উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩০। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
এরপরেই পেশা পরিবর্তন করে ফেললাম। যোগ দিলাম একটা কোচিং সেন্টারে। দুবেলা ছাত্র পড়াই। এরকম সময়েই আমাদের এলাকার কয়েকজন তরুণ কবি একটি সভা ডাকলেন। উদ্দেশ্য, পত্রিকা বের করা। আমি আর স্নেহাশিষ গেলাম। স্নেহাশিষ তখন ঠাকুরপুকুরেই বসবাস করে। ‘বর্ণমালা’ নামে একটা পত্রিকাও বের করছে। ওর কথা আগেই বলেছি। সত্তরের কবি, আমাদের কৃষ্ণনগরের বন্ধু স্নেহাশিস সুকুল। প্রথম দিন নানা কথা হলো। কবিতা পড়া হলো। দ্বিতীয় বৈঠকে বাধল গোল। এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্রস্তাব দিলেন শুধু কবিতা লিখলেই হবে না। সমাজসেবা করতে হবে। সেটাও লেখকদের কাজ। কেমন সমাজসেবা? তিনি বললেন, পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। পুকুরের পানা পরিষ্কার করা, আগাছা পরিষ্কার করা – এসব করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকলেই ভালো কবিতা লেখা যাবে।
ভদ্রলোক স্নেহাশিষ সপাটে প্রশ্ন করল। পানা পরিষ্কার করতে হলে সেটাই করুক। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের কী হবে? যেজন্য আমার আসা?
স্নেহাশিষকে সমর্থন করল তরুণরা। ভেস্তে গেল সভা। কিন্তু তারপরেই দুএকজন অতি তরুণ কবি পত্রিকা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করলাম। প্রকাশিত হলো ‘অন্তরীক্ষ’। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত অর্ধেন্দুদা প্রসঙ্গেই থাকি।
পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা বেরোনোর পর বিভিন্ন পত্রিকা দপ্তরের আলোচনার জন্য দিয়ে আসছিলাম। একদিন গেলাম ‘আজকাল’ পত্রিকায়। দপ্তরে পত্রিকা দিয়ে বেরোবার সময় মনে হল নিউজ রুমটা ঘুরে যাই। অনেকদিন আসিনি। তখন রাজা রামমোহন সরণীতে লাহা বাড়িতে পত্রিকার অফিস। এখনকার মতো এত নিরাপত্তার বেষ্টনী ছিল না। ছিল খোলামেলা আবহাওয়া। আর একদা সংবাদকর্মী হিসাবে পরিচিত হওয়ায় অনেকেই ছিলেন বন্ধু স্থানীয়। ওখানে পেয়ে গেলাম পিনাকী রায়কে। ক্রাইম রিপোর্টার হিসাবে বেশ নাম করেছিল। খোঁজ করলাম মৃদুল দাশগুপ্তর। পেলাম না। বোধহয় সে বাইরে ছিল। পিনাকীর সঙ্গে কথা হল। পরদিন সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে আহ্বান জানানো হল। বেরোবার মুখে দেখা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রচুর কবিতা লিখছে তখন সে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষন আড্ডা মেরে সেদিন ফিরে এলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় পিনাকীর সঙ্গে বসেছি প্রেস ক্লাবে। আমার সঙ্গে ‘অন্তরীক্ষে’র অন্যতম কর্মী, তরুণ কবি অনির্বাণ ঘোষ। প্রেস ক্লাবে তো আর চায়ের গেলাস নিয়ে আড্ডা দেবে না পিনাকী, ফলে দুটো গ্লাসে দুজনের পছন্দের পানীয় নিয়ে বসা গেল। অনির্বাণ বোধ হয় লজ্জায় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় নিল। জানা বিষয়, কিছু অতীতের বিষয়, কিছু সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা নিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছি, ঠিক সেই সময় দরজায় অর্ধেন্দুদার সঙ্গে মিহির আর বিশ্বজিৎ রায়। মিহির অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। অর্ধেন্দুদাকে দেখে উঠে গেলাম। একগাল হেসে বললেন, তোমার খবর কী?
অর্ধেন্দুদার হাতে পত্রিকার একটা সংখ্যা দিলাম। হাতে নিয়ে বললেন, এটা বের করছো? বেশ করছো। কবিতা দেব।
বললাম, যোগাযোগ করে নেবো।
মিহির চলে এলো। একটা কার্ড হাতে দিয়ে বলল, মামার জন্মদিন। এখানে হবে। মামার বই বেরোবে। চলে এসো।
বিশ্বজিৎও একগাল হেসে বলল, আসবে কিন্তু।
অর্ধেন্দুদা বললেন, মদ খাচ্ছো, খাও। বিরক্ত করবো না। অনুষ্ঠানে এসো।
তিনি সদলে চলে গেলেন। তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে আবার যোগাযোগ শুরু হল, নিবিড় যোগাযোগ। ততদিনে তিনি রবীন্দ্রনগর থেকে চলে গেছেন ঢাকুরিয়াতে। থাকেন ভাড়ার বাসায়। সেই বাড়িতে শুরু হলো যাতায়াত। শুরু হলো কবিতার আড্ডা। বিভিন্ন কবির জন্মদিন পালন। কবিদের দল তৈরি বা অনুগামী তৈরি নয়, কবিতা লেখক ও কবিতা প্রেমীদের খোলামেলা আড্ডার ভূমি নির্মাণ। ইতিমধ্যে এন এ জব্বার নামে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের সঙ্গে অর্ধেন্দুদার পরিচয় ঘটে গেছে। প্রাবন্ধিক ও বন্ধু জাহিরুল হাসানের মাধ্যমেই এই পরিচয়। পার্ক সার্কাস অঞ্চলে তার বিরাট অফিস। সেখানেই শুরু হলো মাসিক সাহিত্যের আড্ডা। প্রতিমাসের দ্বিতীয় কি চতুর্থ শনিবার বিকালে বসতো সেই আড্ডা। প্রচুর লেখক-লেখিকা আসতেন। সাম্প্রতিক লেখা পাই, গান, আড্ডা, খোশগল্প সবই হতো। আর ছিল জব্বার সাহেবের আপ্যায়ন। আহা কী মধুর! মধুর!
আরও দু-চার বার কথা বলার আগে জব্বার সাহেবের সম্পর্কে কিছু কথা কয়ে নিই।
কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবরুজে বস্ত্রশিল্পের যে বিরাট বাজার, জব্বার হাট নামে যা পরিচিত, সেই বাজারের অন্যতম মালিক ছিলেন এই এম.এ. জব্বার। পেশায় ছিলেন উকিল। হাওড়া আদালতে তিনি আইন ব্যবসা করতেন। আর পার্ক সার্কাসে ছিল বস্ত্র রপ্তানীর ব্যবসা। আদালতে আইনজীবী হিসাবে নথিভুক্ত থাকলেও, আদালতে কখন যেতেন বা আদৌ যেতেন কিনা, কোনও সম্যক ধারণা আমার ছিল না। তবে ব্যবসাটা করতেন মন দিয়ে। তিনি ‘বঙ্গ বসুন্ধরা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন। নিজে গল্প লিখতেন। জাহিরুল হাসান ছিলেন তার বন্ধু স্থানীয়। প্রথম দিকে পত্রিকাটা সম্ভবত জাহিরুলদাই দেখতেন। পরে দায়িত্ব বর্তালো অর্ধেন্দুদার উপর। জব্বার সাহেব ছিলেন অমায়িক মানুষ। আলাপী এবং বন্ধু বৎসল। ওই আড্ডায় যেতে যেতে তার সঙ্গে বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠল। তবে সেই আড্ডা কি কারণে জানি না বেশিদিন চলেনি। বোধহয় বছর তিনেক চলেছিল। তবে পত্রিকা বেরিয়েছিল নিয়মিত। অর্ধেন্দুদা আমৃত্যু নিয়মিত প্রকাশ করে গেছেন। অর্ধেন্দুদা প্রযাত হলে মিহির সরকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেয়। ও বোধহয় দুটি কি তিনটি সংখ্যা বের করতে পেরেছিল। আর পারেনি। জব্বার সাহেব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন তিনি জিভে কর্কটাক্রান্ত। শুনেছিলাম, জিভের অগ্রভাগ নাকি বাদ দিতে হয়েছিল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে এক অনুষ্ঠানে জব্বার সাহেবের সঙ্গে দেখা। কীসের অনুষ্ঠান, কাদের অনুষ্ঠান আজ আর মনে নেই। দেখা হতেই সেই পুরনো আন্তরিকতা নিয়ে কথা বললেন। অনেক কথা। অমলিন হাসি সঙ্গে করে। কিন্তু তার উচ্চারণ দুর্বোধ্য। বেশ ধৈর্য নিয়ে বুঝতে হয়, উত্তর দিতে হয়। আহ্বান জানালেন পার্ক সার্কাসের অফিসে যেতে। যাওয়া হয়নি। কারণ তার কিছুদিন পরেই খবর এলো তিনি নেই হয়ে গেছেন। ‘বঙ্গ বসুন্ধরা’র আরেকটা সংখ্যা প্রেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। আর গেল না।
অর্ধেন্দুদা যে আড্ডা বা বৈঠক শুরু করেছিলেন, সেখানে বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিশেষত তরুণ কবিদের জন্মদিন পালনের রেওয়াজ চালু করেছিলেন। বেশ মনে আছে ব্রতর কথা। কবি ব্রত চক্রবর্তী। এখন প্রায় বিস্মৃত। জীবিত থেকেও যে কোন কবি বিস্মৃত হতে পারেন জানা ছিল না। ব্রত তার অন্যতম উদাহরণ। সত্তর দশকেই ব্রত বেশ পরিচিত হয়েছিল। সে অবরে সবরে কৃষ্ণনগর যেতো দেবদাস আচার্যর বাড়িতে। দেবদাসদা তখন ‘ভাইরাস’ বের করছেন। ভাইরাস নিয়ে তুমুল উত্তেজনা কবিদের মধ্যে। সেখানেই ব্রতর সঙ্গে পরিচয়। বন্ধুত্বের গভীরতা ওর সঙ্গে হয়নি, বোধহয় কারোর সঙ্গেই হয়নি। গত শতকের নয়ের দশকে ব্রত চাকরি করতো ‘আজকাল’ সংবাদ পত্রে। সে ছিল ‘সান্ধ্য আজকাল’-এ। ঠিক হলো ব্রতর জন্মদিন পালন করা হবে। অর্ধেন্দুদা ইতিমধ্যেই ওর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন। কিন্তু ভয়ও ছিল সে আসবে কিনা। কারণ ওর স্বভাবটাই সেরকম ছিল। অর্ধেন্দুদা ভার দিলেন আমাকে। বললেন, সমরেন্দ্রই পারবে ওকে নিয়ে আসতে।
বেলা দুটো নাগাদ চলে গেলাম ‘আজকাল’ অফিসে। সোজা ওর দপ্তরে হাজির। আমাকে দেখেই বলল, ও তুমি এসে গেছো?
বুঝলাম অর্ধেন্দুদা বোধ হয় বলে দিয়েছেন আমি যাবো। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, দাঁড়াও, একটু ঘুরে আসি।
বললাম, তোমার ব্যাগটা আমার হাতে দাও।
ব্রত একটু ভেবে ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট নিয়ে ভিতরে গেল। বুঝলাম ও প্রচ্ছালন ঘরে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলো বেশ পরিষ্কার হয়ে। পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে। বেশ লাগছিল ওকে।
‘আজকাল’ থেকে বেরিয়ে বাসে উঠলাম। বাসভাড়া ব্রতই দিয়ে দিল। গল্প করতে করতে বেশ হৃষ্টচিত্তেই আড্ডায় পৌঁছালো। জব্বার সাহেবের আড্ডাখানায় ওকে দেখে সকলে যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, তাহলে শেষ পর্যন্ত এলো।
ব্রতকে নিয়ে এমন ভাবার কারণ হলো, ওর স্বভাবটাই ছিল ওরকম। কথা দিয়ে কথা না রাখা। অর্ধেন্দুদা বললেন, অন্য কেউ গেলে ওকে আনতে পারতো না। সেজন্যই তোমাকে পাঠিয়েছিলাম।
আসলে আমি তো ওর স্বভাবটা জানতাম। সেও তো ছিল আরেক উড়নচণ্ডী। আর ওর ওই স্বভাবই ওকে ছায়া করে দিল। সত্তরের কবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাবার পরেও সে কেমন হারিয়ে গেল। মাঝে কিছু শারীরিক সমস্যাও হয়েছিল। এখন কিছুটা নির্জনে বাস করছে।
শুধু ব্রত নয়, আরও অনেকেরই জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। কোনও কোনও সময় ভিন প্রদেশী বা বাংলাদেসী কবিরাও এসেছেন এই আসরে। একবার বিখ্যাত উর্দু কবি আলি জাফর পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন কলকাতায়। তাকেও অর্ধেন্দুদা নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গ বসুন্ধরার এই আড্ডায়।
সেই প্রবল আড্ড্যা বন্ধ হয়ে গেল একদিন। বোধহয় অর্ধেন্দুদার শারীরিক অবস্থার অবনতিও তার কারণ হতে পারে। দু-বার তার হৃদযন্ত্রে কাটাছেঁড়া হয়েছিল। মনের দিক থেকে যতই তিনি তরুণ থাকুন, শরীর তো ছেড়ে কথা বলেনি। একদিন পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন অন্যলোকে। পড়ে রইলো তার কবিতার ঘর-সংসার।
(ক্রমশ)