অক্সিজেন। পর্ব ৩৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

অভিসারিকা

ঘরে কেউ নেই। দরজা ভেজিয়ে হলুদ সালোয়ার কামিজটা পরে নিল কুহু। এটা পরলে ওকে বেশ দেখায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে কেমন গা শিরশির করছিল ওর। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল, “হঠাৎ কী হল? এত সাজের ধুম!”

আবার মন দিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে ছোট টিপের পাতাটা খুঁজতে শুরু করল ও। অনেকদিন বাদে ওর টিপের দরকার পড়েছে। এখুনি খুঁজে পেলে হয়।

সাদা শার্ট পরা ওই ছেলেটা বড্ড জ্বালাতন করছে। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি এখন বাড়িতে শুয়ে আছেন। আর কুহুকে ওদের বাড়িতে যাবার জন্য ডাকাডাকি করছেন। এখন তো ও মোটামুটি সুস্থ।কুহু গিয়ে কী করবে?

এসব কুহুর ঠিক ধাতে পোষায় না। দুর্ঘটনাটা হবার পর কুহু ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে ঠিকমত চিকিৎসায় ও বেঁচে ফিরেছে। এটা খুব ভাল কথা।কুহু ওর জন্য তখন প্রার্থনাও করেছে।তবে সে ব্যাপারটা নিয়ে ওদের বাড়িশুদ্ধু লোকের এত হই চই করে ওকে সারাক্ষণ কৃতজ্ঞতা জানানোর কী আছে, কুহু বোঝেনা। পিন্টুকে পড়াতে গেলে অস্বস্তি এমনিতেই হত। ওর মা নিত্যদিন নিত্য নতুন রান্না করে খাওয়াতেন। এখন সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি  এমন হয়েছে যে যেদিন ওদের বাড়ি পড়ানো থাকে, সেদিন মা মুচকি হাসে। বলে, “আজ তাহলে বাড়ি এসে কিছু খাবিনা তো?”

মজাটা এই, মুখে যতই গজ্‌গজ্‌ করুক, কুহু ছেলেটাকে মুখের ওপর না বলতে পারেনি। অথচ আজ একশো আটটা কাজ ছিল ওর। তবুও যেতে হচ্ছে। এমন কী ওই ছেলে এত পাজী পিন্টুর মাকে বলেছে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। প্রথমদিন ও একা কী করে যাবে? সেই কথা মত পিন্টুর মা আজ গাড়ি নিয়ে আসছেন ।ও যাবে ওনার সঙ্গে।

একবার ভেবেছিল কিছু একটা বাহানা করে না বলে দেবে।কিন্তু শেষ অবধি পেরে ওঠেনি।

এই কিন্তুটাই বড় ভাবাচ্ছে ওকে। বেশ কিছুদিন ধরেই ওই কিন্তুর চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে ও। কিন্তু কেন?আসলে নিজের কাছে নিজের স্বীকার করতেও লজ্জা করছে যে সবমিলিয়ে ওর বেশ ভাল লাগছে। ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।না গেলে অভিমান করে ম্যাসেজ করছে, এই পুরো ব্যাপারটাই কেমন অন্যরকম। খুবই  অচেনা ওর এতদিনের জীবনে।তাই হয়ত ভাল না লেগে পারছে না।তবে এ ভাল লাগাটার সঙ্গে অন্য কোন কিছুরই মিল নেই। যদিও এসব নিয়ে ও কোনকথা কাউকে বলেনি।এমন কী অনুকেও না। আর এখনই কোথাও প্রকাশ করতেও চায়না।আরো কয়েকটা দিন যাক। জুহুকে একবার বলেছিল, “কী করি বলতো?”

ও এত মিচকে, বলল, “ থোড়া আগে বাড়ো ইয়ার, দেখো, হোতা হ্যায় কেয়া।” কোথা থেকে যে এত হিন্দী শিখছে ও।

সেদিন একটা মজার কান্ড হয়েছে। নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফেরার পর ওই সাদা শার্টের বাড়িতে যাবার কোন ইচ্ছে ওর ছিলনা। বাপ্‌ রে, ওরা  ভীষণ বড়লোক! ওখানে ওকে একদম মানাবে না। এসবই ভাবছিল। একদিন ঠিক সন্ধেবেলা একটা ফোন এলো। ও একটু তাড়ার মধ্যে ছিল। ফোনের মহিলা বললেন, “আমি বিলুর মা। মানে আমি পিন্টুর বড়মাসি।”

গলাটা কেমন ভরাট আর সুরেলা। থেমে থেমে কথা বলেন। সেই গলাতেই উনি বললেন, “তুমি কুহু তো?”

ও ঘাবড়ে গেছিল বেশ। তারপরের কথাটা ছিল আরো ভয়ানক, “তুমি আমাদের বাড়িতে আসতে চাইছ না কেন?আমার ছেলে বিলু এখন অনেকটা সুস্থ,তবে বাইরে বেরোতে পারছে না। আমি জানি ও তোমার খোঁজ করছে। বারবার ফোন করে ডাকছে।বুঝেছি, কোনদিন আসোনি বলেই সঙ্কোচ হচ্ছে। আমার বোন, মানে পিন্টুর মায়ের সঙ্গেই নাহয় চলে এসো একদিন।”

লজ্জা পেয়ে ও তাড়াতাড়ি বলেছিল, “অত করে বলতে হবেনা মাসিমা।আপনি ডাকছেন যখন, নিশ্চয়ই যাব।”

সেই যাওয়াটা এখনও অবধি হয়ে ওঠেনি। আসলে ওর এতরকমের ঝামেলা চলছে, এসব সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য ও সময় দিতে পারছে না।পিজিপিটির ক্লাস শুরু হলেই ওখানকার হস্টেলে চলে যেতে হবে ওকে।তাই বাড়িতে অনেক ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।নাহলে মার পক্ষে দু’দুটো রুগীকে সামলানো সম্ভব নয়।তবে মা কয়েকদিনের মধ্যেই রিটায়ার করছে।তাই বাড়িতেই থাকতে পারবে।

এদিকে মীরা কাকীমারা ছেলের কাছে বিদেশে যাওয়ায় বাড়ির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটু অসুবিধা হয়ে গিয়েছে। ওরা সারাক্ষণ খেয়াল রাখে তো।এখন কম করেও দু’তিন মাসের ধাক্কা। শক্তিদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারল,সামনের একটা অভিযানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওর নাম নমিনেটেড হয়েছে। পুরোটাই হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়।

ও যদিও জানে শক্তিদার জন্যই ওর নাম এসেছে,তবু ধন্যবাদ দিতে যায়নি।শক্তিদা এসব পছন্দ করেনা।

এরমধ্যে আবার বাচ্চুর মার পা ভেঙেছে। ওরা সবাই মিলে একদিন দেখতে গেছিল ওর মাকে। সেখানেই বাচ্চু মজা করছিল ওকে নিয়ে।

“কিরে রাজপুত্তুর কী বলছে? প্রাণ বাঁচালি কিছু পাবিনা?না কি পরাণভোমরার কৌটো তোর হাতে তুলে দিয়েছে?”

ও সাড়াশব্দ দেয়নি। ভয় পাচ্ছিল শুধু। বাচ্চু কি কিছু টের পেয়েছে? তাই ও ছদ্ম রাগ দেখিয়ে থামিয়ে দিয়েছে ওকে।

খালি একটা ভয় ওকে মাঝেমাঝে গ্রাস করে । নানাদিকে মন ছড়ালে ও ওর অভীষ্টে পৌঁছতে পারবে তো?

এভারেস্টে যাওয়ার আগে কোন দিকেই মন দেওয়া ঠিক নয়। যদিও জুহুর সঙ্গে এ ব্যাপারে ওর একটুও আলোচনা হয়নি।

কিছুদিন ধরেই মনস্থির করে ফেলেছে ও। ওকে নিজের কাজের ব্যাপারে  সিরিয়াস থাকতেই হবে। খুব শিঘ্রী একবার শক্তিদার বলা সেই মহিলা, মানে মৈত্রেয়ীদির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। উনি এভারেস্টে উঠতে না পারলেও ওই পথে গিয়েছিলেন। ফিরে আসতে হল কেন? ওনার অভিজ্ঞতাটা জানা জরুরী।

তবে আজকের দিনটা শুধু ওই ছেলেটা, মানে পিন্টুর দাদাভাই ওই বিলুর জন্য থাক। তাই ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কপালে একটা ছোট্ট টিপ পরছিল কুহু।পরতে পরতে ভাবছিল, মার নজরে না পড়ে।তাহলে অবাক হয়ে ভাববে, বিয়েবাড়িতে একটা টিপ পরতে যাকে অত সাধ্য সাধনা করতে হয়, সে হঠাৎ নিজে নিজেই টিপ পরছে কেন?

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৩৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *