উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৫। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

বাঙালের গোঁ

শ্যামল কিন্তু হাল ছাড়ল না। সে কিছুদিন চুপচাপ রইল। অফিসের পর যেমন আড্ডা হয় পার্কে, কফি হাউসে কিংবা কলেজ স্কোয়ারে, তেমনই চলতে থাকল। অব্যাহত রইলো কবিতা চর্চা, কিশোরদের জন্য লেখা, লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে হইচই। কফি হাউসের টেবিল গরম করা। ইত্যাদি ইত্যাদি। মৃণাল ক্ষতে কবিতার মলম লাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সিনেমার পোকাটা মাথার ভিতর আছেই। ছবি দেখি, ছবির বিভিন্ন দৃশ্যায়ন, সম্পাদনা, নির্মাণ নিয়ে কাটাছেঁড়া করি। আর এভাবেই সিনেমার পোকাটাকে লালন করছি।

এক সন্ধ্যায় কলেজ স্কোয়ারে আড্ডা মারতে মারতে শ্যামল হঠাৎই বলল, আচ্ছা কলেজ স্ট্রিটকে নিয়ে ছবি করা যায় না? এর গড়ে ওটার ইতিহাস?

থমকে গেলাম। বললাম, দাঁড়া, একটু ভাবি। বটতলা থেকে কলেজস্ট্রীট– একটা দিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু স্কুল-কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, হেয়ার সাহেবের স্কুল, বইপাড়া তৈরি– আরে এ তো বিরাট ইতিহাস। তুই তিরিশ মিনিটে ধরবি কী করে? আর রিসার্চ ওয়ার্ক দরকার। কে করবে? অত টাকাই বা কে দেবে?

শ্যামল বলল, দেখি না চেষ্টা করে।

বুঝলাম বাঙালের গোঁ। ওর শরীরে পুব বাংলার রক্ত বইছে। হাল ছাড়ার বান্দা নয়। আমাদের মতো ঘটিদের ঘটিগরম খেয়ে শুয়ে পড়ার মতো নয়। ও একটা কিছু পথ বের করবেই। পোকাটা আমার মাথাতেও নড়ে উঠল। ফলে ভাবতে বাধ্য হলাম। মনের মধ্যে রবিকবির সুর গুনগুনিয়ে উঠল নিজের কথায়– ভাবাভাবির নাইকো বিরাম/ হবার যেটা সেটাই হবে। রোজই কথা হয়। কথা কাটাকাটি হয়। অবশেষে টিক হলো আগে পড়াশোনা তো করা যাক। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো! আমার তখন একটা বইয়ের কথা মনে পড়ল,– ছাপা হরফের হাট। কলেজস্ট্রীটের ইতিবৃত্ত। প্রকাশক– সাহিত্য সদন। সত্তর দশকের গোড়ার দিকের ছাপা। ছুটলাম দুজনে। গিয়ে হতাশ হলাম। বইটির কোনও কপি নেই। সদনের কর্মীদের অনুরোধ করেও কেনও ফল হলো না। জানলাম, সেই বই নাকি আর ছাপা হবে না। অতি সম্প্রতি সাহিত্য সদনের বাড়িটি সংস্কার করার সময় নাকি ওই বইয়ের উঁইয়ে খাওয়া কয়েক কপি পাওয়া গিয়েছিল।

সেবার সাহিত্য সদন থেকে বিফল হয়ে ফেরার পর কী করব, আমরা ভাবছি। তখনই একদিন শ্যামল বলল, মেটিরিয়ালস আমি জোগাড় করছি। তুই চিত্রনাট্যটা লিখবি।

বাঙালের গোঁ। লাগলো কাজে। কোথায় যায়, কী তথ্য পাচ্ছে কিছুই জানি না। প্রায় প্রতিদিনই আলোচনা করি দুজনে। এলোমেলো আলোচনা। কোনও দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎই একদিন মাথার মধ্যে আলো ঝলকানি দিল। বললাম, আরে, এত হাতড়ে না বেরিয়ে আমরা যদি একটা দিক বেছে নিই।

এ বলল, ঠিক বলেছিস।

দুজনে আলোচনায় ঠিক হলো কলেজস্ট্রীটের যে ব্যাপ্তি তাকে কমেন্ট্রিতে ছুঁয়ে যাওয়া হবে। আমরা শুধু এই বইপাড়ার জীবনযাপন আর দর্শনটাকে তুলে ধরব সেলুলয়েডে। আরও কিছুদিন ভাবনার গোড়ায় জল দেওয়া হলো। তারপর শুরু হলো চিত্রনাট্য লেখা। কিছুটা লিখি, তারপর দুজনে আলোচনা করে আবার নতুন করে লেখা। এভাবেই একদিন সিদ্ধান্ত হয় ছবিটা আমরা করছি। কিন্তু টাকা দেবে কে? শ্যামল খুঁতে লাগলো। আমিও দু-এক জনের সঙ্গে কথা বললাম। কিন্তু ছবিতে নায়িকা থাকবে না, নাচ-গান থাকবে না জেনে নাকচ করে দিল সবাই। শেষ পর্যন্ত শ্যামলই জিতে গেল। সে একজনকে ধরে নিয়ে এল। অল্পবয়সি যুবক। তারও বোধহয় ইট-বালির ব্যবসা ছিল। শ্যামল তাকে কী স্বপ্ন দেখিয়েছিল, শ্যামলই জানে। সিনেমা করাটাকে সে বোধহয় ইট বিক্রি করার মতোই ভেবেছিল। ফোন করলেই ইট চলে যাবে, হাতে আসবে নগদ টাকা। বড্ড অস্থির হয়ে উঠত ছবি শেষ করার জন্য।

শেষ পর্যন্ত ছবির কাজ শুরু হলো। সবই আউট ডোর। হেদুয়ার কাছে একটা প্রেস, কলেজস্ট্রীটের রাস্তা, মানুষ, কলেজ স্কোয়ারের পুজো, বই বিক্রেতা– এভাবেই এগোচ্ছিল। পথে খাওয়া। ক্যামেরা কাঁধে ছুটছেন গৌরদা। যাচ্ছে মিছিল, দৌড়ে উঠে পড়লেন ট্রাম চালকের পাশে। হ্যাঁ, গৌরদা চিত্রগ্রহণ করছিলেন। বোধহয় পুরো নাম ছিল গৌর পোদ্দার। বিখ্যাত চিত্র গ্রাহক শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগী। এককভাবেও ছবি করেছেন। পরিকল্পনা যখন পাকা, তখন স্টুডিওতে গিয়ে শক্তিদাকে ধরলাম ছবিটা করে দেওয়ার জন্য। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর কোনওরকম নেশা ছিল না।সৎ মানুষ ছিলেন। শক্তিদা বললেন, তোমরা ষোলো মিমিতে কাজ করবে। আমি তো ষোলো মিমিতে কাজ করি না। দাঁড়াও গৌরকে বলে দিচ্ছি, ও করে দেবে। যা পারবে, ওকে দিও। তবে ও খেতে ভালোবাসে।

পরিচয় হলো গৌরদার সঙ্গে। মাটির মানুষ। তিনিই ক্যামেরা, র-ফিল্ম সব ব্যবস্থা করে দিলেন। ঘরের মধ্যে শুটিংগুলোতে আলোর ব্যবস্থা করে দিতেন সেই সময়ের চলচ্চিত্র মহলের সুখ্যাত দিলীপ বন্দ্যোপাধ্য়ায়। শুটিংয়ের নানাদিক নিয়ে কখনো পরামর্শ দিত কখনো বিষ্ণু, কখনো মিঠুদা, মানে হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, সিনেমাজগতের প্রতিষ্ঠিত সহকারী। একটা ছবিও করেছিলেন। বোধহয় বহুরূপী নাম ছিল।

শ্যামল দুজন তরুণ যুবককে নিয়ে এসেছিল সহকারী হিসেবে। আসলে ওরা দলে ছিল। সেই সময় আট মিমি ছবি করার ঢেউ এসেছিল। ওরা ছোটো ছবি, বোধহয় দশ মিনিটের ছবি করেছিল। শহরে সেই সময় বেশ কয়েকটা আট মিমি ছবিবর প্রদর্শনীও হয়েছিল। ওদের ছবিটা দেখেছিলাম। বেশ ভালো লেগেছিল। আসলে ওদের ভিতরেও সিনেমার পোকাটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একজনের নাম ছিল গৌতম, সে ছবি আঁকত, আর একজনের নাম ঠিক মনে পড়ছে না। সে সম্ভবত কবিতা লিখত।

‘কলেজস্ট্রীট’ করার সময় দুটো ঘটনা ঘটলো। আমরা শুটিং শুরু করেছিলাম কাউকে না জানিয়ে, আচমকা। অথচ প্রথম দিন ক্যামেরা অন করে প্রথম শট টেক করার পরেই জানতে পারলাম ‘বসুমতী’ পত্রিকার প্রথম পাতায় কয়েক লাইনে খবরটা বেরিয়ে গেছে। আমরা অবাক। আমরা তো কাউকে বলিনি। কোথা থেকে খবরটা বেরোলো, তাও বুঝতে পারলাম না। পরে জেনেছিলাম এক মহিলা রিপোর্টার খবরটা জোগাড় করেছিলেন। ভালোই হয়েছিল। আমাদের ছবি তখন শহরের আলোচ্য হয়ে গেল। কথাটা গিয়ে পৌঁছেছিল সমরেশ বসুর কাছে। তিনি তখন ‘মহানগর’ পত্রিকার সম্পাদক। একদিন সেই পত্রিকা থেকে সঞ্জয় বলল, সমরেশদা তোমাদের সাক্ষাৎকার নিতে বলেছেন। সঙ্গে শুটিং স্টিল যাবে। বললাম, তা হয় নাকি! আমরা সবে শুরু করেছি। কিছুই কাজ জানি না। আগে ছবিটা শেষ হোক।

কিন্তু শ্যামল সমরেশ বসুর নাম শুনেই আহ্লাদিত হলো এবং সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলো। ছবি দিয়ে প্রায় তিন পাতার লেখা বেরোল। আমরা কেউকেটা হয়ে গেলাম। ছবির ঠিক নেই, অথচ নাম ফাটছে। এর মধ্যে হঠাৎই একদিন সঞ্জয় এসে বললো, সমরেশদা তোমাদের ডেকেছেন, কথা বলবেন।

আমার তো বুকের মধ্যে দুমদাম শুরু হলো। মনে হলো, মিলিটারি প্যারেড করছে। শ্যামল তো স্বপ্নের ঘোরে এক ছিলিম গাঁজা টেনে নিল। এই নেশাদ্রব্যটি এক সময় ওর খুব প্রিয় ছিল। গাঁজার গুণাগুণ এবং ছিলিমের রকমভেদ রীতিমতো গবেষণাও করে ফেলেছিল। তা করক। আমরা সঞ্জয়ের সৌজন্যে মুখোমুখি হলাম সমরেশ বসুর। তিনি নানা প্রশ্ন করে আমাদের কাজকর্ম, ছবির ইতিকথা, বাণিজ্য ইত্যাদি জানলেন এবং বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন। আমরা সেসব মাথায় রাখলাম।

তবে ছবির কাজ এগোচ্ছিল না। আমরা মূলত রবিবার বা ছুটির দিনে শুটিং করতাম। কারণ অন্যান্য দিন গৌরদা অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি প্রায় বিনা পয়সায় কাজ করে দিচ্ছিলেন। ফলে দশ দিনের কাজ দশ মাসে হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল। এদিকে যিনি অর্থের জোগান দিচ্ছিলেন, তিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। স্বাভাবিক। দেখছিল, নানা জটিলতা। আমিও অন্য কাজে আটকে গেলাম। সময় দিতে পারলাম না। ফলে ছবির কাজ ব্যাহত হলো। প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। অনেক পরে শ্যামল একাই ছবিটা শেষ করেছিল। তার ভবিষ্যৎ কী হয়েছিল, জানি না। কারণ ততদিনে শ্যামলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সংখ্যাও কমে গেছিল। আমারও পারিবারিক বিপর্যয় হেতু কলকাতা-বাস প্রায় বন্ধই হয়ে যাচ্ছিল। সে অন্য কথা। তবে ‘কলেজস্ট্রীট’ ছবির কথাও প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। মৃণাল সেনের কথা বলতে গিয়েই আবার সেই পুরনো দৃশ্যগুলো ভেসে এলো।

 

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *