ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : আঠাশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

কেবল পার্থে একটা টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে হারালো ছাড়া অস্ট্রেলীয় দল টানা অনেকদিন টেস্ট সত্যি খেলেনি। ডিন জোন্স শতরান করেন, স্টিভ ওয় ৪টি ও মার্ভ হিউজ পাঁচটি উইকেট নেন। রণতুঙ্গা (৫৫ ও ৪৫), জয়ারত্ন (২৪ ও ৩৮) এবং মহানামা (২৮ ও ৪১) ছাড়া বিন্দুমাত্র কেউ প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। ইনিংসে জয়ী হয় অস্ট্রেলিয়া।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সফরের প্রথম ম্যাচে করাচিতে ঘটে গেলো ঠিক এর উল্টো ঘটনা। পাকিস্তান ইনিংসে জিতলো। মিয়াঁদাদ করলেন ২১১, শোয়েব মহম্মদ ৯৪, কাদির বল হাতে ৫টি ও ইকবাল কাসিম ৯টা উইকেট পান। পিটার টেলর প্রথম ইনিংসে কেবল হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন।

ফয়সলাবাদের দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হয়। তারই মধ্যে ইজাজ আহমেদ, অ্যালান বর্ডার ও জাভেদ মিয়াঁদাদ শতরান করেন।

লাহোরের তৃতীয় টেস্ট ও ড্র হয়। তবে চতুর্থ ইনিংসে ২৬৮ তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান অতি কষ্টে হার বাঁচায় (১৫৩/৮)।

একমাস পরে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। ব্রিসবেন ও পার্থে যথাক্রমে ৯ উইকেটে ও ১৬৯ রানে হেরে যায় তারা। মার্শাল, প্যাটার্সন বিধ্বংসী হয়ে উঠছিল। তারই মধ্যে রিচার্ডস আর হেইন্স সেঞ্চুরি করেন। শুধু বর্ডার (শতরান), স্টিভ ওয় ও ডেভিড বুন ব্যাটিং করেন।

মেলবোর্নে আরও বড় ব্যবধানে হেরে যায় অস্ট্রেলিয়া (২৮৫)। প্যাটার্সন ৯টা ও অ্যামব্রোজ ৭টা উইকেট নেন। রিচি রিচার্ডসন সেঞ্চুরি করেন।

সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়া অবশেষে জিতে যায়। অ্যালান বর্ডার বল হাতে ১১টা উইকেট নেন। ব্যাট হাতে ৭৫ ও অপরাজিত ১৬ করেন। বুন শতরান করেন আর হেইন্স ও।

জোনস এর ডবল সেঞ্চুরির জন্য অস্ট্রেলিয়া পরের টেস্টে ম্যাচ ড্র করে এডিলেটে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রিচার্ডসন ও সেঞ্চুরি করেন। হুইটনি ৯ উইকেট পান।

১৯৮৯ এর জুন মাসে ইংল্যান্ডে অ্যাসেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য অস্বাভাবিক ছিল। তারা ৬ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ৪-০-য় জয়ী হয়। মার্ক টেলর ৮৩৯, জোন্স ৫৬৬, ওয় ৫০৬, বুন আর বর্ডার ৪৪২ করেন। বল হাতে অল্ডারম্যান ৪১টি ও লসন ২৯ টি উইকেট নেন। এমনকি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ গুলোয় টেলর ১৬৬৯, জোন্স ১৫১০, বুন ১৩০৬, স্টিভ ওয় ১০৩০, বর্ডার ৯৭৯, মার্শ ৯৩৪ রান করেন। অল্ডারম্যান ৭০ ও লসন ৬৯ উইকেট নেন।

এই অ্যাসেজ ছিল ঐতিহাসিক। প্রথমত: প্রায় ১৪ বছর বাদে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাসেজ জিতলো। দ্বিতীয়ত: প্রায় ৫৫ বছর বাদে (বিল উডফুলের পর প্রথম) সিরিজ দখলে রাখলো মানে দেশে ও বিদেশে পরপর জিতলো। তৃতীয়ত: ব্র্যাডম্যানের ৯৩৪ আর হাটনের ৯০৫ এর পরে এক সিরিজে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান করলেন মার্ক টেলর। চতুর্থত: অ্যাশেজে তৃতীয় সর্বাধিক উইকেট পান অল্ডারম্যান।

সর্বোপরি এই প্রথম ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপের ধাক্কা সামনে পুরোনো অস্ট্রেলিয়া সামনে এলো যারা ভবিষ্যতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাধান্য সরিয়ে প্রধান হয়ে উঠবে এবং ২০০৫ এর আগে অবধি পরপর সাতটি অ্যাসেজ জিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবে। এই সিরিজে ইংল্যান্ড ২৯ জন ক্রিকেটারকে খেলায়, সেখানে অস্ট্রেলিয়া কাজ হাসিল করে ১২ জনকে দিয়ে।

কিন্তু এরপর পার্থে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ও ব্রিসবেনে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ড্র করে তারা। যদিও হোবার্টের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে শ্রীলঙ্কা হেরে যায় ১৭৩ রানে।

১৯৯০ এর শুরুতে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ ১-০ ব্যবধানে জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। ওয়েলিংটনে তারা নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারে। টানা ১৪টি টেস্টে অপরাজিত থেকে ধাক্কা খায় তারা। অ্যাশেজে আবার আধিপত্য বিস্তার করে ৩-০ ব্যবধানে জিতে যায় তারা। ২০ টেস্টে ১০টি জয়, ৯টি ড্র ও একটি হার নিয়ে প্রবল উৎসাহে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয় তারা। অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে। যথারীতি সিরিজ হারে। ৩-১ এ। কিন্তু অনেকদিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তাদের হারাতে সক্ষম হয়।

এরপরেই ভারত সফর করে অস্ট্রেলিয়া। এই সফর নিয়ে একটু বিস্তারিত লেখা হবে। কারণ অদূর ভবিষ্যতে এই দলই একমাত্র কিছুটা পাল্লা দেবে অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া দলকে।

মহম্মদ আজহারউদ্দিন (অধিনায়ক; হায়দ্রাবাদ), রবি শাস্ত্রী (সহ- অধিনায়ক; বোম্বে), কপিলদেব (হরিয়ানা), দিলীপ ভেঙ্গসরকার(বোম্বে), কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত (তামিলনাড়ু) অর্থাৎ বর্তমান ও প্রাক্তন সহ মোট পাঁচ জন টেস্ট অধিনায়ক (একজন আবার ওডিআই ক্রিকেটে বিশ্ব জয়ী) ছাড়াও নবজ্যোত সিং সিধু (পাঞ্জাব), মনোজ প্রভাকর (দিল্লী) ও সঞ্জয় মঞ্জেরেকারের (বোম্বে) মতো আশির দশকের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটাররা ছিলেন দলে। সঙ্গে ছিলেন কিরণ মোরে (বরোদা) ও চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের (বোম্বে)  মতো দুজন মোটামুটি অভিজ্ঞ উইকেট কিপার এবং নরেন্দ্র হিরোয়ানী (মধ্যপ্রদেশ) ও ভেঙ্কটপতি রাজুর (হায়দ্রাবাদ) মতো দলে খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করা দুই স্পিনার।

তবে নজর ছিল সর্বাধিক কিছু নতুনদের উপর। ১৭ বছর বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরী করা শচীন তেন্ডুলকার (বোম্বে) এবং তখনও টেস্ট না খেলা জাভাগল শ্রীনাথ(কর্ণাটক), সুব্রত ব্যানার্জি (বিহার) ও সৌরভ গাঙ্গুলীর (বাংলা) ওপর।

পাঁচজন বোম্বে সহ মোট ছয়জন পশ্চিমাঞ্চল, দুইজন হায়দ্রাবাদী সহ মোট চারজন দক্ষিণাঞ্চল, তিনজন উত্তরাঞ্চল, দুইজন পূর্বাঞ্চল ও একজন মধ্যাঞ্চল। মোট ১৬ জনের দল।

পার্থে ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯১; অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি একাদশের বিরুদ্ধে (২৫৪/৬) ভারত (২২৫/৭) প্রথম ম্যাচেই হেরে যায়। জিওফ মার্শ ১০৬ করেন। শ্রীনাথ মার্শ, মুডি ও ড্যামিয়ান মার্টিন কে আউট করেন (৩/৫৬)। ভেঙ্গসরকার কেবল ৭১ মিনিটে অপরাজিত ৫৮ করেন। শাস্ত্রী ৪০ করলেও ৯৭ মিনিট সময় নেন। মার্টিন (মূলত ব্যাটার) বল হাতে ৩ উইকেট নেন।

উল্লেখ করা যায়, ডেনিস লিলি এই ম্যাচ খেলেন ও ১০ ওভারে ২৬ রানে ১ উইকেট নেন। আর, এই ম্যাচে খেলা শচীন, সৌরভ ও মার্টিন তিনজনেই বহু বছর পর আই পি এল নামক টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন। সৌরভ এই ম্যাচে ৯ বলে ২ রান করেন।

পরের দিন পার্থের অন্য এক ম্যাচে মুডি আর অল্ডারম্যান ভারতকে মাত্র ৬৪ রানে অল আউট করে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াকে সহজ জয় (৯ উইকেটে) এনে দেন। কেবল শ্রীনাথ একটি চার সহ ১১ করেন; আর কেউ দু অঙ্ক তো বটেই – চার ও মারতে পারেননি। বল হাতে একমাত্র উইকেট ও শ্রীনাথের। ভেঙ্গসরকার এরপর আর কোনও লিস্ট এ ম্যাচ খেলেননি।

২১ তারিখে ওয়াগায় অবশ্য ভারত ছাড়লো না। প্রভাকর ২৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসকে ২২০/৭ এ আটকে দেয়। ৮টি প্রথম শ্রেণির ও ২ টি লিস্ট এ খেলা গ্রেগ গেইস ১০২ করেন। জবাবে ৪৭.২ ওভারে ২ উইকেটে ২২১ করে ভারত জিতে যায়। শাস্ত্রী ৭২, মঞ্জেরেকার অপরাজিত ১১৬ ও শচীন অপরাজিত ২৪ করেন। দলের ২২১ এর মধ্যে ২১২ রান বোম্বের ব্যাটাররা করেন।

কিন্তু লিসমোরে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ভারত এক ইনিংস ও ৮ রানে হেরে যায়। শচীন ৮২ করেন। শ্রীনাথ ২৪, আজহার ২৩ ও সৌরভ ২০ করেন। ভারত অতিকষ্টে ২০৯ তোলে। হোল্ডসওয়র্থ ৪ উইকেট নেন। নিউ সাউথ ওয়েলস তোলে ৩৬৪। মাইকেল বেভান ১১৫ করেন। মার্ক ওয় করেন ৭৯। স্টিভ ওয়, মার্ক টেলর ও মাইকেল বেভানের উইকেট নেন সুব্রত ব্যানার্জি। দ্বিতীয় ইনিংসে শচীন ৫৯ ও প্রভাকর ৪১ করেন। সৌরভ গাঙ্গুলী ৮ করেন দুটি চার মেরে। হুইটনি ৬ উইকেট নেন।

২৯ শে নভেম্বর ব্রিসবেনে শুরু হয় প্রথম টেস্ট। ম্যাকডরমট (৫/৫৪) এর জন্য ভারত ৮৩/৬ হয়ে যায়। এরপর কপিলদেব (৪৪), প্রভাকর (৫৪) শেষ অবধি টেনে নিয়ে যান ২৩৯ এ। বল হাতে কপিলদেব ৮০ রানে ৪ উইকেট নেন। কিন্তু মার্ক টেলর ৯৪, বুন ৬৬ আর মার্শ ৪৭ করায় প্রথমে ২৪৪/২ অবধি টেনে দেয়। এরপর অবশ্য ৩৪০ এ ইনিংস শেষ হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে হিউজ ও ম্যাকডরমট চারটি করে উইকেট নেওয়ায় ভারত ১৫৬ রানেই শেষ। এবারে ৪৭/৫ হয়ে গিয়েছিল। প্রভাকর ৩৯, শাস্ত্রী ৪১ ও কপিলদেব ২৫ করেন। বিনা উইকেটে অস্ট্রেলিয়া লক্ষ্য তুলে নেয়।

এরপর বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ শুরু হয়। অবশেষে ১৭ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী একাদশের বিরুদ্ধে  নামে ভারত ক্যানবেরায়। গ্রেগ ব্লিওয়েটের ৬৫, বিভানের ৬০ ও মার্টিনের ৫০ তাঁদের ২৪৪/৭ তোলে। ভেঙ্গসরকার ৪৪, শচীন ৩৪ ও প্রভাকর ৩৪ করেন; কিন্তু ভারত তোলে ১৬৯। গ্রেগ রোয়েল ২৭ রানে ৬ উইকেট পান।

২০ শে ডিসেম্বর থেকে ব্রিসবেনে ভারত কুইন্সল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪৫৪/৯ তোলে। পন্ডিত ও মঞ্জেরেকার শতরান করেন। কপিল করেন ৮০। সৌরভ করেন ২৯। কুইন্সল্যান্ড ৩১৯/৪ করে ইনিংস ঘোষণা করেন। একারম্যান বোধ হয় বর্ডারের নির্দেশে ম্যাচের ফয়সালা চেয়েছিলেন। যাই হোক; বার্সবি ৮৩, বর্ডার ৮৫ ও গ্রেগ রিচি করেন ৬৮। ভারত ৪৬ ওভারে ১৭৭/২ তুলে ইনিংস ঘোষণা করেন। ভেঙ্গসরকার অপরাজিত ৮২ ও আজহার অপরাজিত ৯০ করেন। এরপর রিচি ১০৭ করলেও রাজুর বোলিং (৬/৭১) ভারতকে প্রথম জয় এনে দেয়।

মেলবোর্নে বক্সিং ডের দ্বিতীয় টেস্টে ভারত ২৬৩ রানেই শেষ হয়ে যায়। ১৫১/৮ হয়ে গেলে মোরে (৬৭) ও রাজু (৩১) টেনে নিয়ে যান। ব্রুস রিড ৬৬ রানে ৬ উইকেট নেন। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৩৪৯ করে। মার্শ ৮৬, হিলি ৬০ ও জোনস ৫৯ করেন। কপিলদেব ৯৭ রানে ৫টি ও প্রভাকর ৮৪ রানে ৪ উইকেট নেন। রিড দ্বিতীয় ইনিংসে (৬/৬০) আরও ভয়ঙ্কর হন। ভেঙ্গসরকার ৫৪ ও শচীনের ৪০ ভারতকে ২১৩ অবধি টেনে নিয়ে যায়। মার্ক টেলর ৬০ ও বুন অপরাজিত ৪৪ করে অস্ট্রেলীয় দলকে ৮ উইকেটে জিতিয়ে দেয়।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *