুরা এমনই বংশের মানুষ।
পশু দাদুর কাঠের কাজের খ্যাতি ছিলো এলাকায়। স্হানীয় অবস্হা সম্পন্ন মানুষেরা বাড়ির নানান কাঠের কাজে নিযুক্ত করতেন। অনেকেই বলতো উনি বড়লোকের মিস্ত্রী। তবে নাকি যৌবনে দাদুর কর্মকুশলতা ছিলো নজর কাড়া। তিনি একই দিনে একা দুটি গরুর গাড়ীর চাকা বানাতে পারতেন গাছ কেটে। গ্রামে কারোর গাছ কাটার প্রয়োজন হলে পশু দাদুর ডাক আসতো। তিনি বড়ো করাত, কুরাল, বাটালি, বাইশ প্রভৃতি নিয়ে হাজির হতেন। বাড়ির লোকেদের করাত টানতে সাহায্য করতে হতো। কেননা তার নিজস্ব কোনো সহকারী ছিলো না।
গাছ মাপ মতো কাটার পর চেরাই কলে অর্থাৎ সমিলেও মাপ মতো কাঠ চেরাই এর জন্যও তাকে যেতে হতো।
আমাদের বাড়িতেও তিনি কাজে আসতেন। যন্ত্রপাতির ব্যাগ নিয়ে এসে চট বিছিয়ে নিম গাছের ছায়ায় কাজে বসে যেতেন। যে-কোনো বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তার প্রথম কাজ ছিলে যন্ত্রপাতিতে ধার দেওয়া। দেখতাম উকু দিয়ে হাত করাতের দাঁতগুলো শানাচ্ছেন তো পাথরের উপর ছেনি বাটালি প্রভৃতি ঘষছেন । তারপর উদ্দিষ্ট কাজের জন্য মাপমতো কাঠ খুঁজে নিয়ে কাঠের স্কেল ধরে পেন্সিলের দাগ মারছেন। সেগুলো মাপ মতো কেটে নিতেন। বড়ো কাঠ হলে কালি মাখানো সুতো ধরে দাগ মেরে নিতেন। তারপর রেঁদা দিয়ে সমান করা হতো কাঠের টুকরো গুলো। তুরপিন দিয়ে ফুটো করছেন জোড়ের মুখ।আস্তে আস্তে রূপ পেতো কাঠের আসবাব গুলো। আমার মৃত দাদু সন্ন্যাসী ঘোষের একটা খাঠ ছিলো শাল কাঠের। ভেঙে গিয়েছিলো। ঠাকুমা তখনো আদের নিয়ে সেই খাটে ঘুমাতেন। পশু দাদু কাঠ জোড়া দিয়ে সেই খাটকে আবার পুনর্জীবন দান করেন। দাদুর স্মৃতি হয়ে সেই খাট এখনো রয়ে গেছে।

পশু দাদু কাজ করার সময় গুন গুন করে গান গাইতেন। সে গানের কিছুই বুঝতাম না। তবে প্রতি বছর গ্রামের কালীতলাতে কালী পূজা আর ব্রহ্মা পূজার দিন তিনি দোতারা বাজিয়ে গান করতেন। ত্রিশ বছর আগে শোনা একটা গানের কলি এখনও মনে আছে। চতুর্দিকে লোক ঘিরে আছে। তিনি আবিষ্ট চিত্তে গাইছেন – ‘ ছল ছল নয়নে / হাসি মাখা বদনে…..। ‘তার সে নিবেদনে শ্রোতারা মাতোয়ারা। পশু দাদা নিজের কুটিরে প্রতিদিন গাইতেন তার সাধন সঙ্গীত। তার কয়েক জন সাগরেদ ও ছিলো। তারা কেউ খঞ্জনী, কেউ খোল, কেউ গুবগুবি বাজাতেন। আমাদের গ্রামের অদূরেই বৃত্তি হুদাতে রয়েছে সাহেবধনী সম্প্রদায়ের গুরু চরণ পালের শ্রীপাট।কুবীর গোঁসাই যেখানে দীন দয়ালকে নিয়ে বাঁধতেন গান। পশু দাদু কুবীর সাঁই এর অসংখ্য গান জানতেন। তার গানের খাতা ও দেখেছি। গোঁসাই মদনের গান তার কণ্ঠে অপূর্ব ভঙ্গীতে খেলা করতো। বলাহারী সম্প্রদায়, খুশি বিশ্বাসী সম্প্রদায়, কর্তাভজা সম্প্রদায় বা লালন শাহী সম্প্রদায় -এর নানান গান তিনি সংগ্রহ করে গাইতেন। কল্যাণী ঘোষ পাড়ার সতী মায়ের মেলা, জয়দেবের কেঁদুলী মেলা বা অগ্র দ্বীপের ঘোষ ঠাকুরের মেলাতে গিয়ে তিনি প্রতি বছর সাধুসঙ্গ করতেন। মাঝে মাঝে মেলার নানান অভিজ্ঞতা আমাদের শোনাতেন। এসবের মধ্যেই তিনি বোধহয় জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্ম, ধর্ম আর ভক্তির সাধনা করে গেছেন। তিনি হয়তো বোকাই ছিলেন। কিন্তু এমন বোকা ঈশ্বর বোধহয় খুব বেশি সৃষ্টি করতে পারেননি।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *