উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২২। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

ঘরে ফেরার পালা

আর বেশিদিন থাকা হল না সেখানে। ইচ্ছা ছিল পূর্ণগঠনের সাক্ষী থেকে যাবো। হল না। স্বাধীনতার মাস দুয়েকের মধ্যে কীই বা হতে পারে! বিদেশী সাহায্য ঢুকছে। মানুষের পেটে দুটো ভাত পড়ছে। দাদুর বাড়ির ধানের গোলা শূন্য। রাজাকাররা সব লুঠ করে নিয়ে গেছে। মামা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। কোথা থেকে যেন চাল নিয়ে আসে। কোথা থেকে কী আসছে টের পেলাম না। আমার ছোটদাদুর ছেলে কাকান, সে প্রায় রোজ নদীতে বালতি নিয়ে মাছ ধরতে যায়। যা পায়, দু-তিন বাড়ি ভাগাভাগি হয়। তিন বাড়ি, কারণ পাশাপাশি দুই দাদুর পাশেই ছিল আরেক দাদুর বাড়ি। আমরা বলতাম লাল দাদু। তিনি ছিলেন শিকারী। ছিল দুনলা একটা বন্দুক। তিনি তখন নেই আছে তার একমাত্র পুত্র সন্তান বাবলু মামা। সে তখন যুবক। জেনেছিলাম আওয়ামি লীগ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোথায় ছিল কেউ জানে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার দেখা গেল তাকে। বাড়িতে সারাদিন প্রায় থাকে না। সভা করতে এখানে ওখানে যাচ্ছে। বাজারের এদিকে ত্রাণ দেওয়া হয়, তারই তদারকি কবে। অনেক বছর পরে শুনেছিলাম গ্রামে মেয়েদের জন্য একটা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই ছিল প্রধান শিক্ষক। এখন তার অবসর জীবন চলছে।

বেশিদিন আর থাকা হল না বাংলাদেশে। রেডিওতে ঘোষণা হল সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বাবলু মামা খবর দিল, অবাধ পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে তিনদিনের মধ্যে। চালু হচ্ছে পাশপোর্ট। সীমান্ত বন্ধ হওয়ার আগের দিন ভোর বেলায় রওনা দিলাম। পরনে পাজামা পাঞ্জাবী, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। তাতে পরিধেয় দু-চারটে বস্ত্র। আছে একটা লেখার খাতা আর কলম। মাস দুয়েক ক্ষৌর কর্মের অভাবে চুল আর দাড়ি বেশ বড় হয়ে গেছে। দাদু দিলে পথ খরচা কিছু ভারতীয় টাকা, আর একটা চিঠি। ভারত সীমান্তে ঢুকে এক মহিলাকে দিতে হবে। সঙ্গে এলো এক যুবক। সে সঙ্গী হবে সীমান্ত পর্যন্ত। তারপর ফিরে যাবে। রওনা দিয়েছি পদব্রজে। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে পরিচিত গ্রাম। সাড়ে চার-পাঁচ মাইল পথ। কতই বা সময় লাগবে! গ্রামের পর গ্রাম পেরোতে পেরোতে কুতুবপুরে এসে থামলাম। পথের পাশে বিশাল বাড়ি আকবর মিঞার। নাম শুনেছি। দেখিনি কোনওদিন। তিনি নেই, আছে উত্তরাধিকার। সঙ্গী যুবক, সেও খ্রিশ্চান, বলল, এরা সব মুসলিম লীগের লোক।

চোখ বুলিয়ে বিলাস বাড়িটার দিকে। যুদ্ধের কোনও চিহ্নই পড়েনি সীমান্তের কোল ঘেঁষা এই বাড়িতে। আবার হাঁটি। মুনশিপুর। এবার খাল পেরোতে হবে। বাংলাদেশের কিছু পুলিশ ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। কাঁধে দিশি বন্দুক। সঙ্গী যুবক বলল, এরা মুক্তিফৌজ। এখন পুলিশ। বর্ডারে লক্ষ্য রাখে। আর রাজাকারদের খোঁজ করছে। বুঝলাম বিশ্বাসঘাতকদের খোঁজ চলছে, এখনও। জানলাম রোজই দু-চারজন ধরা পড়ছে। আমাদের দেখে এক মুক্তি ফৌজ এগিয়ে এলো। পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হতেই হাতে রাখল হাত। কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল তার গলায় ভারতীয়দের জন্য। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। ঘরে ফিরে যাচ্ছি শুনে সে উষ্ণ বিদায় জানাল। সঙ্গী যুবককে বিদায় জানিয়ে জলে নামলাম।

ওপারে মুনশিপুর, এপারে হাটখোলা। খাল পেরিয়ে এপারে এসে বড় শ্বাস নিলাম। আমার বাংলার বাতাস টেনে নিলাম বুকের ভিতর। এগিয়ে গেল খালার বাড়ির দিকে। দাদু বলে দিয়েছিল খালার সঙ্গে দেখা করে যেতে। হাতে একটা দুকলম লেখা দাদুর হাত চিঠি ছিল। খালের পাড় ঘেঁষা বাড়ি। খড়ের চালা পোঁতা মাটির ঘর। উঠোন থেকে বেশ উঁচু দাওয়া। চারটে সিঁড়ি পেরিয়ে দাওয়ায় উঠতে হয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়লাম, খালা আছো?

ঘরের এক পাশে ছেঁড়া বেড়ার রান্নাঘর। উপরে টিন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো খালা। গায়ের ফর্সা রঙ রোদ খেয়ে খেয়ে মেটে হয়ে গিয়েছে। পৃথুলা মহিলার শরীরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল বলল, ও, তুমি এয়েছো।

দাদু যে হাতচিঠি দিয়েছিল, সেটা দিলাম। খালা হাতে নিল বটে, খুলেও দেখল না। শাড়ির খুটে বেঁধে রাখল। জিজ্ঞাসা করল, কখন বেরিয়েছো?

উত্তর দিলাম, ভোরে।

খালা দাওয়ায় উঠে একটা পুরনো তেলচিটে খিলের মাদুর বিছিয়ে দিয়ে বলল, বসো।

আমি দাওয়ায় উঠে বসলাম। খালের জলে হাত-মুখ ধোয়া হয়ে গেছে। ব্যাগে রাখা গামছা দিয়ে মুছেটুছে খালার বাড়িতে প্রবেশ করেছি। বলল, দুপুরে দুটো খেয়ে যাবা।

বললাম, না খালা, আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে। আরেকদিন এসে থাকব।

কোনও উত্তর না দিয়ে খালা রান্নাঘরে চলে গেল। একবাটি মুড়ি আর এক টুকরো পাটালি এনে সামনে রাখল। বলল, কোন সকালে বেরিয়েচো দুটো গালে দাও।

খিদে পেয়েছিল ঠিকই। বড্ড খিদে। পেটের ভিতর হাঁকড়-পাকড় করছিল। কোনও উত্তর না দিয়ে একগাল মুড়ি মুখে দিয়ে পাটালিতে কামড় দিলাম। খালা ততক্ষণে বড় কাঁসার গেলাসে এক গ্লাস জল এনে রেখেছে। দ্রুত বাটির মুড়ি সাবাড় করে এক গেলাস জল গলায় ঢেলে যেন শান্তি। মুড়ি শেষ করে বসে আছি, ভাবছি উঠব, তখনই এক কাপ চা সামনে হাজির। গরুর দুধের চা। কিন্তু রঙ এতো কালো হয় কি করে কে জানে! বললাম, খালা এবার যাবো।

-আবার কবে আসবা?

-দেখি।

-সাবধানে যেও। হ্যাঁগা, তোমার দাদুর শরীল কেমন আছে?

-ভালো।

-তোমার দিদা, মামি? ঘরটর তুলছে, ভিটেয় নাকি তামাকের চাষ করেছে, তোমার মামা বলছিল।

আবার বসতে হল দুদণ্ড। খালার কথার জবাব দিলাম। তারপর বললাম, এবার আসি।

-এসো বাপ। দেখো পথমালার দিকে কোনও গাড়ি গেলে উঠে পোড়ো।

গাড়ি মানে গরুর গাড়ি। বেরিয়ে এলাম খালার বাড়ি থেকে। খালা আমাদের তিন কুলের কেউ নয়। খালা আর ওর ছেলেদের ব্যবসা ছিল পুব পাকিস্তানে লোক পারাপার করানো। এপারে বি এস এফ আর ওপারের পাকিস্তানের পুলিশকে হাত করে রাখা ছিল। বেশ কিছু লোক ছড়ানো ছিল, যারা খদ্দের ধরে আনতো। তারা কমিশন পেতো। দাদুর চেনা ওপারের কোন এক দালাল মারফৎ আলাপ। খুব ছোটোতে দু’চারবার সীমানা পেরিয়ে ওপারে গিয়েছি। আমরা গিয়ে খালার বাড়িতে উঠতাম, তারপর খালা সময় মতো পার করে দিত। খালার ছেলে নিয়ে যেতো সঙ্গে করে। ওপারে তুলে দিত। কিছুটা হেঁটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো। আমরা সেই গাড়িতে চড়ে চলে যেতাম কাপাসডাঙায়। ওপার থেকে মামি কিংবা অন্য কোনও আত্মীয় হলে একই ব্যবস্থা থাকত। দাদু আগে খবর পাঠিয়ে দিত। ওপারের লোক খালার বাড়িতে তুলে দিয়ে যেতো। নকশাল আন্দোলনের সময় কয়েকদিন খালার বাড়িতে আত্মগোপন করেও ছিলাম। কেউ না হয়েও খালা আমাদের আপনজন হয়ে গিয়েছিল।

পেটে দুটো মুড়ি-গুড়-চা  পড়াতে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে হাটখোলা পেরিয়ে শিকরের মাঠের ধার ঘেঁসে মেঠো পথে এগিয়ে চলেছি। এক সময় এই শিকরের মাঠ ছিল ডাকাতদের আস্তানা। ছিল ঠেঙাড়ে বাহিনী। রাতের অন্ধকারে টিপ করে পথিকের পায়ে মারতো পাবড়া। পথিক পড়ে গেলে তার সর্বস্ব হরণ করতো। দিতো লাঠির দু’ঘা। বাঁশ কেটে ছোট ছোট টুকরো করতো। তাকে বলা হতো পাবড়া। এখন শিকরের মাঠের কোনও অস্তিত্ব নেই। সেটা এখন বিরাট গ্রাম।

একসময় সেই মাঠ পেরিয়ে পদ্মমালার মোড়ে এসে পৌঁছালাম। পথের একদিক গেছে চাপড়া, অন্য দিক রানাবন্দ। বাস আসবে রানাবন্দ থেকে। ওই বাসেই চলে যাব কৃষ্ণনগর। মাথার উপর সুয্যিঠাকুর চড় চড় করছে। ব্যাগ থেকে আধভিজে গামচা বের করে মুখ মুছে ঘাড়ে ফেলে দিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করি, মানুষ পথ হাঁটছে। আমায় পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বলল, দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। বাস বন্ধ। হাঁটো হাঁটো।

প্রমাদ গুনলাম। হাঁটা শুরু করলাম ওদের পিছু পিছু। হাঁটতে হাঁটতেই বাঙালঝির মোড়। ওখানে একটা টেম্পো পেলাম। সেটা চেপেই কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ড। একবার ভেবেছিলাম চাপড়ায় থেকে যাই। অনেকদিন জেঠিমাকে দেখিনি। তখনই লেখরাজদার দোকান ডাকতে শুরু করলাম। আর দেরি নয়। ছুট লাগালাম টেম্পো ধরে। নিজের শহরে যখন এসে পৌঁছুলাম, তখন দুপুরের সূর্য হেলতে শুরু করেছে। সেই সক্কালবেলায় খালার বাড়িতে দু’গাল মুড়ি মুখে দিয়েছি। তারপর আবার হাঁটা। বাঙালঝির মোড়ে এসে এক গেলাশ চা আর একটা নেড়ো বিস্কুট। পেটেয় ছুঁচো ডন মারছে। বাড়ি গিয়ে পেটে দুটো ভাত দিতে না পারলে শরীরটা শান্ত হবে না। বাসস্ট্যান্ড থেকে মিউনিসিপ্যালিটির মোড় পর্যন্ত এসে একটা রিক্সা নিলাম। মনটা আঁইঢাঁই করছে। সন্ধ্যে বাজলেই লেখরাজদার দোকানে ভিড়তে হবে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *