উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৪। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
![](https://nirmukhosh.in/wp-content/uploads/2023/07/Uronchondi-1-1024x536.jpg)
মধুর ধ্বনি বাজে
এই যে উড়নচণ্ডী জীবন, এলোমেলো ছড়ানো ছেটানো, এই জীবনেই পথ চলতে চলতে কত জনের সঙ্গে দেখা। কারো সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে থাকা, কারো সঙ্গে স্বল্পবাস! স্মৃতির উপর স্মৃতি জমতে জমতে কত মানুষ যে হারিয়ে যায় এ জীবন থেকে। কিছু মানুষ অবশ্য গেঁথে থাকে মনের ভিতর। যেমন মধুদা। বীরভূমের আমোদপুরের মধুদা। রবীন্দ্রগানের একনিষ্ঠ সেবক। গানকে জড়িয়েই ছিল তার জীবনধারণ। গান গাইতেন, গান শেখাতেন। গান শেখাতেন আমোদপুরে, গান শেখাতেন এখানে ওখানে, গান শেখাতেন বোলপুরেও। গানের নেশায় যেমন বুঁদ হয়ে থাকতেন, গরলতরলেও ছিল সমান আকর্ষণ। প্রকৃতি কালো চাদর ছড়িয়ে দিলে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর সামান্য তরলে গলা ভিজিয়ে গানের সুরে হৃদয় ভেজাতে ভেজাতে বাড়ির পথে পা ফেলতেন সঠিক পদক্ষেপে।
সদাগর চরিত্রের মানুষ ছিলেন মধুদা। সাংসারিক কাজ যেটুকু করার বাকি সময় গানের সম্পানেই ভেসে যেতেন। কথা বলতেন কম, ফলে বিরোধ ছিল না কারো সঙ্গে। বরং শিল্পী হিসাবে বাড়তি মর্যাদা পেতেন। যেমন সুরেলা কণ্ঠ, পরিবেশনেও ছিল আবেগ। মধুদার ভাইয়েরাও গান গাইত। কিন্তু মধুদা ছিলেন জনপ্রিয়।
মধুদা শুধু গানই শেখাতেন না, কোনও কোনও ছাত্রীর বাড়িতে আসরও বসাতেন বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে এসে। তারা গান গাইতো, গান নিয়ে দু-চার কথা বলতেন। এভাবেই যখন দিন গড়াচ্ছিল, তখন, মানে সেই সত্তর দশকের মাঝামাজি জরুরি অবস্থার কালে পুরনো মিল কলোনির ছেলেরা ঠিক করল ‘রবীন্দ্র প্রণাম’ অনুষ্ঠান করবে। এমনিতেই গান, নাটক, আবৃত্তির চর্চা ছিল এ পাড়ায়। মাঝে মধ্যেই নানা অনুষ্ঠান হতো ! ছিল নাটকের দল। তা, সবাই ঠিক করল পঁচিশে বৈশাখ পালন করবে। ঠিক হলো পাড়ার ছেলে-মেয়েরা যেমন গান করে, নাচ করে, কবিতা বলে, তেমনই বলবে। এছাড়া হবে একটি রবীন্দ্রনাটক আর গীতি-আলেখ্য। জল ফোটার মতো তরুণ-আবেগ ফুটছে। অধমের উপর দায়িত্ব পড়ল গীতি আলেখ্য লেখার। মদুদা গান নির্বাচন করে দিলেন। গান-কবিতা-ভাষ্যে লেখা হল গীতি আলেখ্য শুরু হলো মহলা। জমে উঠল ক্রমে। দিন এগিয়ে যায়। হঠাৎই জানা গেল কী একটা অর্ন্তবিরোধে অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সকলের মন ভাঙল ! মধুদা বললেন, রিহার্সাল চলবে। কোথাও না কোথাও করব।
সেই প্রথম দেখলাম মধুদার চোয়াল শক্ত হতে কিছুক্ষণের জন্য। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনই ভাব। কয়েকদিন পর মধুদা খবর দিলেন, সাঁইথিয়াতে একটা বড় অনুষ্ঠান হয়, তিনদিন ধরে, সেখানে এই গীতি আলেখ্য হবে। সকলের বুকের উপর যে পাথরটা পড়েছিল, সেটা সরে গেল। নতুন উদ্যম। এক রোববার মধুদার বাড়িতে মহলা হবে ঠিক হল। শান্তিনিকেতন থেকে দুজন শিক্ষক আসবেন।
মধুদার বাড়ি মানে মিল কলোনি বা মিল কোয়ার্টার। দু’কামরার এই বাড়ি গুলো ছিল আদি আমোদপুর সুগার মিলের শ্রমিকদের আবাসন। এই আবাসনের সামনে ছিল একটা বিরাট মাঠ। ওখানে খেলাধূলো হত, অনুষ্ঠান হতো।
ওই যে বললাম, আদি সুগার মিল। তার একটা ইতিহাস আছে। সেটা এখানে বলা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলায় বেশ কিছু বড় বড় চিনির কল ছিল। এক একটা কারখানা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এক একটা উপনগরী। পলাশী, বেলডাঙ্গা, আমোদপুর ছিল তিনটি বৃহৎ চিনির কারখানা। এই সব কারখানার উৎপাদিত চিনি বিদেশে রপ্তানি হতো। জানা যায়, কারখানাগুলোর মালিক ছিল সবই মাড়োয়ারি। কী কারনে জানি না, আমোদপুর আর বেলডাঙ্গার মিল বন্ধ হয়ে গেল। রমরম করে চলছিল পলাশীর মিল। তখন এই মিলের মালিক ছিল কেডিয়া পরিবার। এই মিল চত্বর নিয়েও কত গলা ! সে না হয় আরেকদিন বলা যাবে। এখন বরং আমোদপুরের কথাই বলা যাক।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূত হয়ে বাংলা শাসন করতে এলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ১৯৭২ সালে নির্বাচনে কম্যুনিস্ট পার্টির বিভাজন, নকশালপন্থীদের খুন জখমের রাজনীতির ফাঁস গলে গায়ের জোরে কংগ্রেস বাংলা দখল করল। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর। সেই সময় সন্ত্রাসের মধ্যেও দু-চারটে ভালো কাজ তারা করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে চিনিশিল্পকে উজ্জীবিত করতে গঠিত হল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সুগার মিল ডেভেলমেন্ট অ্যান্ড ফিনান্স কর্পোরেশন’। স্থির করা হল আমোদপুর আর বেলডাঙ্গার পরিত্যক্ত মিল দুটি অধিগ্রহণ করে আবার চালু করা হবে। স্থানীয় চাষীদের আখ চাষে অনুপ্রাণিত করা হবে। আর পলাশী সুগার মিলকে আরও বেশি উৎপাদনমুখী করা হবে।
শুরু হলো কাজ। প্রথমেই বীরভূমের আমোদপুর সুগার মিলকে চালু করা হল। বিশাল এলাকা জুড়ে মিল এলাকা। তার মাঝদিয়ে কালো পিচ রাস্তা ছুটে গেছে লাভপুরের দিকে। ভাগ হয়ে গেছে উত্তর দক্ষিণ। উত্তরে পড়ে আছে পুরনো আবাসন, যা এখন বসবাসকারীদের নিজস্ব আবাস। সামনে প্রশস্ত খেলার মাঠ। ওই মাঠ এসে ধাক্কা মেরেছে পিচ রাস্তার গায়ে। দক্ষিণেও রয়েছে মাঠ। তারই এক পাশে লড়ঝড়ে বিধবার মতো পড়ে আছে কারখানা। যেন সরমে মরে যাচ্ছে। সরকার কুশলী-দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে এসে সেই মিল চালু করলেন। পরিচর্যায় ঋতুমতী হয়ে আবার উৎপাদন মুখী হল। গড়ে উঠল নতুন আবাসন। এলাকাটা ঘিরে ফেলা হল কাঁটা তার দিয়ে। দৈরি হল সদর দরজা। এসব সেই নতুন করে কারখানা গড়ে ওঠার সময়ের গপ্প।
তা উত্তরের সেই আবাসনেই মধুদাদের বসবাস। ক’পুরুষের কে জানে ! এইসব সম্পদ এখন তাদেরই। মালিকানাও, সেই আবাসনেই হবে মহড়া। মূলত গান আর পাঠের। গিয়ে দেলা গেল, দু’জন অতিথি বসে আছেন। একজনের পরনে পা-জামা পাঞ্জাবী, অন্যজন শার্ট-প্যান্ট। শৈলেনদা আর নবদা। আশ্রমিক সঙ্ঘের মানুষ। ওঁদের পরিচালনায় বহু অনুষ্ঠান হয় আশ্রমিক সঙ্গে। মহলা শুরু হল। কিছু কিছু পরামর্শ দিলেন। বেশ জমে গেল।
পঁচিশে বৈশাখ পেরিয়ে গেছে একদিন আগেই। পরের দিন ছাব্বিশে বৈশাখ সন্ধ্যেই অনুষ্ঠান। সদলে উঠে বসলাম ট্রেনে মধুদার অধিনায়কত্বে ! গন্তব্য সাঁইথিয়া মেঘদূত ক্লাব। সঙ্গে দু’জন তথা যন্ত্রশিল্পী। সত্যদা, মানে সত্য মজুমদার তিনি বেহালা বাজাবেন, অন্যজন আমার বাবা, তিনি বাঁশি। মধুদার কাছে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ। তখনকার দিনে এরকম ব্যাগ অনেকেই ব্যবহার করতেন, এখন আর দেখা যায় না। ওই কালো ব্যাগটাই কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করল, কৌতূহল সৃষ্টি করল। মধুদা একপাশে চুপচাপ বসে আছেন। একটু আগে যখন কথা বলছিলেন, তখনই একটা হাল্কা মিষ্টি মাদক গন্ধ নাকে ঠেকেছিল। তাতেই সকলে বুঝেছিল, হাল্কা করে একপাত্তর চড়িয়েছেন। মেয়েরা একটু ভয় পেল, যদি বেশি পান করে এলোমেলো করে দেয়। মধুদার ভাই, দিলীপ, যে তবলা বাজাত, সুর করত, পরবর্তীকালে পিসি সরকার জুনিয়রের ভাই পিসি সরকার ইয়ংদের গ্রুপে অর্গানবাদক হিসাবে কাজ করেছে, আশ্বস্থ করল, দুর্ভাবনার কিছু নেই, গানের ব্যাপারে তিনি হুঁশিয়ার।
কে যেন ফুট কাটল, জাতে মাতাল তালে ঠিক।
তবুও মেয়েদের মধ্যে হালকা ভয় একটা ছিল। দিলীপ ব্যাগ খুলে একটা কাশির সিরাপের ছোটো শিশি বের করে পকেটে রেখে দিল। ওই কাশির সিরাপের শিশিতেই সুগন্ধী কারণবারি রাখতেন। সেই বারিতে আচমন করে সঙ্গীত পুজোয় বসতেন মধুদা।
সাইথিয়া পৌঁছে অনুষ্ঠানস্থল যাওয়া পর্যন্ত মধুদা আর ব্যাগের খোঁজ করেননি। ব্যাগ ছিল দিলীপের হাতে। মধুদা ক্যাপটেনের মতো এগিয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেন। ত্রিপল দিয়ে ঘেরা গ্রিণ রুমে বসার ব্যবস্থা হল। আরও অনেক শিল্পী বসে আছেন। স্টেশনের কাছেই বড় মাঠে মঞ্চ বেঁধে সাতদিন ধরে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করত মেঘদূত ক্লাব। প্রচুর দর্শক-শ্রোতা।
নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মঞ্চে উঠলাম। চমৎকার অনুষ্ঠান হল। চারদিক থেকে প্রশংসা এলো। এক কর্মকর্তা এসে মধুদার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। পথ খরচা। মধুদা সামান্য কিছু রেখে বাকি টাকা সত্যদার হাতে তুলে দিলেন। মধুদার সংসার চলে গান শিখিয়ে, গান গেয়ে। তিনি পারিশ্রমিকের সামান্য অংশ নিলেন। সত্যদা বললেন, একদিন ফিস্ট হবে। আমরা ফেরার উদ্যোগ করছি। ঠিক সেই সময়ে -– হ্যাঁ, ঠিক সেই সময় এক যুবকের আর্বিভাব। আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরাও বিগলিত। তারপরেই মোক্ষম অস্ত্রটি বের করল তূণ থেকে। যুবকের বাড়ি আন্দি। মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যেই পড়ে। বীরভূমের লাগোয়া গ্রাম। তাদের গ্রামে পরদিন, মানে ২৭শে বৈশাখ প্রভাতী রবীন্দ্র জয়ন্তী। আমাদের যেতে হবে।
দলে তিন কিশোরী, দুই প্রবীণ, দুই যুবক আর মধ্যবয়সী মধুদা। তিনি বললেন সত্যবাবু যা বলবেন। উনি অনুমতি না দিলে যেতে পারব না।
–না, হবে না। সত্যদার সপাট জবাব।
যুবকটি বোঝানোর চেষ্টা করল, সে বড় মুখ করে বেরিয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে শিল্পী ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পথে সাঁইথিয়াতে এই ঢুকে পড়েছে শিল্পীর খোঁজে। আমাদের অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে, এদের শান্তিনিকেতনী বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দল যেতে রাজি নয়। প্রবীণ এবং কিশোরীরা তো নয়ই। এভাবে কি যাওয়া যায়? দিলীপ বলে বসল, আমরা তো খ্যামটার দল নই, যে বায়না করলেই যেতে হবে।
যুবকটি লজ্জিত হল, না, না এসব কি বলছেন। আপনারা না গেলে আমার মাথা কাটা যাবে।
সে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। সত্যদা বললেন, সময় নষ্ট করলে ট্রেন মিস করব।
ছেলেটির মনের ব্যথা টের পেয়ে মধুদা এগিয়ে এলেন, ঠিক আছে, আমরা তিনজন যাবো।
স্থির হলো মধুদা, দিলীপ আর এই উড়নচন্ডী। আমার তো কোনও কিছুরই বালাই নেই। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে ব্যবস্থাতেই অভ্যস্ত। মধুদা অর্থকরী হিসাবটা সেরে নিলেন। কথা হল, অনুষ্ঠানের শেষে নগদ মিটিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ওদের।
–যাবো কীভাবে ?
–চিন্তা করবেন না গাড়ি আছে।
–কোথায় আছে গাড়ি ?
–এই সামনেই আছে।
দলের অন্যদের বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম ছেলেটির সঙ্গে। খালি হাত। পরণের কাপড়ই ভরসা। মধুদার হাতে কালো ব্যাগ। হাঁটছি। হাঁটছি তো হাঁটছি।
–গাড়ি কোথা ভাই? মধুদা প্রশ্ন করে।
–আছে। মৃদু উত্তর দেয় ছেলেটি।
ক্রমশ অন্ধকারের বৃত্তে ঢুকে যাচ্ছি যেন। হাঁটতে হাঁটতে ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর। ব্যারেজের পথ মাড়িয়ে চলেছি।
–আর কতদূর ভাই ?
–ওই তো এসে গেছি।
–তোমার গাড়ি কোথায়? মধুদা একটু ক্ষুব্ধ এবং ক্ষিপ্ত।
অন্ধকারে ছেলেটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিল, আছে।
সে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে। পিছনে আমরা। হাঁটছি, হাঁটছি। যেন অগস্ত যাত্রা। কোনও বিপদে পড়ব না তো ! ভুল হয়ে গেছে খুব ভুল। যুবকটির মতলব বোঝা যাচ্ছে না। অবশেষে – হ্যাঁ, অবশেষে আমাদের পা থামল এক থাবার সামনে। রাস্তার পাশে পঞ্চাশ বছর আগে যেমন হতো, তেমনই ধাবার চেহারা। সারি সারি দড়ির খাটিয়া পাতা। প্রৌঢ় বিহারী ধাবা মালিক একটি খাটিয়ায় শুয়েছিল। ছেলেটি ধাবার ভিতর ঢুকল। মালিক উটে বসে গামছায় বুক ঘসতে ঘসতে জিজ্ঞাসা করল ‘বলিয়ে’ – এবং একই সঙ্গে আমাদের সকলের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিল।
ছেলেটি বলল, আমরা রাতে একটু থাকব। কাল সকালে চলে যাব।
মালিক জিজ্ঞাসা করল, কঁহা যায়েগা?
–আন্দি! ছেলেটির উত্তর।
মালিক আপ্যায়ন করল আমাদের। মধুদা এবার ভীষণ রেগে গেলো। বললেন, আমাদের এসব আগে বলেননি কেন ? বললেন গাড়ি আছে। পৌঁছে রাতে বিশ্রাব নেব। আমাদের সঙ্গে চিটিং করলেন? ছিঃ ছিঃ।
আমরা নিশ্চুপ। ছেলেটি কাকুতি মিনতি করল, আমার উপায় ছিল না দাদা। সত্যি কথা বললে কেউ আসবে না। প্রত্যেকবার চেষ্টা করি, কেউ আসতে চায় না। হ্যাঁ, মিথ্যে বলেছি, এছাড়া আমার উপায় ছিল না। এবারেও কাউকে না নিয়ে যেতে পারলে মাথা কাটা যাবে।
মধুদা আর কিছু বললেন না। গম্ভীর হয়ে রইলেন। ধাবার মালিক এক ছোকরা কর্মচারীকে ডেকে হাত-মুখ ধোয়ার জল দিতে বললেন। তারপর রুটি, সবজি উদরস্থ করে এক গেলাস এলাইচি চা পান করে খাটিয়ায় দেহ রাখা গেল মচ্ছরদের বোনভোজনের জন্য। শুধুই দেহ রাখা। ভারী ভারী ট্রাক আসছে দাঁড়াচ্ছে। পানীয় সহযোগে মাংস রুটি সেঁটে আবার বেরুচ্ছে। ফলে চোখ জুড়লেও ঘুম নামক বস্তুটা কাছে আসতে বড্ড ভয় পাচ্ছিল। মনে মনে গানের কলি, ‘কখন ভোর হয় হয়, কখন সূর্য ওঠে।
অবশেষে কালো পর্দা সরল আকাশের। ভোরের সূর্য সদ্য চোখ মেলেছে। আমরা তৈরি হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, গাড়ি কোথায়?
–আসবে।
দিলীপ মন্তব্য করল, গরুর গাড়ি আসবে।
গাড়ি নামক এক ঈশ্বরবাবুর অপেক্ষায় আমরা তিন শিল্পী। ছদ্ম পরিচয়ে শান্তিনিকেতনের।
অবশেষে মুখ দেখা গেল গাড়ির। একটি বাস। যুবক বল, ওই আসছে। বুঝলাম, পড়েছি যবনের হাতে। আরো কী আছে কপালে কে জানে !
বাস থামল। এই কাকভোরে একটু পাতলাই ছিল ভিতরটা। আসন পাওয়া গেল বসার। ঘন্টা দেড়েক বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে নামলাম আন্দি গ্রামে। যুবককে জিজ্ঞাসা করলাম, আন্দি কি কান্দির কাছে?
–তা বলতে পারো। বলে সে হাঁটতে শুরু করল। আমরাও তার পিছনে। গ্রাম তখন ঘুম ভেঙে বিচানায় আড়মোড়া ভাঙছে। তিন জনকে তিনটি বাড়িতে গেঁথে দেওয়া হল। যে বাড়িতে ঠাঁয় পেলাম, গৃহকর্ত্রীর আতিথ্য মনে রাখার মতো। পাকা দোতলা বাড়ি। সমস্ত রকম শহুরে সুবিধা, যা পাওয়া যেতো সেই সময় – সব ব্যবস্থা ছিল। জানা গেল গৃহকর্তা কলকাতায় সরকারী চাকুরে। কর্ত্রী তার দুই পুত্র-কন্যা নিয়ে থাকেন। তিনি একটি নতুন গামছা হাতে ধরিয়ে আসনখানা দেখিয়ে দিলেন পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য। আমি তৎক্ষণাৎ সময়ের সদ্ব্যবহার করলাম। একটি ছোট ঘরে তক্তাপোষের ওপর পাতা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। গৃহকর্ত্রী বললেন, একটু বিশ্রাম নিন। ফাংসান সেই দশটায়। আমি একটু রান্নাঘরে যাই।
মার্জিত ব্যবহার ভদ্রমহিলার। চেহারায় শহুরে ছাপ আছে। বয়স মধ্যযৌবনের কাছাকাছি গিয়ে থমকে গেছে বলে অনুমিত হয়।
কিছুসময় পরেই তিনি জলখাবার নিয়ে এলেন। লুচি, আলুর তরকারি। গলাধঃকরণ করলাম পরম তৃপ্তিতে। আবার অপেক্ষা। হাতের ঘড়ি পকেটে রেখেছিলাম রাতে। এখন আবার হাতের কব্জিতে। মাঝে মাঝেই চোখ যাচ্ছে সেদিকে। ন’টার একটু পরেই এক তরুণ এলো আমায় নিয়ে যেতে। গৃহকর্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হলাম। প্রাথমিক স্কুলের মাঠ। চৌকি পেতে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের সামনে কাগজ আর গোলা দিয়ে অপূর্ব শিল্পকর্ম। মঞ্চসজ্জা ও পরিবেশ দেখতে দেখতে মনের ভিতর ঘাপটে বসে থাকা ক্ষোভ সরে গিয়ে শান্তিপুরি ফিনফিনে ধুতির মতো বৈশাখী বাতাস দোলা দিয়ে গেল। মঞ্চের সামনে ত্রেপল বিছানো, তারপর গুটি কয়েক কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। মঞ্চের পাশেও কয়েকটা চেয়ার পাতা। বেশ কয়েকবছর আগেও অনুষ্ঠান বাড়িতে এরকম চেয়ার দেখা যেতো। এখন প্রায় অবলুপ্ত। আমাদের মঞ্চের পাশের চেয়ারে বসানো হলো।
শঙ্খধ্বনি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। ঘোষণায় এক তরুণী। সম্ভবত কোনও ইস্কুলের দিদিমণি। সকাল দশটা। বৈশাখ তার রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। সূর্যদেব হাতে নিয়ে নিয়েছে শাসনদন্ড। এক বালিকা শুরু করল গ্রাম্য উচ্চারণে ‘আজি জোস্না আতে সবাই গ্যাসে বোনে’। গান শেষে তার একমুখ হাসি দেখে হৃদয় জুড়িয়ে গেল। তারপর কচি-কাঁচাদের গান-নাচ-আবৃত্তি। যেমন হয় আর কি। তারপর আবার ‘স্যাদিন দু’জনে দুল্যেছিনু বোনে-এ-এ’। হারমোনিয়ামের রীড টিপছিল কিশোরী, কিন্তু হারমোনিয়াম থেকে যে সুর বেরোচ্ছিল তা কিছুতেই কণ্ঠের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছিল না। আর রবীন্দ্রকৃত সুরের শাসন তো মানেই নি। এমনি বেয়াদপ। তবুও এই সাধু প্রচেষ্টার জন্য ক্ষুদে শিল্পীদের সৌজন্যমূলক অভিনন্দন জানাতেই হল। এতো দূরে এক অজ্ঞাত গ্রামে সংস্কৃতি, বিশেষ করে রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চার তো কম সাধুবাদ যোগ্য নয়। যা হোক, এরপরেই ছদ্মবেশি শান্তিনিকেতনী আমাদের অনুষ্ঠান। মদুদা সুধা ঢেলে গাইলেন খান পাঁচেক গান, দিলীপের হারমোনিকা অর্থাৎ মাউথ-অর্গানে এবং এই অধম উড়নচণ্ডীর খান তিনেক করে রবীন্দ্রসুর ও আবৃত্তি পরিবেশনের পর স্বস্তি গেলাম।
এবার ফেরার পালা। এর মধ্যে দুটি করে খাস্তা বিস্কুট সহ এক ভাঁড় করে চা পান হয়ে গিয়েছে। মধুদা, সেই আয়োজক যুবককে গিয়ে কিছু বলতেই সে মধুদার হাতে অর্থ ধরিয়ে দিল। মধুদা গুনে পকেটে রেখে কিছু বলতেই লজ্জিত মুখে হাত চেপে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করল যুবকটি। মধুদা বিরস বদনে এসে বলল, চলো।
ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে ছেলেটির সাথে। জেনেছি, সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কবিতা লেখে, লিটল ম্যাগাজিন করে। গ্রামে বেশ নাম ডাক আছে। ভাবলাম এমন ছেলে রবীন্দ্র জয়ন্তী করবে না তো কে করবে ? আর যিনি ঘোষণা করছেন, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা, তার সঙ্গে যুবকের মধুর-মধুর সম্পর্ক। ভাবলাম কবি প্রেম করবে না তো কে করবে ? বেশ করছে প্রেম করেছে। কিন্তু প্রেমিকা আর গ্রামবাসীদের দেখাতে গিয়ে এবার প্যাঁচে পড়ে গেছে। বলেছিল শান্তিনিকেতন থেকে শিল্পী আনবে। এজন্য গ্রামের ছেলেরা অনুদানও সংগ্রহ করেছিল গ্রামবাসীদের কাছ থেকে। কিন্তু মাঝ পথ থেকে আমাদের ইলোপ করে নিয়ে এলো। গ্রামের মানুষ তো আর শান্তিনিকেতন আর আমোদপুরের তফাৎ বোঝে না। থাক, তবুও তো করছে।
কিছুটা হেঁটে এসে বাস ধরে সাঁইথিয়া। সেখান থেকে ট্রেন ধরে আমোদপুর। ট্রেনের ভিতর পকেটে কিছু গুঁজে দিলেন মধুদা। সেটাই তখন বেকার জীবনের ওয়েসিস হয়ে রইল। কার্তিকদার দোকানে কাঁদি চা প্যাঁদানো যাবে।
(ক্রমশ)