ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : ত্রিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

১৯৯৩ এর জুন মাসে ইংল্যান্ড সফরে যায় অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট বা ওয়ানডে কোনোটাতেই ইংল্যান্ড দাঁড়াতে পারেনি। ওয়ানডে সিরিজে তাও দুটো ম্যাচ কান ঘেঁষে হারে কিন্তু টেস্ট সিরিজ ৪-১ এ হারে তারা। বুন (৫৫৫) ও মার্ক ওয় (৫৫০) রানের বন্যা ছোটান ছয় টেস্টের সিরিজে। বর্ডার, টেলর, স্লেটার, স্টিভ ওয় সবাই ৪০০- র বেশি রান করেন। দশটি সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা গোটা সিরিজে। বুন, মার্ক ওয়, স্লেটার ও হেডেন ১০০০ এর বেশি রান করেন ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ গুলোয়। বর্ডার, টেলর, স্টিভ ওয় ও মার্টিনের সংগ্রহ ছিল ৮০০- র বেশি রান। ৩২টি শতরান ছিল তাঁদের। ওয়ার্ন ৩৪ ও হিউজ ৩১ উইকেট নেন টেস্টে। মে ২১টি ও রাইফেল ১৯টি উইকেট পান। প্রথম শ্রেণির খেলা গুলোয় ওয়ার্ন ৭৫টি, মে ৫৩টি, হিউজ ৪৮টি ও রাইফেল ৩৭ উইকেট পান।

ইংল্যান্ড কে বিধ্বস্ত করে দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ডের। সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতে নেয়, তিনটে টেস্ট ম্যাচে ৭টি শতরান হয়েছিল তাদের পক্ষে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা আসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে। প্রায় অঘটন ঘটিয়ে ১-১ এ সিরিজ ড্র করে তারা। দ্বিতীয় টেস্টে ওয়ার্ন ১২ উইকেট নিলেও ডি ভিলিয়ার্স ১০টা ও ডোনাল্ড ৭টা উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ধ্বসিয়ে দেয়। তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া বদলা নিয়ে দুরমুশ করে তাদের। স্টিভ ওয় ব্যাট হাতে ১৬৪ ও বল হাতে প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট নেন ২৬ রানে। ম্যাকডরমট ৭ টা ও ওয়ার্ন ৫ উইকেট নেন। পিটার কার্স্টেন (৪ ঘন্টা ১৯ মিনিটে ৪২) ও ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স (৩ ঘন্টা ১৮ মিনিটে ৩০) বহু চেষ্টা করেও ড্র করতে পারেননি। ১২৯ রান তুলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ১০৫.৫ ওভারে।

এরপর অস্ট্রেলিয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। সেখানেও সিরিজ ১-১ হয়। ডারবানে শেষ টেস্ট ছিল অ্যালান বর্ডারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। অধিনায়কত্বে দায়িত্ব নেন মার্ক টেলর। এদিকে ওয়ানডে সিরিজ ৪-৪ হয়। এরমধ্যে শেষ ওডিআই ১ রানে জেতে অস্ট্রেলিয়া। মাস ছয়েক বাদে পাকিস্তানে গিয়ে প্রথম টেস্ট ১ উইকেটে হেরে সিরিজ ১-০ ব্যবধানে হেরে যায় অস্ট্রেলিয়া। এরপর ঘরের মাঠে অ্যাসেজ।

সেটা অবশ্য অনায়াসে ৩-১ ব্যবধানে জিতে নেয় তারা। ইংল্যান্ড প্রথম দুটো টেস্টে দাঁড়াতেই পারেনি। স্লেটার একাই সিরিজে ৬২৩ করেন। ওয়ার্ন ২৭টি ও ম্যাকডরমট ৩২টি উইকেট নেন। এরপরেই ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আসে। ঘরের মাঠে ১৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজ হারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতন নিশ্চিত হলো এতদিনে। এরপর পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা পরপর টেস্ট সিরিজ খেলতে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। পাকিস্তান প্রথম দুটি টেস্ট হারলেও তৃতীয় টেস্ট জয় করে। শ্রীলঙ্কা অবশ্য তিনটি টেস্টই হারে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলে একসঙ্গে অবসর নেন ডেভিড বুন ও ক্রেগ ম্যাকডরমট।

১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ থেকে উত্থান ঘটে শ্রীলঙ্কার। এদিকে বিশ্বকাপের পর ভারতে এক টেস্টের সিরিজ খেলতে আসে অস্ট্রেলিয়া।

১৯৯৬ সাল। নয়া-উদারবাদ বা বিশ্বায়িত ভারত একটু একটু করে ডানা মেলছে। হু হু করে পাল্টে যাচ্ছে চারপাশ। ধূসর কলকাতা আরও ধূসর। এমন সময় ২৩ বছরের শচীন তেন্ডুলকর এর নেতৃত্বে প্রথম বার টেস্ট খেলতে নামলো ভারত। দশই অক্টোবর প্রথম দিনের শুকনো উইকেটে অনিল কুম্বলে অস্ট্রেলিয়া কে দুরমুষ করে (১৮২; কুম্বলে ৪/৬৩) দিয়ে ভারত দিনের শেষে তোলে ৫৭/১।

১১ই অক্টোবর দ্বিতীয় দিন। সারা দিন ভারত ব্যাট করে তোলে ৩১৯/৬। সৌরভ গাঙ্গুলী ৬৬ করে আউট হওয়ার আগে অবধি ধারণা ছিল আজহারের প্রথম  টানা তিনটে টেস্টে  শতরানের রেকর্ড স্পর্শ করা হয়ে যাবে কিন্তু হলো না মোঙ্গীয়ার সঙ্গে ১৩১ রানের জুটি হলো। মোঙ্গীয়া কেরিয়ারের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি করলেন। দিনের শেষে অপরাজিত ১৩৭, পরের দিন ১৫২ করে আউট হন। ভারত করে ৩৬১। দ্বিতীয় ইনিংসে কুম্বলে (৫/৬৭) আরও ভয়ঙ্কর। কেবল স্টিভ অপরাজিত ৬৭। অস্ট্রেলিয়া ২৩৪ রানে শেষ। ভারত তিন উইকেটে ৫৮ তুলে জিতে যায়। খেলা চার দিনে শেষ।

এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যায়। যদিও অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জেতে কিন্তু দুটি টেস্ট হারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জিতে নিলেও একটা টেস্ট হারে। অ্যাসেজ শুরু হওয়ার আগে ৫টি জয়, চারটি হার। অ্যাসেজেও (এবার ইংল্যান্ডে) ফল অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে। ৩-২ (১টি ড্র)। নিউজিল্যান্ড দেশে এলে সিরিজ জয় আবার (২-০, একটা ড্র)। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ১-০ ব্যবধানে জিতলেও ২টি টেস্ট ড্র। এরপরে ভারত সফর। সেই সফরের আগে বিশ্বকাপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার টেস্টে রেকর্ড হলো ১১টি জয়, ৬ টি হার, চারটি ড্র। অথচ বিশ্বকাপের আগের তিন বছরে তারা ২৫টির মধ্যে ১৬টি জিতেছিল। সেটা ১৯৯৮।

১৯৯৮ মানেই শচীন তেন্ডুলকার। শেন ওয়ার্নের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের আগাম বার্তার দামামা বেজে উঠলো। শচীন তথা ভারতীয় বোর্ড একটি পরিকল্পনা করলো। প্রথমে লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণন কে সামনে রেখে একটি লেগ স্পিনারদের টিম বানিয়ে প্র্যাকটিস করানো হলো শচীন কে। দৃষ্টির বাইরে (অর্থাৎ লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে)  ক্ষত তৈরী করে বল ফেলানো হতো। সেই বলে সুইপ বা স্টেপ আউট করে বল মাটিতে পড়বার আগেই তুলে মারার প্র্যাকটিস চললো। এই টিমে বালাজী (এল বালাজী নন) নামে একজন স্পিনার ছিলেন। ভারতীয় এ দলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। পরে কানাডার হয়ে বিশ্বকাপ খেলেন (২০০৩)।

এছাড়াও  পরিকল্পনা করা হলো শচীন নামার আগেই যদি ওয়ার্ন বোলিংয়ে আসে, তাহলে তাঁকে অন্য ব্যাটার রা আক্রমন করবে, যাতে এই আতঙ্ক পেয়ে বসে যে এরাই যদি এমন খেলে তাহলে শচীন কি না জানি করবে!

সফরের প্রথম ম্যাচেই মারাত্মক পিটুনি খেলেন ওয়ার্ন। অমিত পাগনিশ (৫০) শুরু করলেন, শচীন করলেন শেষ (১৯২ বলে ২০৪ অপরাজিত)। প্রথম শ্রেণির খেলায় এটাই তাঁর প্রথম দ্বিশতরান। ওয়ার্ন ১৬ ওভারে ১১১। কোনও উইকেট নেই। অস্ট্রেলিয়া ৩০৫/৮ তুলে ইনিংস ডিক্লেয়ার্ড করলে মুম্বাই তোলে ৪১০/৬। জবাবে নীলেশ কুলকার্নি (৫/২৩) সামলাতে ব্যর্থ অস্ট্রেলিয়া তোলে ১৩৫। মুম্বাই ৩১/০ তুলে দশ উইকেটে জয়ী হয়।

বোর্ড সভাপতি একাদশের বিরূদ্ধে ওয়ার্ন ২ উইকেট পেলেও ২৬ ওভারে ৮৮ রান দিলেন। বোর্ড ৩২৯/৪ তোলে। হৃষিকেশ কানিতকার অপরাজিত ১০২ করেন। লক্ষণ ৬৫, রমেশ ৫৯ আর ভেঙ্কা প্রতাপ অপরাজিত ৫৯ করেন। ওয়ার্ন টেস্টের আগেই ৪২ ওভারে প্রায় ২০০ রান দিয়ে ২ উইকেট পান।  অস্ট্রেলিয়া অবশ্য ৫৬৭/৮ তুলেছিল। স্লেটার ২০৭ তোলেন। পন্টিং ১৫৫।

প্রথম টেস্টে অবশ্য প্রথম ইনিংসে শচীনের উইকেট সহ ৩৫-১১-৮৫-৪। ভারত তোলে মাত্র ২৫৭। সিধু ৬২, মোঙ্গিয়া ৫৮ ও দ্রাবিড় ৫২ করেন। কুম্বলে (৪/১০৩) ও রাজু (৩/৫৪) অস্ট্রেলিয়াকে ৩২৮ রানে আটকে দেয়। তাও ২০১/৮ হওয়ার পর হিলি (৯০) ও রবার্টসন (৫৮) দলকে টানেন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে শচীন ১৫৫ অপরাজিত, ওয়ার্ন ৩০-৭-১২২-১। শুরুটা অবশ্য সিধু করেছিলেন (৬৪)। দ্রাবিড় ৫৬ ও আজহার ৬৪ করেন। সৌরভ গাঙ্গুলী ৩৬ বলে অপরাজিত ৩০ করেন। ভারত ৪১৮/৪। জবাবে ৩৪৮ তাড়া করে ১৬৮ রানেই অস্ট্রেলিয়া শেষ। কুম্বলে (৪/৪৬) ও রাজু (৩/৩১)-র দৌলতে।।

দ্বিতীয় টেস্টের আগে ইন্ডিয়া এ দলের বিরুদ্ধে খেলেননি ওয়ার্ন। তখনই সফরে তার হিসাব ১০৭-২৪-৪০৬-৭। স্ট্রাইক রেট ৯১.৭১, গড় ৫৮।  সেই ম্যাচটি ড্র হয়। স্টিভ ওয় সেঞ্চুরি করেন।। ভারত ‘এ’ দলের অময় খুরেশিয়া করেন অপরাজিত ১১৭।

ইডেনে অবস্থা আরও খারাপ হয় অস্ট্রেলিয়ার। লক্ষ্মন ৯৫, সিধু ৯৭, দ্রাবিড় ৯২, শচীন ৭৯, আজহার ১৬৩ অপরাজিত, সৌরভ গাঙ্গুলী ৬৫, এমনকি নয়ন মোঙ্গিয়া অপরাজিত ৩০। ভারত ৬৩৩/৫। ওয়ার্ন ৪২-৪-১৪৭-০। হিসাব গিয়ে দাঁড়ালো ১৪৯-২৮-৫৫৩-৭। স্ট্রাইক রেট ১৩২, গড় ৭৬.১১। অস্ট্রেলিয়া অবশ্য প্রথম দিন নামে। সৌরভ গাঙ্গুলী ও জাভাগল শ্রীনাথ বোলিং ওপেন করে বাবুঘাটের দিক থেকে আসা গঙ্গার হাওয়া ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়ার ৪ উইকেট ৫৬ রানে তুলে নেন। স্টিভ ওয় ৮০ ও পন্টিং ৬০ করে দলের মুখ রক্ষা করেন। তারা প্রথম ইনিংসে ২৩৩ তোলে। কুম্বলে, শ্রীনাথ ও সৌরভ তিনটি করে উইকেট পান। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ইনিংস পরাজয় এড়াতে ৪০১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১৮১ রানে শেষ হয়ে যায়। কুম্বলে ৬২ রানে ৫ উইকেট নেন। শ্রীনাথ ৩টি উইকেট পান।

তৃতীয় টেস্টে ভারত হারলেও ওয়ার্ন ৬০-৯-১৮৬-৫। এখানেও সিধু (৭৪ ও ৪৪) শুরু করেন। শচীন (১৭৭ ও ৩১) তার ওপর সৌধ বানান।  সফরের সব প্রথম শ্রেণির ম্যাচ মিলিয়ে সেবার ওয়ার্ন ২০৯-৩৭-৭৩৯-১২। স্ট্রাইক রেট ১০৪, গড় ৬১.৫৮। শুধু টেস্টে ১৬৭-৩৩-৫৪০-১০। স্ট্রাইক রেট ১০০.২, গড় ৫৪। চূড়ান্ত ব্যর্থ। সেখানে শচীন টেস্টে ৩ ম্যাচের ৫ ইনিংসে ৪৪৬ একবার অপরাজিত থাকায় গড় ১১১.৫০। শতরান দুটি, অর্ধ শতরান দুটি। সফরের সব প্রথম শ্রেণির ম্যাচ মিলিয়ে রান ৬৫০, গড় ১৬২.৫০। এছাড়া সিধু ৬৮.২০ গড়ে ৩৪১, দ্রাবিড় ৪৪.৬০ গড়ে ২২৩ এবং আজহার ৭৭.৭৫ গড়ে ৩১১ করেন। কুম্বলে একাই ২৩ নেন।

এরপরে অস্ট্রেলিয়া যায় পাকিস্তানে। সেটা অবশ্যঅক্টোবর মাসে। সিরিজ ১-০ ব্যবধানে জেতে। সফরের বড় ঘটনা হলো মার্ক টেলর অপরাজিত ৩৩৪। চাইলেই আরও করতে পারতেন; কিন্তু ব্র্যাডম্যানের পাশে নাম লিখবেন বলে করেননি।

এরপর সেই অ্যাসেজ। অবিসংবাদী অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বহিঃপ্রকাশ যেখান থেকে। এর বিবরণে শেষ করবো অস্ট্রেলিয়া যুগের প্রেক্ষাপট।।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *