উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

অশান্ত দিনের ছিন্নপত্র
অনেকদিন পর স্মৃতির শহরে পা দিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবিরত চেনামুখগুলো কোথাও ধূসর, কোথাও ছায়া ভেঙে সামনে চলে আসে। কখনও আবার কোনও প্রাচীন ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তারপর দন্তবিহীন মাড়ি ছাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, কীরে, কেমন আছিস? কবে এলি?
তখন তার ঘোলাটে চোখ চকচক করে ওঠে। বেরিয়ে আসতে চায় দ্যুতি। ছুটোছুটি করতে চায় সামনে ছড়িয়ে থাকা সবুজ মাঠের উপর।
তাকিয়ে থাকি আমিও। উত্তর দিই, ভাল। কাল এসেছি। তুমি কেমন আছো?
–এই আছি। তোর ঘরের খবর কী? সব ভালো তো?
কুশল সংবাদ বিনিময় চলছে, আর আমি ভিতরে ভিতরে হাতড়ে চলেছি নাম। এই প্রাচীনের নামটা মনে করতে পারছি না। প্রাচীনত্ব কিছুক্ষণ দম ধরে বসে রইল। তারপর পেনাল্টি কিক মারার মতো শব্দ ছিটকে দেয়, ‘মনাটা মরে গেল’। কোনও আবেগ নেই। দুঃখ নেই, শুধু সংবাদ। সেই ছিটকে আসা শব্দ দু’হাতে লুফে নিয়ে বললাম, ও তো আলাদা বাড়ি করেছিল।
–বড়দাকে মনে আছে? সুনীল দা? সেও মারা গেছে।
–শুনেছি।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে নামটা ভেসে উঠল – নীরজদা। ভাল ফুটবল খেলত। শহরে প্রথম ডিভিসনে খেলত। কাজ করতো কারখানায়। খেলা, কাজ আর সংসার নিয়েই ছিল তার যাপন। এখন এই প্রাচীন বয়সে বাড়ির সামনে একটা গুমটি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকে। নিজের উত্তরে কথা বলতে বলতে দিন গোনে জীবন অবশেষের।
এগিয়ে চলি। চেনা মুখের ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। অচেনা তরুণ মুখের মিছিল। স্বাভাবিক। এটাই তো হওয়ার কথা। তারই মাঝে কালের সাক্ষী হয়ে কেউ কেউ বয়ে যায়। আর রয়ে যায় বলেই এই নতুনের হাটেও তারা সমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
এই ভাবনা মেনে নিতে নিতে স্মৃতির পথ ধরে হাঁটি। জীবনের নুড়ি পাথর বিছানো পথে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ যায় সামনের দিকে। ঢোলা পা-জামা, লম্বা পাঞ্জাবির, গোঁফ-দাড়ি আচ্ছাদিত এক মৌলবি এগিয়ে আসছে। মাথায় টুপি। হাঁটার ছন্দ পরিচিত। যত কাছে আসছে তত আগল খুলছে। মুখোমুখি হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। হজ।
প্রত্যুত্তর না দিয়েই জড়িয়ে ধরল। কতদিন পর দেখা। কেমন আছো? তোমার সব খবরই পাই
-তুমি কেমন হজ? তোমার দোকান?
-আছে, দোকান আছে। এখন কিতাব গড়াই।
-কবিতা লিখছ?
-লিখছি। সব পত্রপত্রিকায়। এবার একটা বই করবো ভাবছি। ক’দিন আছো?
-আছি, দিন তিনেক।
-বিকেলে দোকানে এসো। গল্প করা যাবে। শুনেছ মালি মারা গেছে?
-তাই নাকি? কবে? কোথায় মারা গেল?
-তা মাস ছয়েক হয়ে গেল। ওপারেই মরেছে। মরার আগে একবার এলো।
মালি – সেই মালি। সবসময় ছিল হজরতে জিগরি দোস্ত। পরে ঘোর শত্রু। আরও পরে সহজ সম্পর্ক। মালি ছিল হজরতের ইস্কুলের বন্ধু। পাড়ারও বন্ধু। ওদের একটা দল ছিল। যতরকমের বদবুদ্ধি ওদের মাথায় ঘুরতো। তবে সকলেই যে সমান ছিল এমন নয়। যেমন মালি ছিল মারামারিতে ওস্তাদ। দুবলা-পাতলা দেহ নিয়েই ক্ষিপ্র গতিতে আক্রমণ করত। ভাল লাঠি চালাতে শিখেছিল ওই বয়সেই। আবার হজ ছিল শান্ত প্রকৃতির। সে বুদ্ধি জোগাতো। স্কুলে হজ বেশ ভালই ফল করত। মালি ততটা নয়। অনেক সময় ঘষটে ঘষটে পাশ করত। দুজনেই পড়ত মিশনারি স্কুলে। ইস্কুলে কিন্তু কোনও খারাপ কাজের কোনও নিদর্শন ছিল না। বরং কিছুটা আড়ালেই থাকত তারা, অন্য অনেকের মতো। তা, হজর চোখ একদিন কানা হয়ে গেল। হয় সেই মালির জন্যই।
ওরা আমবাগানে ঢুকে গাছে লক্ষ্যভেদ করছি একটা ধারাল চাকু নিয়ে। এটা নতুন খেলা। সেদিনই শুরু করেছিল। গাছে একটা দাগ কেটে দূর থেকে ছুড়ি ছুঁড়তে হবে, গাছের গুঁড়িতে দাগ দেওয়া জায়গায় বিধঁতে হবে। মোটা আমগাছের গোড়া ছিল বেশ শক্ত। সকলেই ছোঁড়ে, ছুরি পড়ে যায়। গাছে আর বেঁধে না। হজ দু বার ব্যর্থ হওয়ার পর, তৃতীয় বারে গাছের অনেকটা কাছে গিয়ে চাকু ছুঁড়লো। চাকুটা গাছে না বিঁধে, ধাক্কা মেরে উল্টো হয়ে ফিরে এলো। কেউ কিছু বোঝার আগেই চাকুর ফলাটা হজর কে চোখে বিঁধে মাটিতে পড়ে গেল। রক্ত পড়তে লাগল নজর হজর চোখ থেকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা। সঙ্গে সঙ্গে, সদর হাসপাতাল। চোখে ব্যান্ডেজ। ওষুধ, ইনজেকসন। বাড়িতে পড়ে রইল বেশ কিছুদিন। সব দোষটা পড়ল মালির ঘাড়ে। কারণ সেই ছিল পালের গোদা। হজ কারোকে দোষ দিল না। কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা মালিকে কাঠগড়ায় তুলল। মালি ভয়ে কোথায় গা-ঢাকা দিল।
প্রায় মাস দেড়েক পরে হজ স্কুলে গেল। একটা চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেল। আরও ভাল চিকিৎসার পয়সা তাদের ছিল না। বাপ ছিল দিনমজুর। তখনকার দিনে কতই বা রোজগার। আর শহরে তখন ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে হজকে একচক্ষু হয়েই দিনযাপন করতে হল।
হজ স্কুলে যায়। মালি যায় না। ক্লাশ এইট পাশ করে নাইনে পড়তে পড়তেই তো ঘটনাটা ঘটল। মালি সেই এইটের বিদ্যে নিয়েই ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু কোথায় ঘোরে, কি করে কেউ জানে না। ওরা, মানে মালির দাদা-বৌদি খুবই বিরক্ত। বাবা নেই। মা একটু বেশিই ভালবাসে তাকে। এই নিয়ে বাড়িতে ঝগড়াও হয়। ক্রমশ মারামারিতে তার নাম ছড়ালো। লোকের মুখে সে ‘চেন মালি’। সাইকেলের চেন পকেটে নিয়ে ঘুরত, আর অদ্ভুত কায়দায় শিকারিকে আক্রমণ করে ক্ষত-বিক্ষত করত। তারপর অদৃশ্য হয়ে যেত। কেন মারত, কে মারতে বলতো, কেউ জানে না। শুধু সেই জানতো। দু-একবার ওদের পাড়ায় পুলিশ এসেছে। কিন্তু ধরতে পারেনি। কিন্তু ধরা সে পড়ল। একবার দল নিয়ে একজনকে মারার অভিযোগে পুলিশ খুঁজে বেড়াতে লাগল। এক রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। প্রায় বছর খানেক শ্রীঘরে কাটিয়ে ফিরে এলো জামিন পেয়ে। আদালতে হাজিরা দেয়। একদিন খালাসও হয়ে যায়। এখন আগের মতো আর ততটা দুরন্ত নয়, একটু শান্ত প্রকৃতির হয়ে গেছিল। তবুও নাম হয়ে গেল মাস্তান মালি। ওই নামেই সাজ চলত ওর চরিত্রটা ছিল অন্য রকম। বিড়ি ছাড়া অন্য কোনো নেশা ছিল না। তোলা তুলতো না। তবে কেউ অন্যায় করলে ছেড়ে দিত না।
সত্তর দশকের শুরুতেই (অবশ্যই গত শতাব্দীর), যখন খতম অভিযানে ফতোয়া জারি হয়ে গিয়েছে, মালি নকশালবাড়ি, আন্দোলনের সাথী হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে ফাঁকা পাঁচিলে অথবা চুনকাম করা দেওয়ালে মালি শ্লোগান লিখত। হাতের লেখা ছিল চমৎকার। ব্রাশও টানত সুন্দর। কোথায় শিখেছিল কে জানে! দেওয়ালে-দেওয়ালে মালির লেখা – কখনো কালো, কখনো লাল রঙে।
- সত্তর দশক মুক্তির দশক।
- আমার বাড়ি তোমার বাড়ি খড়িবাড়ি নকশালবাড়ি।
অথবা বা দালাল খতম হয়েছে, তার খবর নিয়ে বিপ্লবী জনগণকে অভিনন্দন। দিনের বেলায় কোনও গোপনঘরে বোমা বাঁধার কাজ চলত। মালি নিপুণ হাতে বোমা বাঁধত। কী করে শিখেছিল কে জানে! তবে ও কখনো অ্যাকশানে থাকত না। আড়ালেই থাকত। পার্টিই তাকে আড়ালে রেখে ছিল।
এত সাবধানে থাকার পরেও ওর নাম পুলিশের খাতায় উঠে গেল। পুলিশের চর তো কম ছিল না! কোন হারামজাদা ওর নাম পুলিশের কাছে তুলেছিল। মালি তখন ঘর ছাড়া। প্রতি রাতে আশ্রয় পাল্টাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় মসজিদের মধ্যেই থাকত।
এদিকে বাংলাদেশে মানে পুব পাকিস্তানে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। শহর ছেয়ে আছে সেনাবাহিনীতে। মিলিটারির গাড়ি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে রাজপথ থেকে গ্রামপথ। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে মালি উধাও হয়ে গেল। গেল তো গেলই!
শহরের পরিস্থিতি ক্রমশ ঘনকালো মেঘে ছেয়ে গেছে। একদিকে সেনাবাহিনীর দাপাদাপি, পুব পাকিস্তান থেকে কয়েক লাখ শরণার্থী সীমান্ত এলাকায়। শহরেও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঠাঁয় নিয়েছে অনেক। অন্যদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের তীব্রতা। তীব্রতা বলতে মিটিং, মিছিল, সমাবেশ নয় – শুধু খতম অভিযান। এই প্রতিবেশে বোমার আঘাতে খুন হয়ে গেল দুজন সেনা। কার উর্বর মস্তিস্কে এই পরিকল্পনা বাসা বেঁধেছিল, কে জানে! এলাকা জুড়ে পুলিশ আর সেনার যৌথ অভিযানে মানুষের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। চিরুণি তল্লাশি চলছে পাড়ায় পাড়ায়। দিনে-রাতে। যখন-তখন। তখনও মালিকে পাওয়া গেল না। পুলিশের চোখে সে মারাত্মক ক্রিমিনাল। তার মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছে। জ্যান্ত ধরে দিতে পারলেই পুরষ্কার। মাঝে মাঝেই মনে হয়, কে যে এসব মাথার দাম ধরে! যারা দেশের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে পালাচ্ছে, দেশের বেকার ছেলে-মেয়েদের টাকা চুরি করে বিদেশের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখছে, সরকার তো তাদের মাথার দাম ধরে না। আর মালিতো খুনও করেনি। বোমাও মারেনি। ডাকাতিও করেনি, রাষ্ট্রের সম্পদের ক্ষতি করেনি। তাহলে তার মাথার দাম ধরতে হবে কেন? জানা গেল, পুলিশের খাতায় মালিই হচ্ছে সমস্ত অপারেশনের মাথা। তার পরিকল্পনাতেই একের পর এক খতম অভিযান চলছে। তাই তার মাথা চাই। কিন্তু খবরটা – এই সাংঘাতিক খবরটা দিল কে? খোঁজ খোঁজ। এরকম সময়েই জানা গেল, আমাদের পাড়ার এক সরকারি কর্মচারী দাদা উধাও। উধাও মানে তড়িঘড়ি বদলি নিয়ে বাইরে চলে গেছে। রটে গেল তিনিই নাকি এলাকার নকশালকর্মীদের ধরিয়ে দিয়েছেন। আসলে তিনি ছিলেন তীব্র নকশাল বিদ্বেষী এবং পুলিশের চর। মালি সম্পর্কে ভুল এবং বিভ্রান্তির তথ্য পুলিশকে নাকি তিনিই দিয়েছিলেন। অথচ মালিকে তিনি চিনতে বলে মনে হয় না। চেনার কথাও নয়।
সেই মালি ফিরে এলো। এক রাতে। বাংলার এপার কিছুটা শান্ত, ওপারে চলছে নতুন করে গড়ে নেওয়ার পালা। পুনর্গঠিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। মানুষ মুক্তি বাহিনীর কীর্তিকল্প, রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা আর ভারতীয় সেনাদের বীরত্ব কিংবা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বিশ্বদৌত্য নিয়ে যখন জাবর কাটছে, সেই সময়, এক রাতে – যখন রাত গড়াগড়ি দিচ্ছে ঘুমুনোর জন্য, সেই সময় জানালার ধারে ডাক। কৌতূহলী চোখ জানলায় রাখতেই দেখি সবুজ গাড়িতে ঘোমটা মাথায় এক নারী। হেরিকেনটা তুলে জানলায় রাখতে সেই ফ্যাসফ্যাসে স্বর, বাইরে আয়।
মালি! আনন্দ এবং বিস্ময়ে তখন ভাসছি। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সদর খুলে রাস্তায়।
-তুই?
জড়িয়ে ধরল সে। – কবে এলি?
-দিন চারেক। আবার চলে যাব।
শুনলাম এখনও পুলিশ তাকে খুঁজছে। সে পুব-পাকিস্তানে চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সে এখন ভাসানিপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি করে। স্বপ্ন একদিন বাংলাদেশও কম্যুনিস্টদের দখলে চলে যাবে। জীবিকা? চাষ করে। পৈত্রিক সূত্রের কিছু জমি পেয়েছে। তাতেই ফসল ফলায়।
প্রস্তাব দিল এখানে কি করবি? চল আমার সঙ্গে। একটা হিল্লে হয়ে যাবে, বললাম সম্ভব নয়।
মালি কিছুটা ক্ষুব্ধ। জিজ্ঞাসা করল আবার, তাহলে যাবি না?
-না।
-তুই না গেলে আমি তো জোর করতে পারি না। তবে এখানে তোর কিছু হবে না। পিঠে স্ট্যাম্প পড়ে গেছে তোর। চাকরি-বাকরি হবে না তাই বলছিলাম। দেখ কি করবি!
বললাম না, ভাই হবে না। শহিদ যদি হতে হয়, এখানেই হব। চলে গেল। কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই চলে গেল। সেই মালি – একদা ডাকাবুকো, মারপিটে মাস্তান, একটা আদর্শ আঁকড়ে ধরে ঘূর্ণিঝড়ের মতো ছুটে বেড়ানো; একটা স্বপ্নের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মালি – ক্রমশ অন্ধকার, আরও অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অপসৃয়মান হল।
সেই শেষ দেখা। তারপর, কত বছর পর হজরতের কাছে খবর পেলাম – মালি নেই। মনের ভিতর একটা মুঠোবদ্ধ হাত যেন উঠে গেল – লাল সেলাম।
(ক্রমশ)