উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২৩। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

ঢেউ উঠছে ঢেউ ভাঙছে

সন্ধ্যের গোড়ায় যখন লেখরাজদার দোকানে হাজির হলেম তখন আসর সরগরম। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ভঙ্গুর অবস্থা। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর দল ভাঙছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ছোট ছোট দল। বলা ভাল উপদল। কেউ বলছে চারু মজুমদার অভ্রান্ত। কেউ বলছে, তিনি সমালোচনার ঊর্দ্ধে নন। কেউ সমালোচনা করছে। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ তত্ত্ব খারিজ করেছে। ব্যক্তি খতমের রাজনীতিকেও সমালোচনা করে নস্যাৎ করেছে। তবুও এখানে ওখানে খতম অভিমান চলছেই। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসী শাসন। পুলিশও অতি সক্রিয়। ওদিকে মুক্ত বাংলাদেশ। তার অভিঘাত সীমান্তবর্তী এই শহরেও। কোনও কোনও পত্রিকা বাংলাদেশ সংখ্যা বের করেছে। এমনই পরিবেশে শহরের লেখকরা সমবেতভাবে সাংস্কৃতিক মেলার কথা ভাবে।

আড্ডায় এসেই জানতে পারলাম বৃত্তান্ত। মূলত গল্প লেখক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছে এই মেলার পরিকল্পনা। দোকানে ঢুকতে না ঢুকতেই স্নেহাশিষ পুরো বিষয়টা বর্ণনা করল। শরীফ এগিয়ে দিল একটা ছাপা লিফলেট। তাতে পুরো কমিটির নাম দেওয়া আছে। বের হবে একটা স্মারক পুস্তিকা, তাতে উপসমিতিগুলি সহ সমস্ত অংশগ্রহণকারীর নাম থাকবে। ওই লিফলেট থেকেই জানলাম সভাপতি হয়েছেন ড. ক্ষুদিরাম দান। সহ সভাপতি কবি নিজন দে চৌধুরী, অধ্যাপক প্রসূন মুখোপাধ্যায় সম্পাদক গৌতম মুখোপাধ্যায়। কোষাধ্যক্ষ এস এম শরীফ। বাকি সকলে সদস্য। খরচ জোগানোর জন্য কূপনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলে একজন দিদিমনিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অর্থ সংগ্রহের। এটা ছিল স্বেচ্ছাদান। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বোধহয় পঞ্চাশ পয়সার কূপন করা হয়েছিল। আর দিদিমণিদের দেওয়া হয়েছিল একটা রসিদ বই। যে যা পারবেন দেবেন। স্কুলগুলো থেকে ভাল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এক টাকার কূপনে শহরের ছোট ছোট দোকান থেকে টাকা তোলা হয়েছিল। একটা করে টাকা সকলেই দিয়েছিল। অফিসে অফিসে যাওয়া হতো বিল বই নিয়ে। প্রতিদিন সকাল-বিকেল চারপাঁচ জনের একটা করে দল বের হতো অর্থসংগ্রহের জন্যে।

সেই সময় শহরে সদর মহকুমা শাসক ছিলেন কমলেন্দু দাক্ষী। তিনি ছিলেন কবি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লিখতেন। কবি রথীন ভৌমিকের সঙ্গে তার আলাপ ছিল। রথীনদার ‘অনুক্ষণ’ পত্রিকায় তিনি লিখতেন। সম্ভবত রথীনদার সঙ্গে গৌতম, স্নেহাশিস, শরীফ গিয়েছিল দাক্ষীবাবুর অফিসে। তিনিই বৃত্তান্ত শুনে কয়েকটি বড় বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন স্মারক পুস্তিকার জন্য। বিজ্ঞাপনের টাকা অগ্রিম নগদে পাওয়া গিয়েছিল।

বেশ মনে আছে, তিনদিনের এই অনুষ্ঠান হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মেলা’। এই সময়েই সুবোধ সরকারের সঙ্গে আলাপ। ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি ভাষার স্নাতক স্তরের ছাত্র। ভাল গান করতো। গানের টিউশানি করতো। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না। তাকে নিয়ে এসেছিল তাপস কর নামে এক তরুণ। সেও কবিতা লিখতো। সুবোধ সাংস্কৃতিক মেলার ভাল কর্মী ছিল। চার বছর এই মেলা চলেছিল। সুবোধ বড় দায়িত্ব পালন করতো। এখনকার সুবোধের সঙ্গে সেই সুবোধের কোনও মিল নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই ওর ভিতর আত্মকেন্দ্রিকতার ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। তখনও যে স্বস্তিকার সঙ্গে প্রেম শুরু করেনি, বা ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ বলে পাঁকজলে ঝাঁপ দেয়নি। সে অবশ্য অন্য কথা।

তিনদিনের এই মেলা হয়েছিল। প্রথমদিন উদ্বোধন হল ভোর বেলায় স্তোত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে। এরপর শুরু হল বিভিন্ন স্কুলের পর্যায়ক্রমিক অনুষ্ঠান। সন্ধেবেলায় মঞ্চে এলেন ড. ক্ষুদিরাম দাস, ড. প্রসূন মুখোপাধ্যায়, ড. সুধীর চক্রবর্তী, কবি নিজন দে চৌধুরী (তিনি রানাঘাট থেকে এসেছিলেন)। আর কে কে ছিলেন এখন আর মনে নেই। পঞ্চাশ বছর আগের কথা সব কি মনে থাকে! তবে রোজ দিনের বেলায় হতো বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান। বিকেলে স্থানীয় শিল্পীদের উপস্থাপনা। সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা শহর জুড়ে। এই মেলার মধ্যেই বের হল স্নেহাশীস শুকুলের নাটকের বই ‘নিশ্চুপ রাজা’। আমরা সেই বই ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতাম। কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরীতেও এক কপি বিক্রি করেছিলাম। ঠিক হয়েছিল শেষদিনে নাটক হবে। মিঠুদা, মানে সুদীপ চট্টোপাধ্যায় একক অভিনয় করেছিলেন। আমরা কয়েকজন ঠিক করলাম স্নেহাশিষের ‘নিশ্চুপ রাজা’ করব। পরিচালনার দায়িত্ব নিল স্নেহাশিস নিজেই। দুটি মাত্র চরিত্র। একটা করতে শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়, অন্যটা সমর ভট্টাচার্য। নাটকের শেষদৃশ্যে ছিল একটি চরিত্র তার সমস্ত জোগান খুলে ফেলছে। সমরদা বলল, ওটা আমি করব। বেশ কিছুদিন মহড়া দেবার পরেও নাটকটা হল না। কেন হল না সে আর মনে নেই।

হ্যাঁ, শুভঙ্করের কথা বলছিলাম। শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়ত। ‘পদাতিক’ নামে একটি পত্রিকা বের করতো। প্রবন্ধ লিখত। নাটকের দিকে ছিল ঝোঁক। রানাঘাট থেকে সে আসতো। সব সময় হৈ হৈ করতে ভালবাসত। নকশালবাড়ি মতাদর্শে বিশ্বাসী। পরে ওরা দমদমে চলে আসে। জর্জ মীরজাফর গোস্বামী নামে রাজনৈতিক ছড়া, গান লিখত। ছিল গণকবিয়াল। কলকাতায় প্রথম দিকে সিল্যুট চলেছিল। পরে ওপেন থিয়েটার তৈরি করে কবির লড়াই পরিবেশন করতো। গণসংগীতের কোনও কোনও সংকলনে জর্জ মীরজাফর গোস্বামীর গান সন্নিবেশিত আছে। কোনও একটি বেসরকারি কলেজে পড়াতো। নিয়মিত প্রবন্ধের বই লিখে চলেছে এখনও, অসুস্থ শরীরে।

সাংস্কৃতিক মেলা অনেককে কাছাকাছি এনেছিল, এসেছিল অনেক নতুন ছেলেমেয়ে, যারা পরবর্তী সময়ে বেশ নাম-টাম করেছে। চারবছর পর আর মেলা চালানো যায়নি। হাল ধরার মতো নতুন কাউকে তেমন পাওয়া গেল না। পুরনোরা কেউ পড়াশুনোর জন্য, কেউ পেশার তাগিদে স্থানান্তর হল। কিন্তু এই মেলাকে একটা চলমান রূপ দেওয়া গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সপ্তায় একদিন করে হাটে-বাজারে বা বিভিন্ন কলেজের সামনে অথবা জনবহুল কোনও জায়গায় কয়েকজন শিল্পী বসে যেতো ছবি আঁকতে, কেউ গান গাইতো, দু-চারজন কবিতা পড়তো। ঘন্টা দুয়েক এসব কর্মকাণ্ড সেরে ফেরা হতো। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল রবিদাসের হাতে। ছিল একটা ছোটো স্টুডিও। তার আগে একটি স্টুডিওতে কাজ করতেন। রবিদা পেশায় চিত্রগ্রাহক, নেশায় ছবি আঁকিয়ে। কবিতা লিখতেন। রবিদাই দল জুটিয়ে, ফেস্টুন সঙ্গে দিয়ে যেতেন। রবিদা শহরের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তরুণ কবি, এমন কি অল্পবয়সী মেয়েরাও সুদর্শন, সুপুরুষ রবিদাকে পছন্দ করতো। তার দোকানে ভিড় লেগেই থাকতো। তবে অনেকই তার পারিবারিক ইতিহাসটা জানতো না। রবিদার বাবা কৃষ্ণনগর থানার উল্টো দিকে গুরু ট্রেনিং স্কুলের ঝাড়ুদার ছিলেন। ওরা ছিলেন হরিজন সম্প্রদায়। গুরু ট্রেনিং স্কুল পরে হয় পি টি স্কুল, মানে প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং স্কুল। তখনও তার বাবা ওখানে ছিলেন। থাকতেন পাশেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ ঘরে। রবিদার ভাই রমেশও ওখানে কাজ করতো। সে ছিল পেশাদারী তবলচি। যে কোনও অনুষ্ঠানে, শিল্পীরা তাকেই চাইতেন। তবে খুব সামান্য টাকায় সে বাজিয়ে দিতো। রবিদা ছোট বয়সেই বাড়ি থেকে চলে আসেন। নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে নেন। কোনও উচ্চবংশীয়াকে বিয়ে করেছিলেন। তা হঠাৎই একদিন রবিদা নিপাত্তা হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন তার অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, রবিদা স্টুডিও বেচে দিয়ে সপরিবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। সেই গেলেন তো গেলেন, আর ফিরে এলেন না। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনও ক্রমশ মিইয়ে গেল। তবে তার রেশ থেকে গেল। এসব করে শহরে যে ঝাঁকানিটা দেওয়া গিয়েছিল, তার ফল এখনও ফলে চলেছে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *