পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ৫। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

(গত পর্বের পর)

‘আমার কিছুই বিক্রি করার নেই’ – পরিবেশ-কর্মী হত্যা ও এশিয়া’জ ডেডলিয়েস্ট কান্ট্রি

 

জেরার্ডো ওর্তেগা। বন্যপশুরোগের চিকিৎসক, সাংবাদিক, স্থানীয় রেডিও কমেন্টেটর, পাঁচটি ইকোট্যুরিজম প্রোজেক্ট এবং ক্রোকোডাইল প্রোজেক্টের পথিকৃৎ। ১৯৮৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ক্রোকোডাইল ফার্মিং ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা থাকাকালীন শুরু করলেন ক্রোকোডাইল ফার্ম প্রোজেক্ট – সংরক্ষণ চলল অসংখ্য ক্রিটিকালি এন্ডেঞ্জার্ড মিন্ডোরো ক্রোকোডাইলের। ২০১১-য় পালাওয়ান কাউন্সিল ফর সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট স্থানীয় একটি মাইনিং প্রোজেক্টকে ক্লিয়ারেন্স দিলে জেরি গর্জে উঠেছিলেন। পালাওয়ানে মাইনিং নিষিদ্ধ করার জন্য ‘টেন বিলিয়ন সিগনেচার’-এর নেশায় ছুটতে থাকলেন গোটা দেশ। ২০০৬ থেকে ২০১০ অবধি চলা প্রাইমটাইম শো টিভি পেট্রোল এবং বেশ কিছু রেডিও কমিউনিটির হয়ে পরিবেশ সমস্যাগুলি নিয়ে ভোকাল ছিলেন জেরি। ২০১১-র ২৪ জানুয়ারি রেডিও শো ‘রামাটেক’ হোস্ট করে ম্যানিলায় টেন বিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেনে যাবেন বলে মাঝে পুয়ের্তো প্রিন্সেসার একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড স্টোরে গিয়ে পোশাকের ট্রায়াল দিচ্ছিলেন। মাথার পেছনে গুলি। হিটম্যান ধরা পড়লেও খুনের মাস্টারমাইন্ড পালাওয়ানের এক গভর্নর দিব্যি পরবর্তী ভোটে নামার তোড়জোড় করেছেন। চলেফিরে বেরিয়েছেন জেরির পালাওয়ানে। বাইশ বছর পর সম্প্রতি ২০২৩-এর জুলাইয়ে রিজিওনাল ট্রায়াল কোর্ট মারফত নতুন অ্যারেস্ট অর্ডার দিয়েছে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। খবরের বাকিটা জানা নেই। ১৯৮৬ সাল থেকে দেশের নিহত ১৪২-তম সাংবাদিক সাতচল্লিশ ছোঁওয়া জেরি, ফিলিপিনোদের স্নেহের ‘ডক জেরি’। সাইলেন্সড ফর এভার। ঘরে স্ত্রী, পাঁচ সন্তান …

স্বামী জেরির ছবি হাতে প্যাট্রিয়া ওর্তেগা (ছবিসূত্র – এএফপি)

 

উত্তর ফিলিপিন্সের বাটান প্রভিন্স। ম্যানিলা বে’র মারিভেলিসের লুকানিন গ্রামের গ্লোরিয়া কাপিতান সাতান্ন পেরোচ্ছিলেন। রেস্তরাঁ খুলেছিলেন। স্থানীয় স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে এসে বন্ধ করে দেওয়া হল। টুকটাক আয় হতো। হল না। রেস্তরাঁ পাল্টে খুললেন কারাওকে বার। আঠারোজন নাতিনাতনি, সঙ্গে গ্র্যান্ডমা গ্লোরিয়া এবং ক্ষয়ে আসার লেগ্যাসি। গ্লোরিয়া দেখছিলেন ছোটদের অ্যাজমা বেড়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে, সঙ্গে শ্বাসজনিত আরও অনেক অসুখ। হাত, পা, পিঠের চামড়ায় গোল গোল দাগ। বাড়ির নারকেল, আম গাছের পাতায় ধুলোর স্তর। কিসের ধুলো। গ্লোরিয়া কাপিতান বনাম মাইনিং জায়ান্ট লড়াই তখন থেকেই। গোটা বাটান প্রভিন্স জুড়ে সান মিগুয়েল কর্পোরেশন, পেট্রন কর্পোরেশনের মতো কোল-মাইনিং জায়ান্টদের বাড়তে থাকা তাণ্ডব। কোল-অ্যাশের দাপটে শ্বাসরুদ্ধ লুকানিন বা লিমাও বারাঙ্গে (‘বারাঙ্গে’ অর্থাৎ গ্রাম) সহ বাটানের অধিকাংশ ছোট ছোট গ্রাম, আধা-শহর। বাটান প্রভিন্সের লিমাই বাল্ক অ্যান্ড হ্যান্ডলিং টার্মিনালের সাবসিডিয়ারি সি-ফ্রন্ট শিপইয়ার্ড অ্যান্ড পোর্ট টার্মিনাল সার্ভিসেস কর্পোরেশন ওপেন কোল স্টোরেজ ফেসিলিটি বানিয়েছিল গ্লোরিয়াদের রেস্তোরাঁর কিছু দূরেই। সঙ্গে বেশ কিছু চলতে থাকা কয়লা খনির এক্সপ্যানশন। কয়লার ধুলো। এক গ্লোরিয়া থেকে আরেক গ্লোরিয়া। ‘কোল–ফ্রি বাটান মুভমেন্ট আন্দোলন’ – পিটিশনে সই করলেন এক এক করে ২০০০ জন। গ্লোরিয়া নিজে ৫০০০ জন গ্রাসরুট ক্যাম্পেনারকে নিয়ে শুরু হওয়া ফিলিপিন্স মুভমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসে ছিলেন, যার ষাট শতাংশ শতাংশ সমাজের সো-কলড সেকেন্ড সেক্স। নারীত্বের গর্জন নিতে পারেনি তথাকথিত পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত প্রো-কর্পোরেট ফিলিপিন্স। ২০১৬-র ১ জুলাই। দুই নাতির সামনে বছর সাতান্নর গ্লোরিয়ার ঘাড়ে, কাঁধে একাধিক ফেটাল বুলেট। ছোটদের একজনের হাতে গুলি। সে জীবনের দিকে ফিরে এসেছিল, কোনওভাবে। তবে গ্লোরিয়া পারেননি। দেশের ষোড়শ রাষ্ট্রপতি রডরিগো ডুটের্টের ক্ষমতায় আসার পরের দিন দেশের প্রথম পরিবেশ-কর্মী হত্যা এই গ্লোরিয়া কাপিতানকে দিয়েই। অ্যান্ড দ্য স্টোরি কন্টিনিউজ …

 

উপরে কোল স্টোরেজ বিরোধী আন্দোলনে গ্লোরিয়া কাপিতান (বাঁদিক থেকে তৃতীয়) ও নিচে বাটানের কারাওকে বারের যে চেয়ারে বসে গুলিবিদ্ধ হন গ্লোরিয়া (ছবিসূত্র – ফোকাস অন দ্য গ্লোবাল সাউথ)

 

ফিলিপিন্স। পরিবেশ-কর্মী হত্যার গল্পের শুরু কোথায়? শেষ কোথায়? এশিয়া’জ মোস্ট ডেডলি কান্ট্রির পরিবেশ-কর্মী হত্যার ছবিটা কেমন? গ্লোবাল উইটনেসের সমীক্ষা বলছে, ২০১৯, ২০২০, ২০২১ ও ২০২২-এ গোটা পৃথিবীর হত্যার সংখ্যা যথাক্রমে ২১২, ২২৭, ২০০ ও ১৭৭। এখানে ফিলিপিনো কর্মী-হত্যার সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ৪৩, ২৯, ১৯ ও ১১। গোটা পৃথিবীর হিসেবে পাঁচে এবং এশিয়ার মোট ১৬টি হত্যার ভেতর একাই ১১টির ডেটাবেস নিয়ে মহাদেশের শুরুতেই ফিলিপিন্স। ২০১২ থেকে ২০২২ সময়সীমায় পৃথিবীর মোট ১৯১০-টি হত্যার ভেতর ফিলিপিন্সেই সেই সংখ্যা ২৮১, যার এক-তৃতীয়াংশ অ্যান্টি-মাইনিং ক্যাম্পেন থেকেই। এবং এই ২৮১টি হত্যার শিকার ৪০ শতাংশই দেশের আদিবাসী অংশ। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২২-এর ভেতর মোট ১.৪২ মিলিয়ন হেক্টর ট্রি-কভার লসের ১৩ শতাংশ অর্থাৎ ১৮৫ কিলোহেক্টর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল জেরি ওর্তেগার সেই পালাওয়ান, যেখানে ২০০১ থেকে ২০২২-এর ভেতর ট্রি-কভার শেষ হয়েছে মোট ২০২ কিলোহেক্টর। এবং লস অফ হিউম্যান রিসোর্স। শাসক থেকে শাসক বদলের পরেও ক্রমাগত চলা চোরাগোপ্তা বা রাষ্ট্রকর্তৃক প্রকাশ্য হত্যা, ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স, কমিউনিস্ট জুজু রেড ট্যাগিং, কর্পোরেট আঁতাত – দেশের রাজনৈতিক ব্লাডশেডের সঙ্গে এনভায়রনমেন্টাল ক্রুসেড মিলেমিশে তোলপাড়।

পালাওয়ান অঞ্চল এবং বীভৎস বৃক্ষচ্ছেদনের লেগ্যাসি (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

 

জেরি-গ্লোরিয়াদের গল্পের শুরু ম্যাকলিং ডুলাগের হাতে। ১৯৭৪ থেকেই চিকো নদীর ওপর চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি তদারকি করছিল ন্যাশনাল পাওয়ার কর্পোরেশন। আগের বছরেই স্থানীয়দের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই সরকারকে চিকো ড্যামের টেকনিকাল ফিজিবিলিটির ‘রিপোর্ট’ দেয় জার্মান কোম্পানি লেমেয়ার ইন্টারন্যাশনাল। এই চারটির মধ্যে ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলের আদিবাসী ধানজমি, বাগান এবং পবিত্র কবরখানাকে কেড়ে নেওয়া শুধু চিকো-ফোর বাঁধ দেওয়ার পেছনেই ছিল লাখখানেক আদিবাসী উচ্ছেদের কোল্ড-ব্লাডেড পরিকল্পনা। ’৭৪ থেকেই ম্যাকলিং-এর নেতৃত্বে প্রতিরোধ। ১৫০ জন স্থানীয় বোনটোক ও কলিঙ্গ আদিবাসী মিলে একত্রে তৈরি করল বোডং বা পিস ফেডারেশন। সরকার সাময়িক সরলেও ’৭৫-এর ডিসেম্বরে নখ দাঁত বের করল আবার। চারটি বাঁধের মধ্যে নেকড়ের মতো দেখা সাদাঙ্গা অঞ্চলের চিকো-টু ও কলিঙ্গর টিংলায়ানের চিকো-ফোর দখল করতে রাষ্ট্রকর্তৃক তৈরি হল কলিঙ্গ স্পেশাল ডেভেলপমেন্ট রিজিয়ন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮১-র সেই কুখ্যাত মার্কোস জমানা এবং মার্শাল ল। বাঁধ এলাকায় ‘ফ্রি-ফায়ার জোন’ তৈরি করে সেনার হাতে একচ্ছত্র গুলিবর্ষণের অর্ডার। ’৭৭-এ ম্যাকলিং সহ আন্দোলনকর্মী-নেতৃত্বদের জেল, যদিও বেরিয়ে এসেই তাঁদের সোচ্চার প্রতিরোধে ’৭৮ ও ’৭৯-র দু’দুটো বোডং পিস ফেডারেশন। হাজার দুয়েক কলিঙ্গ-বোনটকের যুগপৎ মুষ্টি, চিৎকার। নেতৃত্বে ম্যাকলিং। আপসহীন ম্যাকলিং, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যান্টি-জাপান গেরিলা ফিলিপিনোদের সঙ্গে পোর্টার হিসেবে থাকা পঞ্চাশ ছুঁতে চলা ম্যাকলিং ডুলাগের কলিঙ্গদের বুগনাই গ্রামে নিজের বাড়িতে এক শান্ত রাত দশটায় ১৯৮০-র ২৪ এপ্রিল আকস্মিক ব্লাডশেড। দরজার ফাঁক দিয়ে ফিলিপিনো সেনার দশ দশটা বুলেট। ম্যাকলিং ঝাঁজরা হয়ে গেলেও কোনওক্রমে বাঁচেন আরেক পরিবেশকর্মী পেদ্রো ডুঙ্গক সিনিয়র। ম্যাকলিংয়ের রক্তের দামে, তুমুল বিতর্কে প্রোজেক্ট থেকে হাত তুলে নেয় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। এবং একটা সময়ে হেরে যায় রাষ্ট্র। ম্যাকলিং চলে গেলেও চিকো নদীর বুকে আঁচড় পড়েনি আর …

ম্যাকলিং ডুলাগ ও কলিঙ্গদের প্রতিবাদী আন্দোলন (ছবিসূত্র – মার্শাল ল মিউজিয়াম)

 

‘৭২ থেকে ’৮১-র কুখ্যাত মার্শাল ল – রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হত্যা ৩২৫৭, শারীরিক অত্যাচার ৩৫,০০০, ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ৭৭, গ্রেপ্তার ৭০,০০০। জমি অধিকার রক্ষা, সাংবাদিকতা, প্রো-কর্পোরেট রাষ্ট্রের পরিবেশ-লোপাট আটকাতে জোরদার পরিবেশ-আন্দোলন – ফিলিপিন্সে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে এভাবেই মিশে ছিল পরিবেশকর্মী হত্যার ডেডলিয়েস্ট দিকগুলো। সঙ্গে ছিল কুখ্যাত ‘রেড টাগিং’ বা কমিউনিস্ট-নিধনের পুঁজিবাদী লেগ্যাসি। কর্ডিলেরা ও ইল্লোকোস অঞ্চলের সেভ দ্য আব্রা রিভার মুভমেন্ট বা স্টার্ম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রোমিও সাঞ্চেজ বেঙ্গুইয়েত এলাকার বাগুইয়ো সিটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চলে যান। অথবা জিমি লিগুয়ন। ৩২,০০০ হেক্টর জমি, ভিটেমাটি মাইনিং জায়ান্টকে দেওয়ার জন্য ‘সার্টিফিকেট অন অ্যানসেস্ট্রাল ডোমেইন টাইটেল’ পাওয়ার তোষামুদে জোট এগ্রিমেন্ট ‘সানমিত্রিদা’-তে সই করতে চাননি জিমি। ২০১২-র ৫ মার্চ মাটিগসালোগ আদিবাসীর এই নির্ভীক নেতৃত্বের শরীরে ফেটাল বুলেট। ক্রিউ মিনারেলসের অবৈধ মাইনিং নিয়ে কথা বলে ২০০২-এর ৭ এপ্রিল মিন্ডোরোর সান টেওডোরো এলাকায় সেনা আক্রমণে খুন হন দম্পতি ম্যানুয়েলা ও এক্সপেডিটা আলবারিল্লো, তাঁদের ছিন্নভিন্ন শরীর পাওয়া যায় পরের দিন। ২০১৫-র ২৯ জুলাই সাগনে টুনা ফিশিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি বছর তেত্রিশের তরুণী গের্লি মেঞ্চি আলপাজোরাকে ইল্লিগাল ফিশিং নিয়ে ভোকাল থাকার খেসারত দিতে হয় দুই ছেলের সামনে গানশটে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ম্যাটুটামের দশ কিলোমিটারের পরিসীমার ভেতরে স্যাজিটারিয়াস মাইন্স ইনকর্পোরেশনের ট্যাম্পাকান গোল্ড কপার প্রোজেক্টের রাষ্ট্রকর্তৃক বিপজ্জনক ক্লিয়ারেন্সের বিরুদ্ধে ভোকাল ছিলেন মিন্ডোরোর সাউথ কোটাবোটোর আদিবাসী কর্মী দাগুইল ক্যাপিয়ন, পাশে স্ত্রী, পরিবার, কমিউনিটি। ২০১২-র ১৮ অক্টোবর দাগুইলকে টার্গেট করে এসে ঘরে না পেয়ে সেনাকর্তৃক বুলেটে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয় ৮ ও ১২ বছরের দুই পুত্রসন্তানসহ স্ত্রী বছর সাতাশের তিন মাসের অন্তসত্তা তরুণী জুভি ক্যাপিয়নকে। ২০১৭ সালে দেশের পরিবেশ মন্ত্রকের সেক্রেটারি রেজিনা লোপেজ বিতর্কিত ট্যাম্পাকান সহ ২৩টি মাইনিং প্রোজেক্ট ক্লোজার, আরও পাঁচটিকে সাসপেনশন করেন, সঙ্গে ৭৫টি মাইনিং কনসেশন কন্ট্যাক্ট নাকচ করেন। পরিণতিতে প্রো-এনভায়রনমেন্ট রেজিনাকে বাধ্য করা হয় রেজিগনেশনে। ২০২০ সালে পারমিটের ডেডলাইন বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বারো বছরের এক্সটেনশন পেয়ে যায় ট্যাম্পাকান। বলা হয় ‘আন্ডার দ্য র‍্যাডার অফ দ্য কমিউনিটি’। অথচ কোটাবোটোর আদিবাসীদের কনসাল্টেশন ছাড়াই।

 

রেড ট্যাগিং এবং পরিবেশ-কর্মী হত্যার লিঙ্কেজ এখনও চলছে। চলছে পরিবেশকর্মীদের ওপর চোরাগোপ্তা টেরোরিস্ট-ট্যাগিং। গত বছর অ্যান্টি টেরোরিজম কাউন্সিল থেকে পরিবেশকর্মী এবং আদিবাসী অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত কর্ডিলেরা পিপলস অ্যালায়েন্সের চারজন কর্মীকে টেরোরিস্ট তকমা দিলেও আশার কথা রিজিওনাল কোর্ট থেকে সেই অভিযোগ নস্যাৎ করা হয়েছে। পাশাপাশি আছে নিকেল-লোভের লোভনীয় লেগ্যাসি। বিশেষ আকৃতি এবং ফ্লোরা-ফনার তীব্র সহাবস্থানের জন্য ‘গ্যালাপাগোস অফ এশিয়া’ নামে পরিচিত সিবুয়ান দ্বীপের নিকেল রিজার্ভে নজর রাখা কানাডীয় কোম্পানির সাবসিডিয়ারি আলটাই ফিলিপিন্স মাইনিং কর্পোরেশনের বেপরোয়া মাইনিং-এর বিরুদ্ধে স্থানীয়রা বিরাট এক ব্লকেজ করেছিল ২০২৩-এর ২ ফেব্রুয়ারি। কোম্পানির ভয়ঙ্কর ট্রাককে আটকাতে সামনে ঝাঁপিয়ে কোনওমতে পিষে যাওয়া থেকে বেঁচে ফেরেন বছর তেষট্টির গেস্টহাউস ম্যানেজার ফার্নান্দো উই মার্টিন। এবং ঠিক আগের দিন এক্সপোর্ট পারমিটের মেয়াদ ফুরনো আলটাই ফিলিপিন্সের মাইনিং টিমের ট্রাককে সিবুয়ান-জনতার ব্যারিকেড ভেঙে বের করে আনতে প্রকাশ্যে মদত দিয়েছিল পুলিশ।

‘গ্যালাপাগোস অফ এশিয়া’ সিবুয়ান দ্বীপ (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

মাইনিং কোম্পানির ট্রাকের সামনে ঝাপিয়ে পড়া গেস্টহাউস ম্যানেজার ফার্নান্দো উই মার্টিন (ছবিসূত্র – রেস্ট অফ ওয়ার্ল্ড)

 

অন্যদিকে এনভায়রনমেন্টাল কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেটের মেয়াদ ফুরলেও দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ পালাওয়ানের মাউন্ট মান্টালিঙ্গাহান প্রোটেক্টেড ল্যান্ডস্কেপে অন্যায় নিকেল মাইনিং চালাচ্ছিল সিলেস্টিয়াল নিকেল মাইনিং এবং ইপিলিয়ান নিকেল কর্পোরেশন। ব্রুক পয়েন্ট অঞ্চলের পালাওয়ান ইন্ডিজেনাস কালচারাল কমিউনিটিজের পিটিশনে ২০২৩-এর ১৬ আগস্ট দেশের পরিবেশ মন্ত্রক ও খনিজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে ‘রিট অফ কালিকাশান’ আদেশনামা জারি করে সুপ্রিম কোর্ট, যা টেম্পোরারি এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন অর্ডারে আসার জন্য প্রতীক্ষিত। ন্যাশনাল কমিশন অন ইন্ডিজেনাস পিপলস থেকে কোম্পানিকে ধরানো হয়েছে ইমিডিয়েট সিজ-অ্যান্ড ডেসিস্ট অর্ডার। এই মাউন্ট মান্টালিঙ্গাহান প্রোটেক্টেড ল্যান্ডস্কেপের ২০ হেক্টর জমিতে ৭০০০ গাছ ধ্বংস করার জন্য ২০১৭ সালে ব্রুক পয়েন্ট মিউনিসিপালিটির মেয়র মেরি জিন ফেলিসিয়ানো ইপিলিয়ান নিকেল কর্পোরেশনকে স্টপেজ অর্ডার ধরিয়ে পরের বছর ফেসিলিটির কমপ্লিট ক্লোজারে বাধ্য করেন। পরিণতি খুব প্রত্যাশিত। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিকেল উত্তোলক কোম্পানির সাবসিডিয়ারি ইপিলিয়ানের পক্ষ থেকে ফিলিপিন্স ওমবাডসম্যানে অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২১-এর জুলাইয়ে উইদাউট পে সাসপেনশন পুরস্কার জোটে মেরির। অপরাধ – ‘গিল্টি অফ অপ্রেশন অর গ্রেভ অ্যাবিউজ অফ অথরিটি’। অর্থাৎ, এশিয়া’জ মোস্ট ডেডলি কান্ট্রিতে পরিবেশ রক্ষার সংজ্ঞা ‘গ্রেভ অ্যাবিউজ অফ অথরিটি’। ঘাতক কোম্পানির বিরুদ্ধে যাওয়া আসলে ‘গিল্টি অফ অপ্রেশন’ …

 

পরিবেশ রক্ষায় ইপিলিয়ান নিকেল কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় সাসপেন্ড হওয়া পালাওয়ানের ব্রুক পয়েন্টের মেয়র মেরি জিন ফেলিসিয়ানো (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

 

’২৩, ’২৪, ‘২৫ – এভাবেই কাঁটা এগোবে। হারজিতের সি-স’ উঠবে নামবে। হারের তুমুল ব্লাডশেডের ভেতর মাঝে মাঝে শান্ত ভিক্ট্রি ল্যাপের ব্যারিকেড তৈরি করবে আদিবাসী ফিলিপিনোরা। গ্লোরিয়া কাপিতান চলে যাওয়ার পরের বছর গোটা বাটান প্রভিন্স জুড়ে চলা ১৯টি কোল-পাওয়ার স্টেশনের স্পনসর ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে কমপ্লায়ান্স অ্যাডভাইসর ওমবাডসমানে অভিযোগ জানানো ১৩টি পিটিশন সংস্থার ভেতর অন্যতম ছিল গ্লোরিয়ার কোল-ফ্রি বাটান মুভমেন্ট। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ২০২২-এর সার্কুলারে আই.এফ.সি. নতুন সবরকম কোল প্রোজেক্ট থেকে হাত তুলে নিয়েছে। গ্লোরিয়ার রাস্তায়, বন্ধুর রাস্তায় এখনও হেঁটে যাচ্ছেন নিউক্লিয়ার অ্যান্ড কোল-ফ্রি বাটান মুভমেন্টের কো-অর্ডিনেটর ভেরোনিকা ‘ডেরেক’ কেব। এক্সন মোবিল, বিপি, শেভরনের মতো কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ কার্বন এমিশনের জন্য ২০১৫ সালে ফিলিপিন্সের কমিশন অন হিউম্যান রাইটসে পিটিশন দেন গ্রিনপিসের সঙ্গে হাত মেলানো ভেরোনিকারা। ক্রমশ বাড়তে থাকা সিভিয়ার টাইফুন আক্রান্ত ফিলিপিন্সে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্লোবাল কর্পোরেশনগুলি ভবিষ্যতে দায়ী ত্থেকে যাবে – এই মর্মে দৃষ্টান্তমূলক রিপোর্ট বের করে কমিশন। সব মিলিয়ে জয়। একেবারেরই বিশ্বাসহীন প্রশাসন বনাম এইসব ছোটখাটো, দেরি করে আসা জয়। ম্যাকলিং, জেরি, গ্লোরিয়াদের কথা, তাঁদের হাঁটা পথ। এসবের উল্টোদিকে প্রশাসন, কাট-টু-কাট স্ক্রিন সরে যাওয়া ‘রাজা আসে যায়, রাজা বদলায়’। পোশাকের রং ছাড়া তেমন কিছু বদল হয় না। রাষ্ট্রনীতির বদল হয় না। শুধু ফিলিপিনো সেই প্রবাদটি স্পষ্ট হয় আরও – ‘ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু ওয়েক আপ সামওয়ান হু ইজ প্রিটেন্ডিং টু বি অ্যাস্লিপ …’। স্পষ্ট হয় অ্যান্টি-ড্যাম ক্যাম্পেন থেকে সরে আসার জন্য সরাসরি ঘুষ বা হুমকি দেওয়া চিঠি ধরানো খাম প্রত্যাখ্যান করে চলে আসা ম্যাকলিং ডুলাগের সেই কথাগুলো – ‘খামে দুটো জিনিস থাকতে পারত। হুমকি চিঠি, অথবা টাকা। আমি তো পড়তে পারি না। তাই কোনও চিঠিই আমার জন্য না। এবং টাকা তাদেরই দেওয়া হয় যারা কিছু বিক্রি করতে এসেছে। আমার কিছুই বিক্রি করার নেই …’

ম্যানিলায় অ্যান্টি-কোল মুভমেন্ট চলাকালীন গ্লোরিয়া কাপিতান (বাঁদিকে) ও ভেরোনিকা ‘ডেরেক’ কেব (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

ভেরোনিকা ‘ডেরেক’ কেব (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

 

 

ঋণস্বীকার

১. Aspinwall, Nick. Angry Philippine islanders are trying to stop the great nickel rush. August 30, 2023. Rest of World.

২. Cabe, Veronica ‘Derek’. ‘Not just a climate change statistic’: Derek Cabe on the frontline of the climate crisis in the Philippines. October 18, 2022. Global Witness.

৩. Cabe, Veronica ‘Derek’. Seven years after the murder of Gloria Capitan our struggle has grown into a climate movement. July 1, 2023. Global Witness.

৪. Castillo, Galileo de Guzman. Glory to the captain: a photo essay on Gloria Capitan and anti-coal movement in Bataan. August 2, 2016. Focus on the Global South.

৫. Chavez, Leilani. The fight goes on for opponents of a Phillipine mine given a new lease of mine. March 9, 2020. Mongabay.

৬. Dale, Penny. Killing the truth: the case of Gerry Ortega. March 30, 2022. Open Democracy.

৭. Deadly Environment: The dramatic rise and killings of environmental and land defenders. June, 2017. Global Witness.

৮. Delina, Lawrence L. Indigenous environmental defenders and the legacy of Macli-ing Dulag: anti-dam dissent, assassinations, and protests in the making of Philippine energyscape. July, 2020. Energy Research and Social Science.

৯. Drungmand, Dana. Nearly 200 environmentalists were murdered for their work in 2022. September 13, 2023. DeSmog.

১০. Drury, Madeleine. Killed for campaigning: meet the women fighting the coal giants. February 12, 2021. Euronews.

১১. Fabro, Keith Anthony S. A mayor in the Philippines took on a mine, and lost her job over it. February 11, 2022. Mongabay.

১২. Fabro, Keith Anthony S. Indigenous community fighting a mine in Palawan wins a milestone legal verdict. September 25, 2023. Mongabay.

১৩. Fabro, Keith Anthony S. Who were the 11 Philippines environmental defenders killed in 2022? September 21, 2023. Mongabay.

১৪. Leather, Ben. Defending the Philippines. September 24, 2019. Global Witness.

১৫. Malik, Laila. “I will only stop when my eyes closed” – why we must keep WHRD’s stories alive? July 16, 2019. Whose Knowledge.

১৬. Muller, Maya. The murder of Gerry Ortega: justice delayed; justice denied. May 11, 2022. Free Press Unlimited.

১৭. Pasimio, Judy A. The Philippines: defending the defenders, defending their rights. July 10, 2017. World Rainforest Movement.

১৮. Tran, Delena. Women defending our earth. March 8, 2022. The Ecologist.

১৯. Watts, Jonathan. Philippines is deadliest country for defenders of environment. July 30, 2019. The Guardian.

২০. Willis, Jake. Nickel mine threatens Philippines biodiversity hotspot on Sibuyan Island (analysis). December 6, 2023. Mongabay.

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *