উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৩। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

গত পর্বের পর

অনিলদার ছবি

হ্যাঁ, অল্প-স্বল্প আলাপ হয়েছিল সিনেমা পাড়াতেই। কোনও এক সিনেমার শুটিং পর্বেই আলাপ। খুব মিশুকে লোক ছিলেন তিনি, জমিয়ে আড্ডা দিতে পারতেন। বললেন, তুমি তো বসুশ্রী কফি হাউসে বস।

বললাম হ্যাঁ।

তখন রবিবার সকালে আমি, তরুণ চৌধুরী আর কয়েকজন বসুশ্রী কফি হাউসে বসতাম। শিয়ালদার বোর্ডিং হাউসে থাকি তখন। ওই বসুশ্রীতেই অন্যপাশে অনিল চট্টোপাধ্যায় বসতেন কয়েকজন সিনেমা-লেখকদের সঙ্গে। তারা সিনেমা সমালোচনা ছাড়াও তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে লিখতেন। তবে সিনেমাপাড়ার সঙ্গে তেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ওখানেই তিনি দেখেছিলেন আমাকে।

শুটিংয়ের ফাঁকে কথা বলতে বলতে বেশ জমে গেল। আসলে তিনি তো ছিলেন আড্ডাবাজ। তবে মাঝেমধ্যেই তিনি উধাও হয়ে যেতেন। চলে যেতেন ঘাটশিলায়। ওখানে বিভূতিভূষণ স্মৃতিরক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন। সিনেমা পাড়ার শিল্পী-কলাকুশলী সংগঠনেরও তিনি শীর্ষে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের শীর্ষেও বোধ হয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। এতো সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও কিন্তু মানুষটা একশো ভাগ ছিলেন সিনেমার মানুষ।

কয়েকদিনের আড্ডাতেই তিনি জেনে নিলেন আমার হাল হকিকৎ। আমিও যে উড়নচণ্ডী সেটা জেনে বললেন, আমিও তো উড়নচণ্ডী। এখন তো আর হবে না, নাহলে সব ছেড়েছুড়ে কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। মানুষটাকে দেখলে বোঝা যেতো না অশোককুমার-কিশোরকুমার-ছায়াদেবী সকলেই তাঁর নিকট আত্মীয়। কিশোর কুমারের সঙ্গে ছিল তুই-তোকারি সম্পর্ক। একথা শুনেছি তাঁর মুখেই।

সম্পর্ক কেমন সহজ করে তুলতে পারতেন। তারই দু-একটা কথা বলি। এক রোববার আড্ডা মারতে মারতে বেলা বারোটা বেজে গেল। অনিলদাদের দলটা বসুশ্রী ত্যাগ করছেন। আমরা তখনও বসে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আরে তোমরা বাড়ি যাও। এবার তো ভাত বন্ধ হয়ে যাবে।

আমরা ‘যাচ্ছি’ বলতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ও তোমার তো আবার ঘরবাড়ি নেই। আরে মেসের ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ওঠো এবার।

কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন বড়দাদার মতো। তারপর হাঁটা দিলেন।

এভাবেই চলছিল। কিন্তু বসুশ্রীর কফি হাউসে যাওয়া কমে গেল। রবিবারগুলো এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়তাম। অনিলদাও বোধহয় ছবির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া শিল্পী সংসদের কাজও ছিল। উত্তম কুমারের পর তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। দু পক্ষের নিয়মিত অনুপস্থিতির ফলে একটা ব্যবধান তৈরি হল। কিন্তু আড্ডাবাজরা তো নতুন আড্ডার ঠেক খুঁজে নেয়, কিংবা নিজেরাই ঠেক তৈরি করে নেয়। একদিন স্টুডিওতে দেখা। কোনও একটা ছবির শুটিং করছিলেন। টেকনিসিয়ানস স্টুডিওতে আড্ডা মারছি কয়েকজন সহকারি পরিচালকের সঙ্গে, হঠাৎ দেখি অনিলদা ফ্লোর থেকে বের হচ্ছেন। কাঁধে সেই চামড়ার ব্যাগ। একটু এগোতেই আমি উঠে গেলাম। ডাকলাম, অনিলদা।

উনি থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরেই একমুখ হাসি ছড়িয়ে বললেন, আরে কি খবর? বসুশ্রীতে নিশ্চয় যাচ্ছো না।

বললাম, অনেকদিন যাওয়া হয় না।

-খুব ব্যস্ত? রোববার সকালে আমার বাড়ি চলে এসো। শঙ্কর ভট্টাচার্য আসে। আরও দু’একজন আসে। এখন বাড়িতেই বসি।

-যাবো। এই রোববারে যাবো।

গেলাম। ‘দৌড়’ ছবির পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য এলেন। আরও দু-একজন এলেন। তারা সিনেমা নিয়ে পড়াশুনো করছিল। দুপুর বারোটা পর্যন্ত আড্ডা চলত চা সহযোগে। বিস্কুট থাকত। মাঝে মাঝে থাকত মুড়ি। অনিলদার বড় ছেলের বউ অপূর্ব মুড়ি মাখতেন। মুড়ি অনিলদার বেশ প্রিয় ছিল। এইসব সাধারণ খাবার অনেক প্রথিতযশা শিল্পীদেরই প্রিয়, যা আমার নিজের চোখে দেখা। যেমন, এক রোববারের সকালে তাপস পালের বাড়ি গিয়ে দেখি পান্তা ভাত খাচ্ছে।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সকালে পান্তা? আরে, আরও মোটা হয়ে যাবেন যে।

উত্তরে দাঁত বের করে বলল, কি করব। ছোট বেলার অভ্যেস। তেল, পেয়াঁজ, লঙ্কা দিয়ে পান্তা না হলে ঠিক জমে না।

এমন দেশি খাবার অনেকেরই প্রিয়। যেমন অনিলদার প্রিয় মুড়ি। তা প্রায় রোববারেই হাজির হতাম গল্ফগ্রীণে। কোনও সপ্তায় হাজিরা না দিলে বলতেন, তোমার ফাইন হবে। বড্ড ফাঁকি দিচ্ছো।

রোববার ছাড়া অন্যদিনও গেছি বিকেল বেলায়। অনিলদাই ফোন করতেন। অফিসের ফোনে। তখন তো মোবাইল ছিল না, আর আমার নিজেরও ফোন ছিল না। যে বোর্ডিং হাউজে থাকতাম (আসলে ছিল বোর্ডিং হোটেল) সেখানেও ফোন ছিল না। দরকার হলে পাশের ওষুধের দোকানে গিয়ে একটাকা দিয়ে ফোন করতে হতো। যারা ফোন করতেন, তারা অফিসেই করতেন। একদিন ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় ওঁর বাড়ি গিয়ে বুঝেছি, কোনও কাজ না থাকায় তিনি গল্প করার কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না, অতএব এই উড়নচণ্ডীকেই ডাকো। একটা কথা বলে নিই, আড্ডার সঙ্গী হিসাবে একটা শর্ত ছিল, সেসব কোথাও লিখতে পারব না। তাঁর সাক্ষাৎকার নেব ঠিক করেছিলাম। বললেন, রোজই তো সাক্ষাৎ হচ্ছে। আবার সাক্ষাৎকার কিসের? কি আর করা যাবে। আমাদের অন্য এক সাংবাদিককে দিয়ে সেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে আমাকে সামনে থাকতে হয়েছিল। আর ছিলেন আলোকচিত্রী অর্ধেন্দু রায়। ইত্যাদি প্রদর্শনীর চিফ আটিস্ট ছিলেন। আবার তরুণ মজুমদারের সহকারির কাজও করতেন।

এভাবেই একদিন জেনে গেছিলাম তাঁর ছবি আঁকার কথা। সেবার তিনি বেশ কিছুদিন শহরে অনুপস্থিত। ঘাটশিলায় গেছেন। ফিরে এসে ফোন।

পরের রোববার গেলাম। চায়ের সঙ্গে প্যাঁড়া পেলাম। বললেন, দেওঘর থেকে নিয়ে এসেছি।

সেবার বিভূতিভূষণ স্মৃতিরক্ষা কমিটির কাজ সেরে দেওধর চলে গিয়েছিলেন। সেসব গল্প বলছিলেন, আর বুকের লোমে হাত বুলোচ্ছিলেন। হ্যাঁ, যখন আমি বা শঙ্করদা থাকতাম, গরমের দিনে লুঙ্গি আর উদোম দেহ নিয়েই আড্ডায় হাজির হতেন। বাইরের কেউ হলে গায়ে একটা হাফ হাতা শার্ট গলিয়ে নিতেন। বাড়ির চিলতে বারান্দায় একটা ছোট্ট চৌকি, ছোট টেবিল আর একটা কাঠের চেয়ার ছিল। আমি চেয়ারে বসতাম, উনি চৌকিতে। বাড়তি কেউ হলে দু-চারটে ফোল্ডিং চেয়ার ছিল। সেগুলো নিজেকেই খুলে নিতে হতো। খুব হইচই পছন্দ করতেন না। পার্টি-টার্টি নৈবনৈব চ। গান ছাড়া আর কোনও নেশা ছিল না। এক সময় সিগারেট নেশার তালিকায় ছিল, সেটাও ত্যাগ করেছিলেন। একটা ছোট গাড়ি কিনেছিলেন। সেটাও বিক্রি করেছেন। চড়তেন ভাড়ার ট্যাক্সি, কিংবা অটো। বলতেন, আমি তো অতবড় আর্টিস্ট নই যে, গাড়ি চড়বো।

এই সর্বত্যাগী শিল্পী জানতেনও না বোধহয় তিনি কত বড় মাপের অভিনেতা। তা সেদিন সকালে প্যাঁড়া খাবার সময় দেখেছিলাম তাঁর সৃষ্টি। একটা খাতা নিয়ে এলেন। বেশ মোটা বাঁধানো খাতা। পাতায় পাতায় ছবি। পাহাড়ের ছবি, জঙ্গলের ছবি। সেবার লম্বা ভ্রমণ ছিল। ঘাটশিলা, হাজারিবাগ, দেওঘর। সে সব জায়গার ছবি স্কেচ পেনে আঁকা। এমন আরও কিছু খাতা তাঁর কাছে ছিল। আউটডোর গুটিংয়ে গিয়ে সেখানকার দৃশ্যাবলী এঁকে আনতেন। বললাম, খাতাগুলো আমাকে দিন। আমার সংগ্রহে থাকবে। আপনি তো সব নষ্ট করে ফেলবেন।

তিনি জবাব দিলেন, এখন দেব না। তুমি কাগজের লোক। কোথাও ছেপে দেবে, ঠিক আছে! পরে লিখো।

না আর নেওয়া হয়নি। ততদিনে সাক্ষাতের দিনগুলোও ক্রমশ ঝাপসা হতে শুরু হলো।

অনিল চ্যাটার্জির মতো এমন নিরহঙ্কারী শিল্পী খুব কমই দেখা যায়। মানুষের সঙ্গে না মিশলে তাঁর স্বস্তি হতো না। একদিন একটা বড় মাপের ভিজিটিং কার্ড দেখালেন, নতুন ছাপা হয়েছে। বললেন দেখ তো কেমন হয়েছে।

প্রথম পাতায় নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর ছাড়া আর কিছু নেই। পিছনের দিকে রয়েছে কোন কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, তার দীর্ঘ তালিকা। কোথাও সভাপতি, কোথাও সহসভাপতি, আবার কোথাও উপদেষ্টা। বইয়ের সূচিপত্রের মতো তালিকার দিকে তাকিয়ে বললাম, এবার তো বইয়ের পাতার মাপে করতে হবে।

উনি হেসে বললেন, কী করব বলো। কেউ ছাড়তে চায় না, কাউকে না-ও বলতে পারি না। মানুষ যদি ভালবাসে কি করব বলো।

সত্যিই তো। মানুষের ভালবাসা নিয়েই তো তিনি আমৃত্যু মানুষের সঙ্গে থেকে গেলেন। মানুষ যেমন তাঁকে ভালবাসত, তিনিও মানুষকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসায় কোনও ভেদাভেদ ছিল না। উপেক্ষা ছিল না। যাকে ভালবাসতেন নিবিড়ভাবে বাসতেন। সেই ভালবাসার ছোঁয়া তো আমিও তো কিছুদিন পেয়েছিলাম। সেজন্যই বোধহয় তার অসময়ের ডাকও এড়িয়ে যেতে পারিনি।

এক দুপুরে অফিসে কাজ করছি। কাজ মানে তো লেখা সংশোধন অথবা নিজের লেখা তৈরি করা। এমন সময় ফোনে ডাক এলো। রিসিভার কানে দিতেই সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, অনিলদা বলছি।

-হ্যাঁ, বলুন।

-বিকেলে কি করছো? একটু আসবে? দরকার আছে।

-ঠিক আছে যাবো।

সেদিন তেমন কোনও বিশেষ কাজ ছিল না। গেলাম। সামনের ঘেরা বারান্দায় চিকন চৌকিতে অনিলদা আধশোয়া। পিঠের নীচে দুটো মালিশ। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে। চৌকির সামনে কাঠের চেয়ারে বসতেই ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন, নীলা সমর এসেছে।

ভিতর থেকে উত্তর এলো, আচ্ছা।

নীলা, অনিলদার বড়ছেলের স্ত্রী। একে মফস্বলের ছেলে। তাই থাকি এক বোর্ডিং বাড়িতে। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে। অনিলদা বোধ হয় সেজন্যই একটু বেশি খাতির করতেন। তার বড় বউমাও একটু নেক নজরে দেখতেন। তিনি আমার বড়দি হতে পারতেন।

অনিলদা বললেন, বগলে একটা ফোঁড়া হয়েছে বুঝলে? ডাক্তার দেখিয়েছি। কোথাও বেরোতে পারছি না। ভাল লাগছে না। একটু গল্প করবো বলে তোমায় ডাকলাম। একটু বসো, শঙ্করও আসবে।

শঙ্কর মানে, পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য। আগেই বলেছি ‘দৌড়’ ছবিটি করে বেশ নাম পেয়েছিলেন। পরে আরও ছবি করেন, কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখেননি। স্টুডিও পাড়ায় রটনা ছিল, ‘দৌড়’ আসলে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। তিনিই নাকি ছিলেন ছবির ছায়া পরিচালক। হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। রটনার তো কোনও তথ্য-প্রমাণ লাগে না। মুখই আর একমাত্র মাধ্যম। তবে অনিল চট্টোপাধ্যায় যে অনেক সিনেমারই অভিভাবক ছিলেন, সে কথায় পরে আসছি।

আপাতত, অনিলদার বাড়িতেই থাকি। শঙ্করদা এলেন। এসেই জিজ্ঞেস করলেন, আবার কি হল?

-ফোঁড়া।

বোঝা গেল কাউকে তিনি আসল কথাটা না বলে ডেকে এনেছেন। তিনি জানতেন অনিলদা ডাকলে আসবেই। শুরু হল নানা গল্প। নীলাদি একটা বড় বাটিতে মুড়ি মেখে নিয়ে এলেন। সঙ্গে চা। মুঠে মুঠো মুখে উঠছে। মুখ চলছে মুড়ি চিবানোর শব্দ আর কথা মিশিয়ে। রাজনীতির গল্প, মানুষের গল্প, সম্প্রতি পড়া কোনও গল্প যার মধ্যে সিনেমা করার উপকরণ আছে। অনিলদা ঘাটশিলার গল্প বলছেন। আড্ডা দিতে দিতে আটটা বেজে গেল। বললেন, তুমি তো আবার শিয়ালদা যাবে। তুমি এসো।

শঙ্করদা রইলেন। আমি এলাম।

অনিলদা যে অনেক ছবিরই ছায়া পরিচালক ছিলেন সেটা টের পেলাম, যখন রাজ্য সরকারের এক আধিকারিক ছবি করতে এলেন। অনিলদা তখন রাজ্য চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান। ওই আধিকারিক ছিলেন রাজ্যের প্রাণী সম্পদ দপ্তরের শীর্ষ পদে। তার ইচ্ছে হল রাজ্যের দুগ্ধ প্রকল্প ও গো-পালন নিয়ে একটি ছবি বানাবেন। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। প্রযোজনা করবে প্রাণীসম্পদ দপ্তর। তিনি অনিলদার শরণাপণ্ণ হলেন। অনিলদা দেখলেন ভদ্রলোকের ইচ্ছে আছে, কিন্তু কাজ কিছুই জানেন না। তিনি চিত্রনাট্য লিখে অনিলদার কাছে নিয়ে এলেন। অনিলদা বুঝলেন এই চিত্রনাট্য থেকে ছবি করলে টাকা জলে যাবে। প্রচারমূলক ছবি। তবুও অনিলদা যতটা পারলেন চিত্রনাট্য অদল-বদল করে নিলেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে শুটিংয়ে সাহায্য করতেন। আসলে তিনি তো সহ পরিচালক হিসাবেই ছায়াছবির জীবন শুরু করেছিলেন। সেই ছবির মুখ্য চরিত্রে ছিলেন সুনীল মুখার্জি আর ঋতা চক্রবর্তী। ঋতা তখন নবাগত। এখন তো টিভি ধারাবাহিকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। অনিলদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি এতো খাটছেন কেন।

-কি করবো বলো। কিছু টাকা তো সরকারের ঘরে তুলে দিতে হবে। না হলে তো সবটাই জলে যাবে। সে ছবি বাজারে খায়নি। সপ্তাহ খানেক পরেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তবুও সিনেমা হলে ছবিটি ছিল কিছুদিন।

সেই সময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি নিজে ছবি করছেন না কেন? উত্তর দিলেন, কে টাকা দেবে? আমাকে কেউ টাকা দেবে না। নিজে ছবি করার মতো টাকাও নেই।

হয়তো। তবুও হাল ছাড়তে নারাজ। বললাম, আপনি ছবি করবেন আর প্রযোজক পাবেন না? অথচ আপনি তো কতজনের ছবি করে দেন।

উত্তর দেননি অনিলদা। উত্তমকুমারের পর অনিল চট্টোপাধ্যায় শিল্পী সংসদের সভাপতি হয়েছিলেন। উত্তমকুমার জীবিত থাকাকালীন সংসদের প্রযোজনায় যেসব ছবি হয়েছে, সবই উত্তমকুমারের পরিচালনায়। তাঁর প্রয়াণের বেশ কয়েকবছর পর শিল্পী সংসদ সিদ্ধান্ত নিল ‘প্যারাবোলা স্যার’ চলচ্চিত্রায়িত হবে। সেই সময় অনিল চট্টোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দেওয়া হয় ছবিটি পরিচালনার জন্য। তিনি রাজি হননি। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মাত্র। ছবিটি পরিচালনা করেন পিনাকী মুর্খাজি। কথায় কথায় একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ছবিটা আপনি পরিচালনা করলেন না কেন?

তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, শিল্পী সংসদে অনেক পরিচালক আছেন। আর আমি সভাপতি। আমি মেইন ক্যারেকটার করব, আবার ডিরেকসন দেব। এটা কি ঠিক?

মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না। এমনই ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। তবুও জনান্তিকে শোনা গেছিল, পরিচালনার নানা দিকে তিনি শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিলেন। দক্ষ সংগঠক ছিলেন তিনি। ছিলেন বামপন্থী ঘরানার মানুষ। বোধহয় সে কারণেই তাকে বামফ্রন্ট এক উপনির্বাচনে চৌরঙ্গী কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছিল। সম্মানজনক ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন।

তা, অনিলদার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন ধূসর হয়ে গেল। সম্ভবত, চাকরিস্থলের অচলা অবস্থা, পারিবারিক নানা কারণে আর দেখা হয়ে উঠত না। কখনো কোথাও দেখা হলে বলতেন, তোমার খবর কি? একদিন এসো বাড়িতে।

না, আর যাওয়া হয়নি। আমার উড়নচণ্ডী মনটা ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ালো নানা দিকে। এরই মধ্যে পেলাম তাঁর প্রয়াণ সংবাদ। ছায়াসরণী ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন কোনও এক অনির্দেশের মানচিত্রে। হারিয়ে গেল তাঁর ছবির খাতা। টুকরো লেখা।

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *