পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ৪। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

গত পর্বের পর

ব্রুনো ম্যানসার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিবেশ-কর্মী হত্যা-নিরুদ্দেশের সাতকাহন

অ্যালেটা বাউনের গল্পে হত্যার ইতিহাস নেই। তবে, হত্যা থেকে হত্যার চেষ্টার ভেতর কয়েকটা চান্স ফ্যাক্টর। যাঁরা টিকে যান, তাঁরা শুধু জানেন, টিকে আছেন। কতদিন, কতক্ষণ জানেন না। এভাবে অ্যালেটা বাউন টিকে আছেন। ২০১৩-র গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ পেয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার টিমোরের মিউটিস পাহাড়ে লাইমস্টোন পাথর থেকে মার্বেল উত্তোলনের রাষ্ট্রপ্রদত্ত মদতের বিরুদ্ধে অ্যালেটা তাঁর মোল্লো আদিবাসীদের হয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন বহু আগে থেকেই। ২০০৬-এ অ্যালেটা বার্টা ক্যাসেরেসের পরিণতি পেতেই পারতেন। ধর্ষণ না খুন? ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন করে থেকে রাস্তা আটকায় রাষ্ট্রীয় গুন্ডা। কোনওক্রমে বেঁচে যান অ্যালেটা। দুমাসের কন্যাসন্তানকে নিয়ে আত্মগোপন করেন অরণ্যে। সেই মেয়ে একটু বড় হলে ফিরে আসেন লড়াইয়ে। ১৫০ জন মোল্লো আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে রাতদিন পড়ে থাকেন মিউটিস পাহাড়ে, সেনার অস্ত্রের সামনে আদিবাসী তাঁতের যন্ত্র নিয়ে – বাকি পৃথিবীর কাছে যা দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘উইভিং প্রোটেস্ট’ – মার্বেল উত্তোলন থেকে কোম্পানি চোখ সরিয়ে নিয়েছে তারপর। রাষ্ট্র হেরে গেছে। অ্যান্ড অ্যালেটা বাউন, স্নেহের ‘মামা অ্যালেটা’ ওন দ্য ফাইট। ঠিক এরকম জিতে যাওয়ার লেগ্যাসি ছিল ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ ইন্টারন্যাশনালের শাখা ইন্দোনেশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট বা ‘ওয়ালহি’-র সদস্য-নেতা মুরদানির। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ সংলগ্ন ইকোট্যুরিজমের আওতাভুক্ত মোনেমেং ও বিলেবান্টে গ্রামে দেশের কুখ্যাত বালি-মাফিয়াদের ছায়া। লাগাতার প্রতিবাদে সরকার কাজ তুলে নেয়। তবে, ভয়ের লেগ্যাসি চলেছে। ২০১৯-এর ২৭ জানুয়ারি রাত তিনটের সময় বালি-র লোম্বাকে নিজের বাড়িতে অতর্কিত আগুন, পুড়ে যায় অনেক কিছুই। স্ত্রী-সন্তান সহ কোনওক্রমে পালাতে পেরেছিলেন মুরদানি। অর্থাৎ বেঁচে ফেরা জাস্ট একটা চান্স ফ্যাক্টর। বেআইনি কয়লা খনির কাজ নিয়ে নিরন্তর কাজ করা মাইনিং অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক বা ‘জাটাম’-এর ইস্ট কালিমান্তানের অফিসে ৪০-জনের একটি গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণ হয় ২০১৮-র ৫ নভেম্বর। সাম্প্রতিক কাজ, মামলা সংক্রান্ত বহু কাগজ চুরি, অফিস ভাঙচুর। জাটাম কিন্তু তারপরেও লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। সেভ ইন্দোনেশিয়া, সেভ বালি।

মোল্লো আদিবাসীদের সঙ্গে আন্দোলনের রূপরেখা আলোচনায় অ্যালেটা বাউন (ছবিসূত্র – গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ)

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের হিসেবে ইন্দোনেশিয়ায় ২০০১ থেকে ২০২২ অবধি শেষ হয়েছে ২৯.৪ মিলিয়ন হেক্টর ট্রি-কভার, যার ভেতর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট লস ২৩০ কিলোহেক্টর। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১৭১টি ছোটবড় হিংসের ঘটনা ঘটেছে অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে, যাঁদের অধিকাংশই স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। প্রেক্ষিত কখনও স্যান্ড-মাইনিং, মার্বেল মাইনিং, অথবা মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া জুড়ে চলা পৃথিবীর ৮৫% গ্লোবাল পাম অয়েল মার্কেটের জন্য অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন চালিয়ে নির্মিত পাম ওয়েল মনোকালচার। এশিয়া পাল্প অ্যান্ড পেপার বা এপিপি কোম্পানির জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বহুদিন ধরে সোচ্চার ছিলেন পরিবেশ-কর্মী, কৃষক টেবো ফার্মার্স ইউনিয়ন ও ‘ওয়ালহি’ দলের সদস্য ইন্দ্র পেলানি। ২০১৫-র ২৭ ফেব্রুয়ারি বছর বাইশের ইন্দ্র বন্ধু মিচ করিমের সঙ্গে বাইকে ফিরছিলেন। রাস্তায় এপিপি-র সাবসিডিয়ারি কোম্পানি উইরাকারওয়া শক্তি-র সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। ফলস্বরূপ বেদম প্রহার। করিম কোনওক্রমে বেঁচে ফেরেন। ইন্দ্রর শরীর পাওয়া যায় পরে। প্রসঙ্গত এই ২০১৫-তেই জাভা অঞ্চলে প্রথম পরিবেশ-শহীদ বছর বাহান্নর সেলিম কানসিলের গল্প এখনও জাভার গাছে, নদীতে, মাটিতে। স্থানীয় ওয়াতু পেকক সি-বিচে যথেচ্ছ স্যান্ড মাইনিংয়ে সৈকতে একাধিক গর্ত হয়ে সমুদ্রের জল ঢুকে শেষ করে দিচ্ছিল সেলিমদের পার্শ্ববর্তী ধানের জমিতে। মাইনার ট্রাক বোঝাই করে রাখা থাকত সেলিমের নিজের জমিতেই, তাঁর অনুমতি ছাড়াই। ক্রোধে প্রতিবাদ। ৯ সেপ্টেম্বর র‍্যালি, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০ চাষির জমায়েত এবং পরের দিনই মাইনারদের ৩৬ জনের গুন্ডাবাহিনীর নেতৃত্বে লুমাজাং রেজেন্সির সালোক আওয়ার-আওয়ার গ্রামে সেলিমকে টানতে টানতে স্থানীয় মিটিং হলে এবং সেখান থেকে একটি কবরখানায় নিয়ে গিয়ে ক্রমাগত প্রহার এবং পরিকল্পিত ওপেন-মার্ডার। তবে আলো এটাই, পরের বছরেই হত্যার নেপথ্য-খলনায়ক গ্রামের প্রধান এবং প্রধানের এক সহকর্মীর ২০ বছরের জেল। সাম্প্রতিক অতীতে সবচেয়ে আলোচিত পরিবেশকর্মী-মৃত্যু বছর চৌত্রিশের আইনজীবী, পরিবেশ-কর্মী ‘ওয়ালহি’ সদস্য গডফ্রেড সিরেগারের। ইন্দোনেশিয়ার বাটাং টারু অরণ্য ও নদী সংলগ্ন অঞ্চলে ২০১৭ সাল থেকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল পিটি নর্থ সুমাটেরা হাইড্রো এনার্জি কোম্পানি। অর্থের জোগান ব্যাঙ্ক অফ চায়না থেকে পরে হস্তান্তরিত হয় চীনের এস.ডি.আই.সি.-র ওপর। বাঁধের ডেভেলপার চীনের সাইনোহাইড্রো কোম্পানি। গডফ্রেডদের লড়াই। এই বাটাং টারু অরণ্য ক্রিটিকালি এনডেঞ্জারড টাপানুলি ওরাংওটাং-এর একমাত্র বাসস্থান, সঙ্গে রেয়ার সুমাত্রান টাইগার, সুমাত্রান লার গিবন, সুন্ডা প্যাঙ্গোলিন, সান বিয়ারের মতো প্রজাতির। এই টাপানুলি ওরাংওটাং এতটাই বিপন্ন, যে কমতে কমতে মোট সংখ্যা ৭৬৭-তে এসে থেকেছে। এবং এর সঙ্গে বাঁধ অঞ্চল বিপজ্জনক ফল্ট লাইনে নির্মিত হওয়ায় ভূকম্পের সাংঘাতিক ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। ১৬০০ একর জমির বাটাং টারু ড্যামের ই.আই.এ.-র ভার নিয়েছিল পিটি গ্লোবাল ইন্টার সিস্টেম কোম্পানি। আর এই কোম্পানির বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে নর্থ সুমাত্রান ইউনিভার্সিটির একজন রিসার্চ সায়েন্টিস্টের সই জাল করে ই.আই.এ. বা স্থানীয় ভাষায় আমদাল ডকুমেন্ট পাল্টে দেওয়া। মূল নথির ২৩টি বিপন্ন প্রজাতি শেষমেশ জমা করা নথিতে হয়ে যায় ১৫, এবং সেখানেই এই সই জালের অভিযোগ। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই কোম্পানির বিরুদ্ধে পুলিশি নালিশ গডফ্রেডের এবং সেখানেও তিন তিনবার এফআইআর নিতে পুলিশি টালবাহানা। ক্রমশ আইনি পদক্ষেপ। ২০১৯-এর ৩ অক্টোবর মেদান শহরে মোটর দুর্ঘটনায় পড়ে থাকতে দেখা যায় গডফ্রেডকে। মাত্র তিনদিন লড়াই করতে পেরেছিলেন গডফ্রেড। রক্তাক্ত মাথা ছাড়া শরীরের বাকি অংশ অবিকৃত দেখেও স্রেফ বাইক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে সম্ভাব্য হত্যার কোনও তদন্ত হল না গডফ্রেডের দেশে। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে পাম অয়েল কোম্পানির জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কথা বলে একাধিক ছুরির আঘাতে চলে যেতে হয় স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্ট মারতুয়া সিরেগার (৫৫) ও মারাদেন সিয়ানিপার (৪২)-কে। এবং এই পাম অয়েল সমস্যার সাম্প্রতিকতম শিকার ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর বোর্নিও-বাংকাল গ্রামের একটি প্রতিবাদ আন্দোলন। সেন্ট্রাল কালিমান্তান অঞ্চলের বেস্ট অ্যাগ্রো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির এইচ.এম.বি.পি. প্ল্যান্টেশনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দায়াক আদিবাসীদের অভিযোগ ছিল মোট ১১৭৫ হেক্টর রেইনফরেস্টে এই লিজ পাওয়া কনসেশন এলাকার বাইরে আরও ১০০০ হেক্টরে দায়াকদের অধিকৃত জমিতে কোম্পানি বেআইনি কাজ চালাচ্ছে। প্রতিবাদ সভায় পুলিশি গুলি, একজন নিহত, দুজন আহত। অর্থাৎ হত্যার লেগ্যাসি চলছে। পাশাপাশি লড়াই, ক্লান্তিহীন, পরিণতিহীন। মোল্লো আদিবাসীদের লড়াইয়ের সেইসব মটোর মতো, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় – জল আমাদের রক্ত, অরণ্য আমাদের রোম, মাটি আমাদের মাংস এবং পাথর আমাদের অস্থি …

বাটাং টারু অরণ্যের একটি টাপানুলি ওরাংওটাং (ছবিসূত্র – জাকার্তা পোস্ট)

 

বাটাং টারু বাঁধের ই.আই.এ.-তে সই জালের অভিযোগে আইনি আন্দোলনরত গডফ্রেড সিরেগার, ছবিতে একেবারে মাঝে কাগজ ধরে গডফ্রেড (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

 

অস্থি থেকে আরেক অস্থি। দেশ থেকে আরেক দেশ। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের সমীক্ষা বলছে, ২০০১ থেকে ২০২২ – মোট ৪.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর ট্রি-কভার হারিয়েছে মায়ানমার এবং হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্টের নিরিখে এই সংখ্যাটি ৭০৩ কিলোহেক্টর, যা ট্রি-কভার লসের ১৬ শতাংশ। দেশের শান রাজ্যে সর্বাধিক ডিফরেস্টেশন এবং ট্রি-কভার লসের রিপোর্ট এসেছে। সেদেশের ক্যারেন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক বা ‘কেস্যান’-এর সদস্য স’ ও মু দেশের মুত্রা জেলায় সলউইন নদী ও অরণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে ৫৪০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা ক্যারেন রিজার্ভ ফরেস্টে সলউইন পিস পার্ক তৈরির জন্য আন্দোলন চালাচ্ছিলেন বারো বছর ধরে। কুখ্যাত সাইনোহাইড্রোর বাঁধের ছায়া এখানেও। হ্যাটগাই হাইড্রোইলেকট্রিক প্রোজেক্টের জন্য বৃক্ষচ্ছেদন এবং স্থানীয় সুন্ডা প্যাঙ্গোলিন, ক্লাউডেড লেপার্ড ও এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ারের মতো বিপন্ন প্রজাতির বাসস্থানের ওপর করাল আঘাত। ক্যারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সঙ্গে দেশীয় মিলিটারির ক্রমাগত সংঘাতে প্রায় ২৩০০ গ্রামবাসী ঘরছাড়া। পরিবেশ আন্দোলন ছাড়াও এদের মাথার ওপর ছাদ এবং খাবারের জোগানে স’ ও মু-র ছিল অনন্ত প্রচেষ্টা। ২০১৮-র ৫ এপ্রিল এক কে.এন.এল.এ. সেনার লিফট দেওয়া বাইকের পেছনে বসে আসার সময়ে ফ্যাটাল মিলিটারি গুলি, অথচ সরাসরি রাজনীতিতে পরিবেশ-কর্মীর তেমন কোনও যোগাযোগের ইতিহাস ছিল না। দুবছর আগে এরকমই কণ্ঠরোধ চলে ডেইলি ইলেভেন সংবাদপত্রের তরুণ সাংবাদিক বছর পঁয়ত্রিশের স মু টুনের ক্ষেত্রে। অবৈধ গাছকাটার রিপোর্ট করে চক্ষুশূল ছিলেন টুন। ২০১৬-র ১৩ ডিসেম্বর সাগাইং অঞ্চলের একটি রাস্তার ওপর রক্তাক্ত টুনের নিথর শরীর পাওয়া যায়।

সলউইন পিস পার্ক, মায়ানমার (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)
সলউইন পার্কে ক্যারেন আদিবাসীদের বাঁধবিরোধী আন্দোলন (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

 

এবং মালয়েশিয়া। ২০০১ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ৮.৯২ মিলিয়ন হেক্টর ট্রি-কভার লসের ৩৩ শতাংশ অর্থাৎ ২.৮৫ হেক্টর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট, সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য সারাওয়াক, ৩.১৮ মিলিয়ন হেক্টর। এবং সারাওয়াক বলতেই ব্রুনো ম্যানসার। তবে, ব্রুনো কথায় আসার আগে আরও দুয়েকটি মুখ। মিরি শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের সুঙ্গাই-বেকেলিট অঞ্চলের ট্রাডিশনাল লংহাউজ কমিউনিটির দায়াক আদিবাসীরা স্থানীয় টুং হুয়াট নিয়াহ পাম অয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে জমি অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছিলেন বহুদিন ধরে, তিন হেক্টর জমিতে এই কোম্পানিকে স্থানীয় সরকারের লিজ দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হন। দেশের বিরোধী দলের সদস্য এবং স্থানীয় এক সাংসদ-চিকিৎসকের ব্যক্তিগত সচিব বিল কেয়ং বহুদিন ধরে এই দায়াকদের হয়ে কোর্ট হিয়ারিং-এ সাহায্য করে আসছিলেন, গ্রাম থেকে তাঁদের প্রতিনিয়ত সদরের কোর্টে যোগাযোগ করানোয় প্রয়োজনীয় সাহায্য, পাশে দাঁড়ানোর মাশুল দিতে হল ২০১৬-র ২১ জুন। ইদের ঠিক আগের সেই সকালে ঘরে স্থানীয় ‘কুইহ’ বা পেস্ট্রি বানাচ্ছিলেন স্ত্রী হাসিকিন। একটা ফোন এসেছিল – স্বামী গুলিবিদ্ধ। হাসিকিন জানতেন না পরিবেশ-আন্দোলনে স্বামীর এই যোগাযোগ। শুধু জানলেন মিরি শহরে ট্রাফিকে আটকে থাকা অবস্থায় তাঁর স্বামীর মাথায় দু’দুটো বুলেট গাড়ির জানলা ভেঙে একেবারের জন্য ঢুকে গেছে ভেতরে। অথবা সুঙ্গাই কেলুইট অঞ্চলে টুং হুয়াট কোম্পানির বিরুদ্ধে জমি অধিকার আন্দোলনে স্থানীয় আদিবাসীদের নিরন্তর লড়াই, ১৯৩৪ থেকে এলাকায় টিকে থাকা আদিবাসী রক্ত বনাম ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপ্রদত্ত লিজ পাওয়া ভুঁইফোঁড় মুনাফালোভী কোম্পানি – আন্দোলনরত আদিবাসী পরিবেশকর্মী টুয়াই রুমাহ জাম্বাইয়ের গাড়ি মলোটভ ককটেলে উড়িয়ে দেওয়া হল ২০১৪-র ডিসেম্বরে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হল, আগের বছর সামুরাই তলোয়ার দিয়ে টুয়াইয়ের ওপর প্রায়-প্রাণঘাতী হামলা হল। টুয়াই লড়াই ছাড়েননি। তবে, এইসব হত্যা বা হত্যার প্রচেষ্টায় গানম্যানদের শাস্তি হলেও আড়ালে থেকে যাচ্ছেন মাস্টারমাইন্ডরা। বিল কেয়ং চলে যাওয়ার পর সেভাবে দায়াকদের ঐক্যবদ্ধ করার আর কোনও বড় মুখ উঠে আসেননি …

২০১৫-র নভেম্বরে পার্লামেন্টারি অফিস থেকে একটি ক্যাম্পেনের সময়ে বিল কেয়ং (ছবিসূত্র – গ্লোবাল ইনিশিয়াটিভ)

 

অ্যান্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট। ব্রুনো ম্যানসার। সুইস চিকিৎসক থেকে পরে মেষপালক হয়ে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা ছিল বোহেমিয়ান ব্রুনোর। ১৯৮৪ সাল থেকে মালয়েশিয়ার সারাওয়াক রাজ্যের নোমাডিক আদিবাসী পেনানদের সঙ্গে থেকে ১৯৮৫ থেকে অবাধ বৃক্ষচ্ছেদনে সরাসরি রাস্তা ঘেরাওয়ে অংশ নিয়ে একসময় রাষ্ট্র-ঘোষিত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড এনিমি’ হয়ে গেলেন একদিন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ – ছ বছরের অভিজ্ঞতায় ডায়েরিতে লিখে রাখতেন পেনান আদিবাসীদের থেকে শুনে রাখা কথা, হাজার দশেক স্কেচ, ড্রয়িং। ‘ভয়েসেস অফ দ্য রেইনফরেস্ট’ থেকে মনে পড়ছে তেমনই সিনিয়র পেনান আদিবাসী ব্রুনোর মেন্টর আলং সেগা-র কিছু কথা, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় – ‘যখনই কোনও গাছ ভেঙে পড়ে বা বুলডোজারে কাটা হয়, তার শরীর থেকে যে রেজিন বেরোয়, তা আসলে রক্ত।’

 

১৯৯৯ সালে সারাওয়াক অরণ্যে মেন্টর আলং সেগার সঙ্গে ব্রুনো ম্যানসার (ছবিসূত্র – ব্রুনো ম্যানসার ফন্ডস)

 

১৯৯০ সালে ভয়েসেস ফর দ্য বোর্নিও রেইনফরেস্ট ওয়ার্ল্ড ট্যুরের আয়োজন, ১৯৯১-এর ১৭ জুলাই লন্ডনে জি-টোয়েন্টি সামিটের কাছে তিরিশ ফুট ল্যাম্পপোস্টে উঠে সারাওয়াকের বৃক্ষচ্ছেদন-বিরোধী ব্যানার উত্তোলন, বৃক্ষচ্ছেদন-বিরোধী প্রচারের জন্য তহবিল ব্রুনো ম্যানসার ফান্ড (বি.এম.এফ.) তৈরি, ১৯৯২-এর রিও-র আর্থ সামিটের একটি ভিড়ভর্তি স্টেডিয়ামে প্যারাশুট করে নামা, টোকিও এবং নিজের দেশে ট্রপিকাল টিম্বার-প্রোডাক্ট নিষিদ্ধ করার দাবিতে একাধিক হাঙ্গার-স্ট্রাইক – ডেয়ারডেভিল ব্রুনোর সিলেবাসে এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। নয়ের দশকের শেষের দিকে ইমিগ্রেশন আইন ভেঙে, একের পর এক ছদ্মবেশে আবার ঢুকলেন সারাওয়াকে। প্রধানমন্ত্রী এবং সারাওয়াকের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার প্রচেষ্টায় গ্রেপ্তার হলেন। এবং শেষমেষ ২৫ মে, ২০০০। একটি তিরিশ কিলোর রুকস্যাক নিয়ে বাটু লাওয়ি শৃঙ্গ ওঠার জন্য শেষ পেনান সঙ্গীকে বিদায় জানান ব্রুনো। দ্য রেস্ট ইজ আননোন। সারাওয়াকের বৃক্ষচ্ছেদন আটকাতে বারবার হতাশ হয়ে শেষমেশ অবসাদ থেকে আত্মঘাত? বিষাক্ত সাপ? নদীর গহন গভীরে ডুব? খাড়াই, বিপজ্জনক বাটু লাওয়ি থেকে পড়ে গিয়ে শেষ? ওই অভিশপ্ত ২৫ মে-র আশেপাশে পেনানল্যান্ডের দিকে একটু বেশিই আর্মি হেলিকপ্টার চোখে পড়েছিল পেনানদের, দুর্গম কিছু আর্মি ক্যাম্প দেখা যাচ্ছিল এখানে ওখানে। অর্থাৎ, গোপনে টিম্বার-মাফিয়াদের নেতৃত্বে ব্রুনোর শরীর লোপাটের জন্য এসব প্রস্তুতি? একশ শতাংশ বলা না গেলেও সন্দেহ থাকেই। শেষমেশ পেনান আদিবাসী দল, বি.এম.এফ. এবং খোদ রাষ্ট্র কর্তৃক একাধিক সার্চ এক্সপেডিশনের পর শরীরের চিহ্নমাত্র না পেয়ে ২০০৫-এর ১০ মার্চ ব্রুনো ম্যানসার মৃত বলে ঘোষিত হলেন। আরও দশ বছর পর রুয়েডি সুটার তাঁর সেমিনাল ‘রেইনফরেস্ট হিরো’ বইতে লিখলেন – ‘ব্রুনো’জ ফেভারিট মাউন্টেন উইল স্টিল স্ট্যান্ড ইভন ইফ নো মোর ট্রি’জ আর টু বি সিন অ্যারাউন্ড ইট – অ্যাজ আ মেমোরিয়াল টু ইভল্যুশন, ইন হুইচ আওয়ার একজিস্টেন্স ইজ শর্টার দ্যান দ্য ব্লিঙ্ক অফ অ্যান আই’।

 

 

 

 

 

 

 

পেনান আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে ব্রুনো ম্যানসারের কিছু মুহূর্ত (ছবিসূত্র – রুয়েডি সুটার-এর বই ‘রেইনফরেস্ট হিরো’)

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এভাবে অনেক কিছুই ঘন অরণ্যে ঢাকা। বৃক্ষচ্ছেদনে গাছ সাফ হয়ে গেলেও উত্তর এখনও অন্ধকারে। সামান্য আলোর টিমটিম আলোয় অন্ধকারের দীর্ঘ চাবুক। চোরাগোপ্তা খুন, ৭০ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পরেও ক্যারেনদের নেতৃত্বে ২০১৮-র ডিসেম্বরে আলো পেয়েছিল মায়ানমারের সলউইন পিস পার্ক। ৩৫০টি গ্রামের ২৭টি কমিউনিটি ফরেস্ট এবং তিনটি অভয়ারণ্যে জুড়ে বিস্তৃত এই পিস পার্ক পেয়েছে ২০২০-র গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্ট প্রাইজ এবং ইউ.এন.ডি.পি.-র ইকুয়েটর প্রাইজ। অন্তত ওইটুকু জায়গায় নিরাপদে বাঁচছে গাছ, ঘুরছে ক্লাউডেড লেপার্ড, সুন্ডা প্যাঙ্গোলিন। ব্রুনো হারিয়ে যাওয়ার দশ বছর পর ১৮টি পেনান কমিউনিটি মিলে ১,৬৩,০০০ হেক্টর অরণ্যে স্বঘোষিত ‘পেনান পিস পার্ক’-এর কাজ শুরু করেছিল। ব্রুনো ম্যানসার ফান্ডের সাহায্যে শুরু হল পেনানদের নেতৃত্বে ট্রাডিশনাল জমির ম্যাপিং, তাঁরা ঘুরে ঘুরে চিহ্নিত করেছিল ৫২০০ নদী এবং ১৮০০টি গাছের প্রজাতিকে, যার ভেতর পড়ে ব্লোপাইপ পয়জন অ্যারোর ‘ট্যাজেম ট্রি’ বা অ্যান্টিয়ারিস টক্সিকারিয়া। এই ম্যাপিংয়ের ফলেই একের পর কোর্ট কেসে অন্তত ৩৬০০ হেক্টর জমিতে পেনানদের নেটিভ কাস্টমারি রাইট সংক্রান্ত মামলা চলেছে সারাওয়াক ও সাবা হাইকোর্টে। অবশ্য আসমুদ্র পরিবেশ-লোপাটের লেগ্যাসিতে এইসব জয় কত আলো দেবে? ২০১৫ সালে সারাওয়াক করিডর অফ রিনিউয়েব্ল এনার্জি বা ‘স্কোর’-এর আওতাভুক্ত ১২টি বাঁধের অন্যতম ১৩০০ মেগাওয়াটের বারাম ড্যামের ওপর স্থগিতাদেশ পড়লেও, তা চিরতরে বন্ধের নির্দেশিকা নয়। যেকোনও সময়ে ২০,০০০ মানুষ ঘরছাড়া হবেন, বৃক্ষহীন হবে সারাওয়াক। সঙ্গে পরিবেশ-কর্মী হত্যার নতুনতর কোনও গল্প তৈরি হবে কোথাও। ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল মনোকালচারে শেষ হয়ে যাওয়া অসংখ্য ওরাংওটাং-দের ওপর নির্মিত প্যাট্রিক রৌক্সেলের ‘গ্রিন’ তথ্যচিত্রটির কথা মনে পড়ছে। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটিতে একটি ওরাংওটাং-এর শেষ কয়েকটা দিন তুলে ধরা। ফার্নিচার ব্যবসা, লাক্সারির পাশাপাশি একই ফ্রেমে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা মুমূর্ষু সেই ওরাংওটাং। চোখে জল, সিরিঞ্জে ওষুধ। ছবিটির এন্ড ক্রেডিট রোলে ছবিনির্মাতাদের কারও নাম ছিল না। লেখা ছিল –

 

‘ডিফরেস্টেশন ইন ইন্দোনেশিয়া ওয়াজ মেড পসিবল বাই উড ইন্ডাস্ট্রি, দ্য পাল্প অ্যান্ড পেপার ইন্ডাস্ট্রি, পাম অয়েল ইন্ডাস্ট্রি উইথ দ্য হেল্প অফ দ্য ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটউশন্স, ক্রেডিট এজেন্সিজ, ব্যাঙ্ক অ্যান্ড ইন্সিওরার্স, দ্য পলিটিসিয়ান্স, দ্য ট্রেডার্স অফ ইন্দোনেশিয়ান উড, পাল্প অ্যান্ড পেপার, দ্য কোম্পানিজ ডেভেলপিং বায়োডিজেল ফ্রম পাম অয়েল অ্যান্ড দ্য কনজিউমার্স অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড …’

 

‘গ্রিন’ ছবির সেই অসুস্থ ওরাংওটাং

 

ঋণস্বীকার

১. Bill Kayong: Faces of Assassination. June 21, 2016. Global Initiative.

২. Environmental activist killed in Indonesia. March 11, 2015. Friends of the Earth International.

৩. Firdaus, Febriana. Inside the weaving protest in West Timor. November 20, 2020. Mongabay.

৪. Indonesia: Protesters killed and injured on oil palm plantation in Bangkal, Borneo. October 9, 2023. Rainforest Rescue.

৫. Karokaro, Ayat S. Suspicions of murder in death of Indonesian environmental activist. October 9, 2019. Mongabay.

৬. Manser, Bruno. Voices from the rainforest: Testimonies of a threatened people. 2015. Strategic Information and Research Development Centre.

৭. Pearce, Fred. How protecting native forests cost a Southeast Asian activist his life. March 7, 2017. Yale Environment 360.

৮. Pearce, Fred. Amid tensions in Myanmar, an indigenous park of peace is borne. November 3, 2020. Yale Environment 360.

৯. Rakhman, Fathul, Nugraha, Indra (Trans. – Jacobson, Philips). Arson attack in Indonesia leaves activists shaken. February 1, 2019. Mongabay.

১০. Salim Kancil: Faces of Assassination. September 26, 2015. Global Initiative.

১১. Suter, Ruedi. Rainforest hero: the life and death of Bruno Manser. 2015. Bergli Books.

১২. Walker, Beth. Murder in Myanmar. December 19, 2016. The Third Pole.

১৩. Watts, Jonathan. Indigenous environmental campaigner killed by Myanmar Government. April 13, 2018. The Guardian.

১৪. Widianto, Stanley & Damiana, Jessica. Murder of Indonesia palm oil activists shows growing threat, rights group say. November 10. 2019. Reuters.

 

 

 

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *