উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৪। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
মৃণাল সেনের সঙ্গে কয়েকদিন
সিনেমাপাড়ায় কাজে-অকাজে যেতে যেতে সিনেমার পোকাটা মাথার মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। সিনেমার কারিগরি বিষয়গুলো রপ্ত করতে শুরু করলাম বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে। পরিচালক অমল শূর তখন ‘রসময়ীর রসিকতা’ নামে একটা ছবি করছিলেন। সেই ছবিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুযোগ মতো থাকতাম। অফিসের অন্যান্য কাজ ঠেকিয়ে টালিগঞ্জে আসতে হতো। অমলদা একটা কথা বলেছিলেন, ‘সিনেমা নিয়ে লিখতে হলে তার টেকনিক্যাল দিকটাও জেনে রাখা উচিত’। অমলদা ছাড়াও অন্যান্য পরিচালকের শুটিংয়ে হাজির থেকে আলো ও ক্যামেরা সম্পর্কেও সাধারণ জ্ঞান তৈরি হলো। চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবে একটা সুবিধা তো ছিলই। মাথার মধ্যে ঘুরছিল সিনেমা করবো, কিন্তু কীভাবে করব, তার কোনো দিশা ছিল না। দিশা দেখালো শ্যামল। আমাদের সঙ্গেই কাজ করে ইত্যাদি প্রকাশনীতে। কিশোর সাহিত্যে বেশ নাম করেছে তখন। আমরা দুপুরবেলার দিকে অফিসের কাছেই একটি পার্কে বসে আড্ডা মারতাম। তারও সিনেমা করারর বাসনা ছিলল তীব্র। আমরা মুখে মুখে নানা দৃশ্য তৈরি করে কীভাবে তারর দৃশ্যায়ন করতে হবে, তারই আলোচনায় মশগুল থাকতাম। এমন সময়, একদিন বলল, মৃণাল সেনকে নিয়ে তথ্যচিত্র করলে কেমন হয়?
বললাম, উনি কি পারমিশান দেবেন? আমরা তো ছবি করিনি কোনোদিন। কথাটা সত্যি। মৃণাল সেনের মতো অত বড়ো মাপের মানুষকে সেলুলয়েডে ধরা তো চাট্টিখানি কথা নয়! ইচ্চা আছে, সাহস আছে, কিন্তু পথ নেই। ইতিমধ্যে শ্যামল একজনকে রাজিও করিয়েছে এই তথ্যচিত্রে টাকা লগ্নি করতে। তিনি মৃণাল সেন নামটা নিয়ে ব্যবসা করবেন। বলল, তুই একদিন চল, ভদ্দরলোকের সঙ্গে কথা বলবি।
— কিন্তু তার আগে তো মৃণাল সেনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বুক ঠুকে শ্যামল একদিন ফোন করল সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে। উনি রাজিও হয়ে গেলেন। আমরা গেলাম তাঁর বাসায়। দরজার ঘণ্টা বাজাতেই বেরিয়ে এলেন অনুপকুমার। তিনি তখ ওই বাড়িতেই থাকতেন। আগমনের কারণ জানালাম। উনি ভিতরে গিয়ে ঘুরে এসে বললেন, বসুন, উনি আসছেন।
বসলাম সোফায়। তিনি ঘরে ঢুকতেই প্রণাম করলাম। বেশ খুশি মনে প্রণাম গ্রহণ করলেন। তারপর শুরু হলো আলাপচারিতা। তাঁর কাজের খবরাখবর। এসব মামুলি কাজের ফাঁকে সিনেমা নিয়ে টুকরো টুকরো কথা। বুঝতে পারলাম, বেশ গ্রহণ করেছেন আমাদের। ভিতর থেকে চা-বিস্কুট এল। অনুপ কুমারই নিয়ে এলেন। চায়ের পাত্র রেখে অভ্যন্তরে প্রস্থান করলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই বললাম, আপনাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তো হতে পারে।
উনি থমকে তাকালেন। বললেন, কে করবে?
শ্যামল বলল, ধরুন আমরা যদি করি। আপনি আমাদের অভিভাবক হিসেবে থাকবেন। পরামর্শ দেবেন।
— টাকা কে দেবে?
— সে ব্যবস্থা করে নেবো। শ্যামলের স্বরে প্রত্যয়।
মৃণালবাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, স্ক্রিপ্ট করেছ?
— না। করা হয়নি।
— আগে একটা স্ক্রিপ্ট করে দেখাও। তারপর বলছি।
প্রফুল্ল হৃদয়ে ফিরে এলাম। তৈরি হলো চিত্রনাট্য লেখার পালা। দুজন আলোচনা করে একটা প্রাথমিক চিত্রনাট্য লেখা হলো। সেটা বগলে নিয়ে দৌড়লাম তাঁর বাড়ি। বললেন, পড়ো।
পড়া হলো। মুখ দেখে মনে হলো প্রসন্ন হয়েছেন। বললেন, দু-একটা জায়গা ফ্লোরে ঠিক করে নেওয়া যাবে।
কার কার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে, সেটাও ঠিক হলো। তারপর বললেন, যে টাকা দেবে তাকে একদিন নিয়ে এসো। কথা বলবো।
যিনি টাকা দেবেন তাঁকে আমি চিনি না, জানি না। শ্যামলেন্দুই কথা বলেছিল। ঠিক হলো এক রোববার শ্যামলের বাড়ি যাব, সে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। তখন প্রায় রোববারই শ্যামলদের বাড়ি যেতাম। দুপুরে আহারর করতাম। সারাদিন আড্ডা মেরে বিকেলে ফিরতাম। তা এক রোববার সকাল সকালই গেলাম শ্যামলদের বাড়ি। প্রাতরাশ সেরে দুজনে গেলাম সেই ভদ্রলোকের বাড়ি। ওদের ছিল বাড়ি-ঘর তৈরির ব্যবসা। যিনি লগ্নি করবেন বলেছিলেনস তিনি অবিবাহিত এবং থাকেন দাদার সঙ্গে। ওর ভাইপোর সঙ্গে শ্যামলের পরিচয় হয়, সেই সূত্রেই বার্তালাপ।
যেতে যেতে শুনলাম, ছেলেটির মা আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে আমরা পৌঁছলাম এক প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে। লোহার ফটক খুলে প্রায় তিরিশ ফুট এগিয়ে সদর দরজায় ঘম্টা বাজালাম। দরজা খুলল সেই যুবক। এক মুখ হাসি নিয়ে আহ্বান জানালো। সাডানো বৈঠকখানার সোফায় উপবেশন করলাম। সে ভিতরে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, মা আসছে।
সে অন্তর্হিত হওয়ার পর তিনি এলেন। মাখন ত্বক, ঋজু শরীর, যেন রবি বর্মার ছবি। ফিনফিনে ঢলা জামার ভিতর দিয়ে শরীরের লোমকূপও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সদ্য যুবকদের মাথা বিগড়ে যাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আমি প্রথমেই মাসিমা সম্বোধন করলাম। সচেতন ভাবেই করলাম। শ্যামলও তাই ডাকল। তিনি আমাদের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতেন। তারপর ছবি নিয়ে আলোচনা হলো। কীভাবে করব, কোথায় শুটিং হবে, ছবির ভবিষ্যৎ– সব কিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো।
আমরা যখন কথা বলছি, তখন এক যুবক, বয়স চব্বিশের কোঠায় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার ফাঁকে শ্যামলের দিকে একবার তাকিয়ে একটুকরো হাসি ছড়িয়ে গেলেন।
কথা থামলে তিনি বললেন, তোমরা বোসো। চা নিয়ে আসি।
তিনি ভেতরে যেতেই শ্যামল বললো, ওই যে ছেলেটাকে দেখলি, ও হচ্ছে এই মহিলার দেওর। এই বাড়িতেই থাকে। ওর সঙ্গেই কথা হয়েছে।
আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি, ভদ্রমহিলার স্বামী ব্যবসার কাজে প্রায় সারাদিই বাইরে থাকেন। অন্য রাজ্যে যেতে হয় ব্যবসার অনেকটাই তাকে সামলাতে হয়। তার দেওরও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
চা নিয়ে তিনি এলেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরেক প্রস্থ আলোচনার পর উনি জানালেন, এর দেবর যাবেন মৃণাল সেনের সঙ্গে কতা বলতে। আমরা সন্তোষচিত্তে প্রত্যাবর্তন করলাম। তারপর শ্যামল ফোনে ফোনে মৃমাল সেনের সঙ্গে দিনক্ষণ স্থির করে, ওপক্ষের সঙ্গে কতা বলে, যাওয়া হলো মৃণালবাবুর বাড়ি।
এতদিনে আমাদের সঙ্গে মৃণালবাবুর সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে। আমরা মৃমালদা বলতে শুরু করেছি। তিনি আমাদের নামে চিনেছেন। বেশ আন্তরিকাতর সঙ্গে কথা হলো। অর্থকী বিষয়টির নিশ্চয়তার কথা জেনে, তিনি তার এক সহকারীকে দায়িত্ব দিলেন আমাদের সাহায্য করার জন্য। এভাবে মাস দুযেক কাটল। এক রোববার বিকেলে তাঁর কথামতো গেলাম। গিয়ে শুনি তিনি একটি ছবির স্ক্রিপ্ট পড়ছেন বিতরের ঘরে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রয়েছেন। তবুও আমরা কিছুক্ষণ বসলাম। তিনি এক ফাঁকে এসে বসলেন। সিগারেট ধরিয়ে বললেন, হঠাৎই স্ক্রিপ্ট পড়ার ডেট ঠিক হয়ে গেল।
— কী ছবি?
— উড়াতিয়া। তোমরা এখনই খবর কোরো না।
এরপর একটি দিন দিলেন তথ্যচিত্র নিয়ে কথা বলার। সেদিন ছিল বিষাদের দিন। বিষাদ এই কারণে, সেদিন যাওয়ার পর কোনোরকম ভণিতা না করে তিনি বললেন, প্রজেক্টটা বন্ধ রাখতে হবে। হফ নামে এক জার্মান সাহেব আসছে আমাকে নিয়ে ছবি করবে। আগামী মাসেই আসছে। মাস তিনেক সময় নেবে। ও আগে করে যাক, তারপর তোমাদেরটা নিয়ে বসবো।
আমরা বুঝে গেলাম, তিনি আর অপরিচিত দুই ছোকরাকে নিয়ে কাজ করবেন না। তবুও আশা ছাড়লাম না, যদি শিকে ছেঁড়ে। জার্মান সাবেন এলেন। তাঁকে নিয়ে ছবি করলেন। কাগজে তার খবর হলো। তারপরেই উড়াতিয়া-র কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাঝে বার দুয়েক ফোনে যোগাযোগ করলাম। নান যুক্তি বা বলা ভালো ব্যস্ততা দেখিয়ে সাক্ষাৎকার পিছিয়ে দিচ্ছিলেন। তারপর একদিন দেখলাম, উনি আমাদের চিনতেই পারছেন না।
মৃণালবাবুকে নিয়ে তথ্যচিত্র হবে না ভেবে যিনি টাকা লগ্নি করবেন বলেছিলেন, তিনিও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। হয়তো তিনিও মনে মনে ভাবছিলেন, বাঁচা গেল।
(ক্রমশ)