ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : পঁচিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারত কিন্তু রীতিমতো সেরা দলের লড়াইয়ে চলে আসে। এদিকে পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া এই লড়াইয়ে আগে থেকেই ছিল। ইংল্যান্ড ও ছেড়ে দেওয়ার মতো দল ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ লড়াই থেকে সরে যায়নি, কিন্তু তারা আর অপরাজেয় নয় এইটা বোঝা যাচ্ছিল।

এই সময় থেকে বহুদলীয়, ত্রিদলীয় প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় একদিনের ম্যাচের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১-১৯৮৩ ফাইনাল; মোট ২২৩ একদিনের ম্যাচ খেলা হয়। ওই সময়ের মধ্যে খেলা হয় ২৮২টি টেস্ট ম্যাচ। সেখানে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের আগে অবধি আরও ২২৭টি একদিনের ম্যাচ খেলা হয়। যেখানে এই সময়ের মধ্যে টেস্ট ম্যাচ হয়েছিলো ১২২ টির মতো। অর্থাৎ  ১৯৭১- ১৯৮৭ বিশ্বকাপের ঠিক আগে ৪৫০টি একদিনের ম্যাচ খেলা হয় আর টেস্ট ম্যাচ হয় ৪০৪টি। এর ফলে টেস্ট ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের খোলস ছেড়ে ওডিআই বেরিয়ে আসে, নিজস্ব চরিত্র তৈরী হয় যা সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়।

ভারতের অবস্থা খুব ভালো ছিল না। বিশ্বকাপের পরে দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে ২-০য় একদিনের সিরিজে হারিয়ে দিলেও, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫-০ ব্যবধানে হারে, রথম্যানস এশিয়া কাপে জিতলেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে হারে। এরপর কোয়েটায় পাকিস্তানের কাছে হেরে গেলেও শিয়ালকোটের ম্যাচে যখন ভারত ২১০/৩; ৪০ ওভারে – ঠিক তখনই খবর আসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর। সিরিজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চারমিনার চ্যালেঞ্জ কাপে ৪-১ ব্যবধানে হেরে ভারত যখন ধুঁকছে, তখনই বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে একে একে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তৎকালীন সময়ের একদিনের ম্যাচে সেরা টিমের দাবী প্রতিষ্ঠা করে ভারত।

এরপর শারজায় পাকিস্তানকে রথম্যান্স চতুর্দলীয় কাপে ৮৭ রানে অল আউট করে ফাইনালে ওঠে এবং অস্ট্রেলিয়াকে তিন উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। শ্রীলঙ্কায় সামান্য তাল কেটে যায়। প্রথম ম্যাচে জিতলেও দ্বিতীয় ম্যাচে হারে ভারত। তৃতীয় ম্যাচে ভারত ৪০ ওভারে ১৯৪/৬ তোলে। বৃষ্টির জন্য শ্রীলঙ্কার লক্ষ্য মাত্রা ছিল ১৫ ওভারে ৭২। তারা যখন ৯.২ ওভারে ৩২/৪, ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়।

কিন্তু এরপরের শারজায় ভারত পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দলের কাছেই হারে। অবশ্য ত্রিদেশীয় বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের ফাইনালে ওঠে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে কিন্তু ফাইনালে হেরে যায় পরপর দুটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। তৃতীয় ফাইনাল আর খেলতে হয়নি।

শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে চেতন শর্মার শেষ বলে ছয় মেরে মিয়াঁদাদের ম্যাচ জেতানো প্রায় এক দশকের পাকিস্তান ভীতির জন্ম দেয় ক্রিকেটে।

টেক্সাকো ট্রফিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ ১-১ ড্র করে দেশে চারমিনার চ্যালেঞ্জ কাপে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-২ এ হারিয়ে তখনও দাপট দেখাচ্ছে ভারত। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হেরে যায়, যদিও দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে ৪-১ এ হারায়। কিন্তু দেশের মাটিতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫-১ এ হার ও শারজায় অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড কে হারিয়েও ফাইনালে ভারত হেরে যায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

এরপর দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। ভারত অনায়াসে সেমি ফাইনালে ওঠে। কেবল গ্রুপ লীগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ ১ রানে হেরে যায়। চেতন শর্মার হ্যাটট্রিক, গাভাস্কারের সেঞ্চুরি, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফিরতি লীগের খেলায় ২৮৯ (১৯৯৬ অবধি ওডিআই খেলায় ভারতের দলগত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান) ক্রিকেট প্রেমীদের আশান্বিত করে যে ইডেনে ভারত পাকিস্তান ফাইনাল হবে।

হলো না। সেমি ফাইনালে গ্রাহাম গুচ সুইপ মেরে ভারতকে ছিটকে দিলেন।

প্রবলভাবে ভারতের বাজার দখল করলো ক্রিকেট, বিদায় নিলেন গাভাস্কার, ভারতের ক্রিকেটে ১৯৭১ এর উত্থান ঘটানো যুগের অবসান ঘটলো। লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্ম। টিম নাইন্টি।

১৯৮৭/৮৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৫ বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির খেলায় কর্ণাটকের হয়ে রাহুল দ্রাবিড় খেলেছিলেন; একটা ডবল সেঞ্চুরি করেন। আসামের হয়ে গৌতম দত্ত (বয়সভিত্তিক চারটি টেস্ট ও ৬টি ওডিআই খেলেন) ছিলেন। হায়দরাবাদের ভেঙ্কা প্রতাপ, অন্ধ্র প্রদেশের হয়ে এম এস কে প্রসাদ, দিল্লীর হয়ে নিখিল চোপড়া, পাঞ্জাবের হয়ে ধ্রুব পান্ডব (মাত্র ১৯ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় মৃত) ও পঙ্কজ ধর্মানী, বোম্বের হয়ে শচীন তেন্ডুলকার, সাইরাজ বাহুতুলে ও অভিজিৎ কালে, মহারাষ্ট্রের হয়ে সঞ্জয় বাঙ্গার ও হৃষিকেশ কানিৎকর ছিলেন।

ওই বছরই অনূর্ধ্ব -১৭ বিজয় হাজারে ট্রফির খেলায় সৌরভ গাঙ্গুলী, অজয় জাদেজা, রঞ্জিব বিসওয়াল, ভূপিন্দর সিং, আশীষ কাপুর, অনিল কুম্বলে, নোয়েল ডেভিড, অময় কুরেশিয়া, আশীষ জাইদি, প্রীতম গান্ধে, যতীন পরাঞ্জপে, বিনোদ কাম্বলি এমনকি শচীন ও খেলেছেন। তখন অনন্তপদ্মনাভন, জুবিন ভারুচা, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, সুব্রত ব্যানার্জিরা অনূর্ধ্ব উনিশের দলে এসে গিয়েছেন। রঞ্জি ট্রফিতে তখনই প্রবীণ আমরে, গুরশরণ সিং, ভাস্কর পিল্লাই, লালচাঁদ রাজপুত, অমরজিত কাইপি, শিশির হাত্তাঙারি, ইন্দুভূষন রায়, স্নেহাশীষ গাঙ্গুলী, শ্রীকান্ত কল্যাণী, অতুল ওয়াসন, কিরণ মোরে, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত নিয়মিত খেলছেন। জাতীয় দলে এসে গিয়েছেন সিধু, মঞ্জেরেকার, প্রভাকর; আজহার তো তখনই বিখ্যাত।

সেই সময়কার ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’ আলম্যানাকে এই সব উঠতি ভবিষ্যতের কথা লেখা থাকতো। ১৯৮৯ এর সংখ্যার ১২৯ পৃষ্ঠায় শচীন সম্পর্কে লেখা হয় “ The positive aspect was debutant 15 year old Sachin Tendulkar top scoring with 349 runs in the league with an average of 87.25 and later topping 500 in the season. He was the youngest ever to be capped by Bombay. In pressure situations like the urgency for batting points as well as the challenge of a turning track, Tendulkar proved equally at home. He was happy against pace and spin alike. That he could outclass players like Vengsarkar, Manjrekar, Rajput and Hattangadi speaks of his fine temperament and class. His debut century against Gujarat came off 129 balls and at a time when he had to ensure Bombay did not miss out on the fourth batting point.”

একই বছরে অজয় জাদেজা সম্পর্কে লেখা হয় (১১৮ পৃষ্ঠা) “ Among the youngsters in the Haryana side, Ajay Jadeja impress- ed the most. Cavalier though he was in his methods against Delhi in the second innings at Faridabad, when his side needed quick runs, there was no denying the class in this schoolboy. One is bound to hear more about this lad in the coming seasons.”

পরের বছর (১৯৯০) এর সংখ্যায় উঠে আসে শ্রীনাথের প্রসঙ্গ “ J. Srinath, had a dream debut. His hat-trick was mainly responsible for Karnataka obtaining the first innings lead against Hyderabad. That match had a terrible climax because Karnataka went sliding to 48 for 7 in the second knock. It was a good match for Hyderabad’s Vivek Jaisimha who slammed the first century of the season.” কুম্বলে প্রসঙ্গেও একই সঙ্গে বারবার আলোচনা হয়।

বাংলার ক্রিকেটাররাও অনুল্লেখিত ছিলেন না। ১৯৯০ এ বাংলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ১২৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয় “ Bengal unearthed a lot of talent. In the semi final against Hyder- abad, offspinner, Saradindu Mukherji made his debut in Ranji at the expense of Arup Bhattacharji and became an immediate success, performing a hat trick. In the final against Delhi, 16-year-old Saurav Ganguly, fresh from under-19 “Test” series against Pakistan, got the nod in preference to his elder brother, Snehasis, and caught the eye with his neat approach.”

দিল্লীর অতুল ওয়াসন সেবার নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুযোগ পাওয়ায় তাঁকে নিয়ে একটু বেশি জায়গা খরচ হয় (১৩৩ পৃষ্ঠা) “ Yet, the man who struck it rich in the most dramatic fashion was medium-pacer Atul Wassan. He had a haul of 38 wickets in the league at 13.65 apiece and that feat earned him the ticket to New Zealand eventually. A product of Sonnet Club and its coach Tarak Sinha, Wassan was in devastating form as he bagged five wickets in an innings on five occasions and ten wickets in a match twice. His best was against Jammu and Kashmir, a seven for 36 haul, which was instrumental in Delhi winning by an innings and more.”

কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, যে বিগত দিনের সবাই তখনও অবসর নেননি। মদনলাল, কীর্তি আজাদ, অংশুমান গায়কোয়াড়, সৈয়দ কিরমানি, মহিন্দর অমরনাথ, যশপাল শর্মা, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সরকার তলোয়ার, আদয়াই রঘুরাম ভাট, রাজিন্দর অমরনাথ, ব্রিজেশ প্যাটেল, সন্দীপ পাটিল, শিভালকর  সবাই আছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে।

কারণ খুব সোজা। প্রথমতঃ সেই প্রথম ক্রিকেটে অর্থ আসছে, আসছে স্পন্সর। দ্বিতীয়ত: প্রচুর মসালা ম্যাচ হচ্ছে। এই সময়কে আগেই লেখা হয়েছে বলে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে না। শুধু ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে সিনিয়র ও জুনিয়র দের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কি হলো তার কিছু বর্ণনা থাক।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ এই সময় ভারতে এসে ৬ টা ওডিআই ম্যাচের সিরিজে (চারমিনার চ্যালেঞ্জ কাপ) ৫-১ এ জয়ী হয়। এছাড়া বোর্ডের benevolent fund এর জন্য একটা ওডিআই ম্যাচেও ভারত হারে। টেস্ট সিরিজের দিল্লীর প্রথম টেস্ট ছিল একপ্রকার ঐতিহাসিক। ‘জীবন অনন্ত’ উপন্যাসের (মতি নন্দী) কল্পিত প্রথম টেস্ট আসলে এই টেস্টটি। ভারত প্রথম ইনিংসে ৭৫ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১২৫ রানে ফেলে দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ৩২৭ করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১১১/৪ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য আর একটি উইকেট খুইয়ে রান তুলে নেয়। বোম্বের দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হয়। ইডেনের টেস্ট ও ড্র হয়। মাদ্রাজ টেস্টে নরেন্দ্র হিরোয়ানি ১৬ উইকেট নিয়ে ২৫৫ রানে ভারতকে জিতিয়ে দেন।

এরপরে আবার শারজাহ। তবে এবার পাকিস্তান না থাকা জয় এনে দেয় ভারতকে শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এরপর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম ম্যাচে হারিয়েও ফাইনালে উঠতে পারেনি ভারত। কিন্তু এশিয়া কাপে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা সবাইকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। এরপর দেশে নিউজিল্যান্ডকে ওডিআই সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে হারায়। আজহারের সেঞ্চুরী আর শ্রীকান্তের সিরিজে ১০ উইকেট ভারতকে সাহায্য করে। টেস্ট সিরিজ ভারত ২-১ জেতে। সিধু শতরান করেন, হিরোয়ানি ২০টি ও আজহার ২১টি উইকেট নেন।

এরপরের ঘটনাবলি জানতে এই লেখার দশম, একাদশ ও দ্বাদশ পর্ব পড়ে দেখুন। ভারতীয় দলের গতিবিধি স্পষ্ট হবে। এবারে একটু আলোচনা হবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা নিয়ে। ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে। পরবর্তী ন’টি বছর ভারত, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা। আসুন সেই বিবরণে প্রবেশ করা যাক।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *