উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২৭। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

রিক্সাওয়ালা থেকে ডাকপিওন

অনিলের কথা বললেই ইদানিং সামনে এসে প্রবীর দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রবীর আচার্য। আমরা যখন বেশ দূরের হয়ে গেছি, প্রবীর তখন অনিলের কাছাকাছি। ওর ‘মৌসুমী’ পত্রিকা আর কাজল বিশ্বাসের অন্যমুখ নাট্যসংস্থা একত্রিত ভাবে যখন সাহিত্য সম্মান দেওয়ার কথা ভাবল, প্রথমেই ওরা সম্মানিত করলো অনিল ঘড়াইকে। আবার অনিল মারা যাওয়ার পর ওকে নিয়ে প্রবীরই প্রথম একটা সংকলন গ্রন্থ বের করল ‘অনিল’ নামে। স্মৃতিকথা আর আলোচনায় সমৃদ্ধ সেই গ্রন্থ অনিলকে চিনতে, জানতে সাহায্য করবে নিশ্চয়। কিন্তু সে সব তো অনেক পরের কথা। তার আগে প্রবীরকে নিয়ে দুচার কথা বলে নেওয়া যাক।

গত শতাব্দীর সত্তর দশকের জ্বলন্ত সময়ে অকস্মাৎ পিতৃহীন হয়ে সংসারের হাল ধরতে রিক্সার প্যাডেলে পা ছোঁয়াতে বাধ্য হয় প্রবীর। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানের বোধহয় এছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু ওর ভিতরে হেঁটে চলা শব্দেরা নিদারুণ দুঃখে কাতর না হয়ে বিদ্রোহ করতো মাঝে মধ্যেই। প্রবীর এসব সেইসব শব্দগুচ্ছকে আটকে রাখতো খাতার পাতায়। রিক্সা নিয়ে শহরের পথে ঘুরতে ঘুরতে এক একটা কবিতার পংক্তি ধাক্কা মারতো ওকে। স্টেশনের পাশে খেজুরতলায় গামছা দিয়ে বুকের ঘাম মুছে অপরাধী ভঙ্গীতে খাতা বের করে সেই সব পংক্তিমালা লিপিবদ্ধ করে, রেখে দিত সিটের নীচে। আবার সে কবি থেকে হয়ে যেত রিক্সওয়ালা।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণনগর স্টেশনে রিক্সাওয়ালাদের মধ্যে একটা গোপন সংগঠন গড়ে তুলেছিল সিপিআই (এম এল)। তখন পার্টি ভাঙতে শুরু করেছে। ছোটো ছোটো উপদল তৈরি হয়েছে। কোনও একটি উপদল তৈরি করেছিল এই সংগঠন। সম্ভবত দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি। সম্ভবত বললাম কারণ, শক্তিনগর, কালিনগর থেকে স্টেশন অঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল বেশি। প্রবীরও সেই রিক্সাচালকদের গোপন সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। সেই সময় তার কবিতায় ছিল বৈপ্লবিক আধার। অবসর সময়ে সে পড়তো। তার ভিতর কবিতার পোকাটা সেঁধিয়েছিল সম্ভবত তার বিদ্যালয়ের গুণে। ওদের শক্তিনগর হাই স্কুলে গণেশবাবু আর প্রসাদবাবু নামে দুজন মাষ্টার মশাই ছিলেন, যাঁরা কবিতা চর্চা করতেন। ছিলেন গল্পকার শচীন বিশ্বাস। দারিদ্র্যের যাঁতার পিষে যাওয়ার ফলে প্রবীর বাধ্য হলো স্কুল ছাড়তে। সে তখন রিক্সাচালক।

সত্তর দশকের শেষ দিকে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ‘বন্দীমুক্তি কমিটি’র আন্দোলন জোর পায়। প্রায় প্রতিদিনই শহরে মিছিল হচ্ছে। এমনই একদিন প্রবীরের সঙ্গে পরিচয়। তারপর একদিন থেকে প্রতিদিন। একত্রে চা-পান এবং কবিতা চর্চা। প্রায় এরকম সময়েই কলকাতায় গড়ে উঠল ‘বিপ্লবী লেখক সংঘ’। অধ্যাপক দেবব্রত পান্ডা নেতৃত্বে। ছিলেন নাট্যকার অমল রায়। কৃষ্ণনগরে তার শাখা তৈরি হলো। দায়িত্বে শচীন বিশ্বাস, অধ্যাপক সত্য বাগচী। আর কে কে ছিল বিস্মৃত হয়েছি। দেবব্রতবাবু এবং অমলদা প্রায়ই যেতেন কৃষ্ণনগরে সংগঠনের কাজে। আমি আর প্রবীরও জড়িয়ে গেলাম। বের হলো সাহিত্য পত্রিকা ‘বাসভূমি’। সম্পাদক শচীন বিশ্বাস। প্রবীর সেই পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতো। তখন অবশ্য শহরের বেশ কিছু ছোটো পত্রিকায় প্রবীর আচার্য্যর কবিতা দেখা যাচ্ছে।

আটের দশকের গোড়ার দিকে যখন আমি টেনিস বলের মতো কৃষ্ণনগর-শিয়ালদা করছি, এবং প্রবীরদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে, সেই সময় প্রবীর সেনাকর্মী হয়ে চলে গেল দূর দেশে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাকবিভাগে। অতএব যা হওয়ার তাই হলো। প্রবীর ছায়া হতে লাগলো। ততদিনে উড়নচণ্ডী কৃষ্ণনগরের পাট চুকিয়ে মহানগরের একপাশে সেঁধিয়ে গিয়েছে। অনেকই যেমন স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে, তেমনই প্রবীরও ক্রমশ ধূসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু হলো না। নব্বই দশকের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু করল রবীন্দ্রসদন বাংলা আকাদেমি চত্বর জুড়ে। উড়নচণ্ডীও দল জুটিয়ে হাজির ‘অন্তরীক্ষ’ পত্রিকা নিয়ে। সেই মেলাতেই এক রোববার দুপুরে কৃষ্ণনাগরিক এক তরুণ কবির হাত থেকে পেলাম একটি কবিতার বই – ‘একলব্যের দিনরাত্রি’। কবি প্রবীর আচার্য্য। চমকে গেলাম। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলাম যে এখন কৃষ্ণনগরে। মুখ্য ডাকঘরে। সেনাবিভাগের ডাক কর্মী থেকে শহরের ডাককর্মী। প্রবীর আবার ভেসে উঠল পুরনো চেহারা নিয়ে। কিন্তু সে তো বদলে গেছে অনেকখানি। জানলাম সে শহরে এসেছে অনেকদিন। জাঁকিয়ে বসেছে কবিতার সাম্রাজ্যে। জুটিয়ে নিয়েছে বেশ কিছু কবিবন্ধু। লিখছে প্রাতিষ্ঠানিক থেকে ছোটো অবাণিজ্যিক পত্রিকায়। পৃথিবী ত্যাগ করেছে তার আত্মজা মৌসুমী। সেও কবিতা লিখতে শুরু করেছিল। প্রিয় আত্মজার স্মৃতি অমলিন রাখতে শুরু করল ‘মৌসুমী’ পত্রিকার প্রকাশ। প্রবীর লিখল, ‘ঘুমাও, ঘুমাও তুমি -/সে ঘুম ভাঙে না আর ঘুমান চিরতরে…’।

প্রবীরের স্মৃতিটুকুই ছিল আমার কাছে দীর্ঘ অদর্শনের ফলে। কিন্তু শহরে আমার পর তো শহরের কবিরা তাকে নিকটে পেয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় ডাকঘর চত্বরে বসিয়েছে ঘণ্টা দুয়েকের আড্ডা। অনুজরা তার গুণগ্রাহী। সত্তরের বন্ধুরা তার সহমর্মী। কবিতার বইয়ে ছাপা ছবি দেখে জানতাম সে বড় গোঁফের অধিকারী। সত্তরের বন্ধুরা বলতো গুঁফো প্রবীর।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *