শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ৪। লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

0

১৯৬০ এ বিবেকানন্দ ক্লাব প্রতিষ্ঠার পিছনে এবং বিবেকানন্দ ক্লাবের নিবিড় যাত্রানুশীলনের পিছনে  শঙ্কর মাস্টারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও তার কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী ছিল না। যাত্রার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারত না। ‘সময় নেই’ বলেও শেষে বলত- আচ্ছা, রবিবার সকালে বাড়িতে আসিস। সেই রবিবার সকালটা এলেই সে সব ভুলে যেত।

ভুলে যেত নাওয়া খাওয়া যখন আমার মামার বাড়ীতে দুটো বা তিনটে মাথা একসঙ্গে হত- শঙ্কর মাস্টার, অমল মেসোমশাই আর জয় মামা।

আমার শৈশব কৈশোরের গ্রীষ্ম-শীতের বেশ কিছুটা সময় কাটত মামার বাড়িতে। পূণ্যামামা বা সহদেব-কুলদেবের সঙ্গে ধানের জমি, আঁখের জমি, পঞ্জিকা, যাত্রার বই আর বড়দের চোখ পাকানো ‘উলটো রথ’-এ ধনরাজ তামাং। সন্ধ্যায় কানফলা (জেলা- মুর্শিদাবাদ) পোস্টাফিসের মাটির দাওয়ায় মামাদের যাত্রার মহড়া। তখন কোনো গ্রামে গেলে যাত্রার দল পাওয়া যাবে না, এমনটা ভাবাই যেত না। আমার এক  মামা, জয় মামা, চাকরির ফাঁকে ফাঁকে যাত্রা করে বেড়াত।  পেশাদারী যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছিল। আমার এক মেসোমশাই অমলেন্দু ব্যানার্জ্জীও ছিল এক যাত্রাপাগল। শীত বা গ্রীষ্মের ওই ছুটিগুলোতে এই তিন মুর্তি একসঙ্গে জুটে গেলে লোলামামার ঘর আর পোস্টাফিসের মাটির দাওয়ায় তুফান উঠত। সঙ্গতে মামাদের যাত্রাদলের সদস্যরা।

শঙ্কর মাস্টারের এই নিরবচ্ছিন্ন স্বতঃস্ফূর্ত যাত্রাচর্চা থমকে গেল আশির দশকে এসে, যেদিন বহরমপুর গার্লস কলেজ হস্টেল থেকে, এক শেষ দুপুরে, এই যাত্রিক বাড়ির কল্‌কে ফুলের গাছের নিচে, এসে নামল তার একমাত্র মেয়ের মৃতদেহ। যে মেয়ের আঁচলে  শঙ্কর মাস্টার নিজের অসমাপ্ত পড়াশুনার জগতটাকে বেঁধে দিতে চেয়েছিল সেই যুগে, যখন ১৯৭০ এ স্থাপিত মাটিয়ারি গার্লস অ্যাকাডেমিতে অষ্টম শ্রেণীর গণ্ডী পেরিয়ে, একদল ছাদনাতলায় আলতা পায়ের ছাপ রাখত। আর যারা রামপদ সেন মেমোরিয়ালে ছেলেদের পাশে বসে  আরও দুবছর কাটিয়ে দিল, তাদের বড় অংশটা, কোন এক বর্ষা শুরুর বিকেলে, বাজারে মানিক দত্তের দোকানের সামনে দু টাকায় থার্ড ডিভিশন, পাঁচ টাকায় সেকেণ্ড ডিভিশন, দশ টাকায় ফার্স্ট ডিভিশনের মাধ্যমিক গেজেটে পাশ বা ফেল করে, আর্থ সামাজিক কারণে, স্কুল কলেজ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতায়, সরস্বতীকে বিদায় জানিয়ে, কোনো এক গোধূলি বেলায়, শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন করার জন্য পাত্রপক্ষের সামনে হারমোনিয়াম টেনে বসে পড়ত- ‘শয়ন শিয়রে ভোরের পাখির রবে/ তন্দ্রা টুটিল যবে’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য্য)।

 

মেয়েকে হারিয়ে শঙ্কর মাস্টারের যাত্রাচর্চায় এল ভাটার টান। যদিও তখনও মাঝে মাঝে যাত্রার মহড়া  মাদুর পাতছে ছাদে, তবে সে উৎসাহ  তাৎক্ষণিক। ক্ষণিকের স্ফুলিঙ্গ। জ্বলে উঠেই যাচ্ছে নিভে। দিলদার, দারা, হরিদাসরা মঞ্চ থেকে দূরে অপসৃয়মান অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

 

আর  সেইসব নোটবুক, ডায়রি, বই,খাতার পাতাগুলো কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়ে উড়তে উড়তে, ছিঁড়তে  ছিঁড়তে, কবে যেন হারিয়ে গেল ফসিল হবে বলে, তার খোঁজ আমরা কেউ রাখি নি। হরিহর সর্বজয়ার হাহাকার আর অপুর ‘দ্বৈপায়ন হ্রদে লুক্কায়িত প্রাচীন যুগের সেই পরাজিত ভাগ্যহত রাজপুত্রদের বেদনা করুণ মধ্যাহ্নটা’ মুদ্রিত অক্ষর থেকে, সিনেমার ফ্রেম থেকে বেড়িয়ে এসে বড় জীবন্ত হয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে।

আশির শেষভাগ থেকে শঙ্কর মাস্টার লেখালেখিতে বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়ে। ওই দশকেই বিদ্যুতদার ডাকে গান লিখতে শুরু করে। সে লেখা চলতেই থাকে। অজস্র কবিতা, গান।  ছিঁড়ে ফেলে।  তারপর ‘কি এক ইশারা যেন মনে রেখে’ টেনে নেয় কালি কলম কাগজ। সৃষ্টি, ধ্বংসের খেলা চলতে থাকে যতক্ষণ না জানলার বাইরে মৃত্যু এসে ইশারা করে –  ‘শেষ খেয়ার আশায় আশায় নদীর পাড়ে দিন গুনি/ পাড়ের কড়ি গেলাম রেখে সেই আমি এই আমি’। (শঙ্কর মাস্টার)

সে জীবনে যাত্রার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

 

হারিয়ে গেল কি! হারিয়ে যায়!

যারা সাজঘড়ে নকল পোশাকে রাজা সাজে, মঞ্চের আলো অন্ধকার থেকে সামনের কালো কালো মাথাগুলোকে কুর্ণিশ করে, দর্শকের হাততালি, হাসি কান্না, ভালোবাসায় ভুলে যায় যাপনের গ্লানি, জাগতিক দাবি-দাওয়া, জীবনীশক্তি করে আহরণ, সেইসব মানুষদের মন থেকে মঞ্চকে তুলে ফেলে দেওয়া যায়! নাকি ফল্গুধারা হয়ে বইতে থাকে অবচেতনে!

যে শঙ্কর মাস্টার মাল্টিপিল মায়োলামার ফোর্থ স্টেজে, পুরীর সমুদ্রসৈকতে, আপনমনে যাত্রার সংলাপে সন্ধ্যারতি সারে, সে তো সেই কবেকার সেনপাড়ার ছাদের যাত্রিক শঙ্কর মাস্টার।

অথবা তারও কিছুদিন পরে, বহরমপুরে আমার মামাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান,শঙ্কর মাস্টারের শেষ সামাজিক অনুষ্ঠান, দুই বৃদ্ধ, জয়মামা ও শঙ্কর মাস্টার বহুদিন পরে পাশাপাশি, শেষবারের মত, একের পর এক সংলাপে লোলামামার সত্তর দশকের  মাটির ঘরের মঞ্চ ফিরিয়ে আনে, আমি লেন্স খুলি, আমি ভাঙি, হৃদয় জুড়ে রক্তক্ষরণ, আমি জানি, মঞ্চের আলো নিভে আসার সময় গিয়েছে এসে……

 

যখন নীল আকাশের ওপার থেকে অনন্তের হাতছানি আসে তখন শঙ্কর মাস্টারের প্রলাপকথন- ‘ফোরের কোশ্চেনপেপার’ ‘রোহিণী, মাইনের খবর হল’-র পাশাপাশি ওই যে সব যাত্রিক শব্দগুলো – ‘জাঁহাপনা’, ‘দিলদার’, ‘জাগো শ্রমিক’, ‘কুর্ণিশ’……

মঞ্চ বুঝি রয়েই যায় নটের বুকে। কখনো গঙ্গা, কখনো ফল্গু হয়ে।

(চলবে)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *