উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২৯। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

1

(গত পর্বের পর)

কবিতার ডাকপিওন অর্ধেন্দু এবং অন্যান্যরা

কীভাবে বলি বলুন তো? কোন শব্দ বাঁধব তাকে? মাত্র ষোলো বছর বয়সে যাকে রোজগারে নামতে হয়, তার আগে জন্ম ইস্তক ছুটে বেড়াতে হয় মায়ানমার, চট্টগ্রাম, কাশী, বেনারস, কলকাতা, দেখেছেন নিদারুণ দারিদ্র আর লাঞ্ছনার জীবন, তার ভিতরের জগৎটা যে কখনো রাজনীতি কখনো কবিতা নিয়ন্ত্রণ করবে, এ আর এমন কী! সে জন্যই তো অনায়াসে তিনি বলতে পারেন, ‘সব ভোগে, জাহান্নামে তাই না? তোমার কী?/ কাকপক্ষীটিও জানবে না, বলছি শোনো, লেগে পড়/ পাড়ায় জানুক জন্ম থেকেই রংবাজ, তোলা গেলো,/ তারপর ওপেনলি দুটো মার্ডার/ আর পিছন ফিরে দেখতে হবে না।/লাফিয়ে দর উঠবে/টর্চ নিয়ে যেমন খোঁজে, খুঁজবে ‘পদ্মলোচন,/ মন্ত্রী হবে? কবি, অ্যাম্বেসেডর’?

এভাবেই কথা বলতেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। লিখতে এসেছিলেন অনেকটা বেলা পেরিয়ে। ষাটের দশকে তার বয়সীরা যখন কবিতায় জাঁকিয়ে বসেছে, তখন তিনি গ্রাসাচ্ছাদনের সংগ্রামে মগ্ন। অবশ্য ওই বয়সে বন্ধু ছিলেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত। দুই বন্ধুর কীর্তিকলাপ ধরা আছে অমিতাভর লেখনীতে। সেখানে অর্ধেন্দু অবশ্য হারু। অর্ধেন্দুর ডাক নাম। বোঝা যায়, কবিতার পাতায় নিজেকে প্রকাশ না করলেও তখন তিনি শিখে নিচ্ছেন হিন্দি, অহমিয়া আর রোমিনিয়া ভাষা।

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বেশ উঁচু পদে কাজ করার সময় দেখেছেন আদিবাসীদের আন্দোলন। বাঁচার আর বসবাসের অধিকার নিয়ে গড়ে ওঠা সেই আন্দোলনকে ভাঙতে প্রত্যক্ষভাবে ডিভিসি প্রশাসক, পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকার অর্ধেন্দুদাকে কাজে লাগালো। তিনি ছুটলেন। সাময়িক বিরতি ঘটল আন্দোলনের। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেল পশুপতি মাহাতোর সঙ্গে। পশুপতিদা ছিলেন নৃ-তত্ত্ববিদ। কলকাতা যাদুঘরের ভিতরেই ছিল তার অফিস। আদিবাসীদের সেই আন্দোলন কিন্তু বন্ধ হয়নি। তারা দাবি আদায়ের পথে অবিচল ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের হক তারা বুঝে নেয়। অর্ধেন্দুদা গোপনে তাদের সাহায্য করে। আর ড. পশুপতি মাহাতো কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করেও আদিবাসীদের পাশেই রয়ে গেলেন।

অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গে তখন কোনও আলাপ ছিল না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকেই তার কবিতা পড়ছি। ‘শ্রুতি’ কবিতা আন্দোলনের পাশাপাশি মানিক চক্রবর্তীর ‘আবর্ত’ পত্রিকার সঙ্গেও তিনি তখন জড়িয়ে। এসব খবর জানতাম। আমার কলকাতার সেই সময়ের বন্ধুদের অনেকেই তাকে চিনতেন। আমি চিনতাম না। তিনি প্রায়ই কফি হাউসে আড্ডা দিতেন। তখন চিনতাম না। চেনা হলো আরও পরে। আটের দশকের মাঝামাঝি। হাতে এলো একটা গল্পের বই ‘দিয়ানে হেবরে’। লেখক অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। কবির লেখা গল্প। বইটি দিয়েছিলেন আরেক গল্পকার সুব্রত রাহা, পরিবর্তন পত্রিকায় আলোচনা করার জন্য। পড়লাম বইটা। এক অন্যরকম ভাষা। কখনো ছায়াচ্ছন্ন, কখনো যাদুবাস্তবতা। লিখলাম বেশ যত্ন নিয়েই। বেশ বাহবা পেলাম। তারই প্রায় মাস খানেক পর, হ্যাঁ, তা মাস খানেক হবে, একদিন বন্ধু মিহির সরকার বলল, মামা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

-মামাটা আব্বার কে!

-অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। যাবে?

-কোথায়?

-রবিবারে এসো। আমাদের বাড়ি। নিয়ে যাবো।

মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে কার না ভালো লাগে। যে কোনও মানুষ, যে ধরনের মানুষই হোক না কেন। আমার তো ভালই লাগে। এ পর্যন্ত কম মানুষ তো দেখলাম না! সুতরাং একজন কবির সঙ্গে পরিচিতি হবো, এতো বাড়তি পাওনা। কবিরা তো কারও ক্ষতি করে না। অবশ্য পরবর্তী সময়ে দেখেছি কবিরাও ক্ষতি করে, কবিদের করে, সাধারণ মানুষের করে। অর্ধেন্দু চক্রবর্তী অবশ্য সে দলে পড়েন না। অমন দিলখোলা, সহৃদয় মানুষ কমই দেখা যায়।

মিহির থাকতো বজবজ লাইনে সন্তোষপুরে। বিয়ের পর নিতান্ত ঘরের অভাবে সে বাসাভাড়া নেয় রবীন্দ্রনগরে। ওদের বাড়ি থেকে মিনিট পনেরো হাঁটা পথ। মিহির আর ওর স্ত্রী দুজনেই ব্যাঙ্ককর্মী। সুতরাং পৃথক সংসার যাপনে অসুবিধা ছিল না।

রোববার সকালে মিহিরের বাসায় পৌঁছানো গেল। সে নিয়ে গেল কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর বাড়ি। দোতলায় কবির অধিষ্ঠান। যেতেই সাদর আহ্বান জানালেন অর্ধেন্দুদা। মনে হল তাঁর সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয়। তিনি আমার লেখার প্রংশসা করলেন। তার গল্প বই নিয়ে এমন আলোচনা নাকি আর কেউ লেখেনি। বুঝতে পারিনি এই প্রশংসার কতটা তেল আর কতটা আন্তরিক। অনেক পরে বুঝেছি, তিনি এমনই। যা বলেন, খোলা মনে বলেন।

যখন পৌঁছালাম তার বাড়ি, তখন কবিদের গুলজার চলছে। এই অঞ্চলে এবং খুবই কাছাকাছি বাস করতো বেশ কয়েকজন কবি-গল্পকার। রোববার সকালে চলত তাদের আড্ডা অর্ধেন্দুকে ঘিরে। সন্তোষপুরের বাইরে থেকেও অনেকে যেতেন। যেমন যেতো সুমিত্রা মজুমদার। সকাল থেকে বেলা গড়ানো পর্যন্ত চলতো নতুন লেখা পড়া, আলোচনা আর আড্ডা। বউদি শুধু চায়ের যোগান নিয়ে যেতেন। একটা সময় চা বন্ধ হতো, অর্থাৎ আড্ডা বন্ধের গৃহিনীসংকেত। যাও বাবা, এবার যে যার আস্তানায় ফিরে যাও। তা সেই আড্ডাকে বেশ কয়েকবার হাজির হলাম। কখনো মিহিরকে নিয়ে, কখনো একাই। তখন একা আমি। শনি-রোববার কৃষ্ণনগর না গেলে অর্ধেন্দুদার বাসায়। এভাবেই মানুষটির কাছাকাছি চলে গেলাম। তার জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। নিয়মিত উৎসাহিত করেছেন কবিতা লেখায়। কত তরুণ কবিকে উৎসাহিত করেছেন পত্রিকা প্রকাশ করতে। বলতেন যতবেশি পত্রিকা বেরোবে ততো চর্চা বাড়বে। এটা ছিল তার বিশ্বাস। পছন্দ করতেন আড্ডা। বলতেন, আড্ডায় মনের সমৃদ্ধি হয়। একই সঙ্গে বিশ্বাসী ছিলেন নিয়মানুবর্তিতা আর নিজের বিশ্বাস অর্জনে। এসব তিনি বলতেন আড্ডা দিতে দিতেই। শনিবারে কফি হাউসে হাজিরা দিতেন। চলতো তাকে ঘিরে আরেকদলের উন্মাদনা। এসবের মধ্যেই তিনি লিখে যেতেন কবিতা, প্রবন্ধ। করতেন অনুবাদ। লিখতেন রাশিয়ান লেখক তুর্গেনিভের জীবনী। অনুবাদ করেছেন রোমানিয়ার কবিতা, উর্দু কবিতা, হিন্দি কবিতা। অর্ধেন্দুদা চিন্তনে ও মননে ছিলেন বামপন্থী। কিন্তু বামপন্থার নামে ভন্ডামী একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। এসব ক্ষেত্রে তিনি স্বাভাবিকভাবেই গর্জে উঠতেন। অন্যসময় তার মতো হাস্যমুখ আর কেউ নেই।

একটা ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে। ১৯৯০-৯১ সাল হবে। ইত্যাদি প্রকাশনীতে ঝাঁপ পড়ে গেছে। আমরা অন্য কাগজে কাজের সন্ধানে ঘুরছি। বেশ অর্থনৈতিক বিভ্রাটের মধ্যেই আছি। একদিন দুপুরে গেলাম অর্ধেন্দুদার অফিসে। চললো একথা-সেকথা। অফিসে চা পান করা গেল। কথার ফাঁকে অর্ধেন্দুদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চলছে কী করে?

বললাম, চলছে না, চালাতে হচ্ছে।

তিনি কোনও কথা না বলে একটা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এখানে চলে যাও। কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এটা ছিল এক প্রকাশনীর দপ্তর। বিকালেই হাজির হলাম সেখানে। প্রকাশনীর মালিক মহাশয় চিঠি পেয়েই বললেন, অর্ধেন্দুদা ফোন করেছিলেন। তিনি সাদরে আপ্যায়ন করলেন। তিনি একটি বইয়ের প্রুফ নিয়ে বললেন, এটা দেখে দিন তারপর দেখছি।

কয়েকদিন পরেই ওখানে বসে প্রুফ দেখা আর সম্পাদনার কাজ শুরু করলাম। দু একটা সংকলনের জন্য লিখতেও হল। কিন্তু বেশিদিন সেখানে থাকা হয়নি। অন্য একটি প্রকাশনীতে চলে গেলাম। সেখানেও অফিস সময়ের মতো কাজ করতে হতো। সেই প্রুফ দেখা আর সম্পাদনা একই সঙ্গে। এরপরেই আবার চলে গেলাম কাগজের দপ্তরে।

এই পর্বে অর্ধেন্দুদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ কমে গেল। দেখা হলেই কেমন আছি ইত্যাদির বাইরে খুব একটা কথা হতো না। কিন্তু আমি যে লেগে আছি, সেটা জেনে খুশি হতেন। কিন্তু দিন তো সমান নাহি যায়। বামফ্রন্ট সরকার অর্থলগ্নি সংস্থাগুলোকে ধরতে শুরু করেছে। তারা নাকি স্পঞ্জি স্কিমে টাকা খাটাচ্ছে, আর গ্রাহককে ঠকাচ্ছে। খাঁড়ার ঘা পড়ল ওভারল্যান্ডের উপর। বন্ধ হলো কাগজ। গ্রাম বাংলায় ওদের প্রচার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছিল। আমি ততদিনে ‘দৈনিক প্রতিবেদন’ কাগজে। ওটাও  এক অর্থলগ্নি সংস্থার কাগজ। প্রমাদ গুনলাম আমরা। সরকারের কাছে আবেদন করা হল অন্তত কাগজটা যেন চালাতে দেওয়া হয়, অনেক সাংবাদিকের রুজির প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল, নিজেরা বিজ্ঞাপন তুলে চালালে চলতে পারে। চেষ্টা করা হলো কিছুদিন। হলো না। ততদিনে গাছের শিকড়টাই কেটে দেওয়া হয়েছে।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২৯। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

  1. কবির লেখা তুর্গেনেভের জীবনী গ্রন্থটি কীভাবে পাওয়া যাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *