শঙ্কর মাস্টার। পঞ্চম ও শেষ পর্ব। লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।

0

জাতিস্মর

স্কুল বাড়ির মাথার ওপর সূর্য্য প্রখর হয়। অদূরে বাঁধের বাঁকে একাকী কৃষ্ণচূড়া। ডালে ডালে ফুলের জলসা শেষ প্রহর গোনে। গঙ্গার চর থেকে উঠে আসা গরম হাওয়া আঁচড় কাটে ক্লাসঘরের বন্ধ ও খোলা  জানলায়। ডেস্ক-বেঞ্চের মৃদু কলরব স্তিমিত হয়ে এলে মৌনতা ভাঙে চেয়ার-টেবিল। ইংরাজির তরুণ শিক্ষক সুখেনবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা যায়-

‘Is  there anybody there?’

 

আমি সেই ক্লাসঘরের লিসিনার এক, সাড়ে তিন দশক পর, বাইফোকাল চোখে, মেয়ের সাথে সিঁড়ি ভাঙি, হাত রাখি শঙ্কর মাস্টারের ভাড়া বাড়ির দোতলার দরজায়-  কেউ কি আছো? আছো কেউ?

ভাঙা রেলিং এর শেষে শঙ্কর মাস্টারের সাধের রজনীগন্ধা ফসিল হয়ে গেছে কবেই। দু’চারটে ভাঙা বোতল  ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে দুই আগন্তুকের দিকে।

কেউ কি আছো?

নিরুত্তর মুহূর্ত্ত কিছু পাশের বাড়ির ছাদের কার্ণিশে পায়রার ডানা হয়ে উড়ে যায়।

-বাবা, দরজাটা খোলা আছে, ঠেলা দাও।

বলে ওঠে আমার মেয়ে। পা রাখি দোতালার বারান্দায়। তিনদিকের বিবর্ণ দেওয়ালে  হাওয়ারা নিঃশ্বাস ফেলে ।  সামনের খোলা আকাশে চক্কর মারে পায়রাগুলি।  খড়কুটো ওড়ে।

কাঠের চেয়ারে মৌন শঙ্কর মাস্টার নির্নিমেষ  চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। হরিদাসকাকার পোষা পায়রাগুলো হাততালি অনুসরণ করে।  সলিল চৌধুরী বেজে ওঠে।

-বাবা, তোমার ফোন বাজছে। আমার মেয়ে বলে ওঠে।

মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘড়ের  দরজা খুলে বেড়োয় বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক। ঘুমের রেশ তখনও তার চোখে। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে আলাপচারিতা শুরু হয়। এ বাড়ির বাইশ বছরের বাসিন্দা শঙ্কর মাস্টারের কথা জানে সে। কুশল বিনিময় হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে সে এই বাড়ির অংশীদার। মাঝে মাঝে শান্তিপুর থেকে আসে পৈত্রিক সম্পত্তির দেখভাল্‌ করতে। সে বলে যেতে থাকে তার পারিবারিক খবরাখবর। আমরা শুনি।

আমি শুনি শঙ্কর মাস্টারের কণ্ঠস্বর-

লজ্জা সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলো, কেষ্ট। আমি এখন তোমার মাস্টারমশাই নই। তুমিও বিশ্বনাথের ভাই হয়ে মুদির দোকান সামলাচ্ছ না। তুমি এক অত্যাচারী  নীলকর সাহেব। নারীলোলুপ। হা হা হাসি এখানে হবে না। তোমার শরীর মন জুড়ে অন্যরকম উত্তেজনা। তোমার চোখে, শ্বাস প্রশ্বাসে, সংলাপে, সেই উত্তেজনা প্রকাশ করতে হবে।

কাল্পনিক শাড়ির আঁচল টানতে টানতে কেষ্টদা বলে ওঠে-

হামি…হামি তোমার ছেলের বাপ হবে…তোমার ছেলের বাপ…

-বাবা, ছাদটা কোনদি্কে ছিল? মেয়ের প্রশ্ন।

যুবকটি বলে ওঠে- বাড়ির ওদিকটা বিপজ্জনক হয়ে গেছিল। ছাদের দিকটা ভেঙে ফেলতে হল। ওই যে দেওয়ালের ওই অংশটা দেখছ, নতুন ইট গাঁথা, ওটা ছিল ছাদের দরজা।

ওই দরজাটা খুললেই আমাদের মঞ্চ-সিংহাসন-গ্রীনরুমের ছাদ। কলরব ভেসে আসছে। ছেলেমেয়েরা পড়তে এসেছে। ফিরদৌসিদির আবৃত্তিতে টেল এন্ডিং হচ্ছে। জয়নালদা কুর্নিশ করতে করতে পিছনে হাঁটা অভ্যাস করছে।ডলি বিশ্বাস, ছবি করেরা এসেছে। এ গাঁয়ে বা কাছাকাছি কোথাও যাত্রা করতে এলে ওরা আসে, গল্প করে, মাস্টারমশাইকে প্রণাম করে যায়। জিতেনদা এসেছে যাত্রার বই হাতে। শঙ্কর মাস্টার হাসছে- চঁদ বাড়িতে আঠাশ বছর টিউশুনি পড়িয়েছি। তোদের শুধু ইংরাজি গ্রামারই শেখাই নি, অভিনয়টাও শিখিয়েছি। এখনও তোরা আমায় ছাড়বি না……

‘চাচি এট্টু চা বানাও দেনি’ বলে ছাদে মাদুর পেতেছে সদাহাস্য অমরকালি মাস্টার। আমার মা হাসে। চা বানায়। শঙ্কর মাস্টার বন্ধুর সাথে মেতে ওঠে যাত্রিক আড্ডায়। শান্তিগোপাল, স্বপনকুমার, নিতাই রাণী, শতদল রাণী, চপল রাণীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়……

জাগরণীর যাত্রা উৎসবের জন্য দল নিয়ে হাজির হয়েছে বহরমপুরের ব্রহ্মা মেসোমশাই। রামকৃষ্ণ, গিরীশ, বিনোদিনীকে নিয়ে চলছে ফাইনাল টাচ। ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। মা বারবার তাড়া দিচ্ছে- তোমরা আগে ভাতটা খেয়ে নাও……

  • ঘরে মিষ্টি তো নেই, তুমি একটু বিস্কুট খাও।

আমার মেয়ের হাতে থিন এরারুট তুলে দিয়েছে যুবক।  থিন এরারুটে মেয়ের প্রবল অনীহা, আমি জানি।

  • আমি জানি যাত্রায় তোর প্রবল অনীহা। তুই ভাবছিস, বাবা যাত্রাজগতের লোক….. নির্দেশনা দিলে ডুবে যাব কিনা। একে রবীন্দ্রনাথের নাটক, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের ১২৫ বছর… সরকারী মঞ্চ…… স্টলওয়ার্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা…আসলে কি জানিস, পরে হয়তঃ বুঝবি……অভিনয়জ্ঞান আর মাত্রাজ্ঞান থাকলে আঙ্গিকের সঙ্গে নিজেকে ভেঙেচুরে নেওয়া যায়। নাটক করলে, মনে হয়, খুব একটা খারাপ করতাম না…… এখন আর উৎসাহ পাই না…… আমি চাই, তোরা নাটকটা কর্‌…..তুই বরঞ্চ ভোম্বলের কাছে যা। ওকে হাতে ধরে শিখিয়েছি, জানি……ও নির্দেশনা দিলে তোদের ভালই হবে……

রাস্তা থেকে সানাই এর সুর ভেসে আসে। দশমীর পুজো শেষ। ঘট বিসর্জন শুরু হল বুঝি।

সানাই এর সুর ভেসে আসে। দশমীর ভাসান-কোলাহল শেষ হলে, মধ্যরাতে বিষাদের সুর তুলে জেগে থাকে দাসপাড়া। ছাদে মাদুরের শয্যায়, নীল আকাশে সাদা মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে, ঘুম আসে আমার চোখের পাতায়। ভোরের আলো ফুটলে দেখি, কখন শঙ্কর মাস্টার এসে গায়ে দিয়ে গেছে চাদর। ছাদের দরজা ভোরের বাতাসে দুলে ওঠে……

আমি স্পর্শ করি ছাদের দরজা। একটা একটা করে ইঁট গেঁথে বন্ধ করা হয়েছে সে দরজা। সমাধি এক। কান্না উঠে আসে কবরের নীচ থেকে।

ছেলের কবরের পাশে এসে দাঁড়ায় শঙ্কর মাস্টার। উদভ্রান্ত। কাঁধে চালের পুঁটুলি।

-রহমত, ঘুমিয়ে পড়েছিস? উঠে আয় বাবা।

কবরের পাশে বসে পড়ে শঙ্কর মাস্টার। চালের পুঁটুলি খুলে আঁজলা ভরা চাল নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কবরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গলা কাঁপে।

-এই দ্যাখ রহমত, চাল এনেছি। আয়, বাপ ব্যাটা মিলে ভাত রেঁধে খাব। তুই যে বলেছিলিস- আব্বু, বড় ক্ষিধে, ভাত দাও।

চালভর্তি হাত দুটো চোখের সামনে তুলে ধরতে ধরতে কবরের দিকে পিছন ফেরে, হাত থেকে চাল পড়ে যেতে থাকে…

-এ পৃথিবীতে ভাতের গন্ধ ভীষণ দামি রে রহমত!কেউ দেয় না। কেড়ে নিতে হয়।

এক পা এক পা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় শঙ্কর মাস্টার……

-নায়েব মশাই এর পা দুটো জড়িয়ে ধরে কত করে বললাম- বাবু, ছেলেটার অসুখ। ঘড়ে দানাপানি নেই। দু মুঠো চাল দাও। মা মরা ছেলেটার মুখে একটু ভাত তুলে দিই। আমি গতর দিয়ে খেটে সব শোধ করে দেব।

শঙ্কর মাস্টার সেন্টার স্টেজে চলে আসে……

-চাল দিলে না। বদলে, দিলে চাবুক।

শঙ্কর মাস্টার সামনের দিকে ঝুঁকে কুঁজো হতে হতে বলে ওঠে……

-জমিদারের পেয়াদা এসে চাবুকের পর চাবুক মেরে দেউরির বাইরে বের করে দিল।

উঠে দাঁড়ায় শঙ্কর মাস্টার। চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। প্রতিশোধের চোখ। অস্থির পদক্ষেপে অবস্থান বদলে বদলে যায়……

-লুঠ করেছি। জেলে পাড়া, বাউরি পাড়া, হাড়িপাড়া জেগে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে লুঠ করেছি জমিদারের চালের গুদাম।

কবরের দিকে ফিরতে থাকে শঙ্কর মাস্টার……

-আয়, রহমত, দারোগা আসার আগে আমাদের পালাতে হবে। অন্য কোন গাঁয়ে। রহমত, শুনতে পাচ্ছিস?

কবরের ওপর ঝুঁকে পড়ে শঙ্কর মাস্টার……

-শুনতে পাচ্ছিস রহমত? র…হ…ম…ত…

হাহাকার করে ওঠে শঙ্কর মাস্টার। কবরকে পিছনে রেখে সেন্টার স্টেজে আসতে আসতে দু হাত তুলে বলে ওঠে শঙ্কর মাস্টার……

-হায় আল্লা, তোমার দরবারে দুমুঠো ভাতের অধিকার কেড়ে নেয় জমিদার! আর আমাদের রহমতরা খিদের জ্বালায় ঘুমিয়ে পড়ে কবরে।

বুক চাপড়াতে থাকে শঙ্কর মাস্টার। দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নামে। শঙ্কর মাস্টারের গ্লিসারিনের দরকার পড়ে না।

নমাজের ক্ষীণ সুর শোনা যায়। পুঁটলির চাল  ঢেলে দেয় কবরে। বসে পড়ে নমাজ পড়তে। নমাজের সুর স্পষ্ট হয়……

সানাই এর সুর  ফেরে দশমীর ঘট বিসর্জন করে।  আমি, শঙ্কর মাস্টারের সমালোচক এক, যাত্রায় প্রবল অনীহা, মাথা রাখি ছাদের দরজায়।একটা একটা করে ইট দিয়ে গাঁথা বন্ধ দরজা। আমার বাইফোকাল চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসে………

-বাবা, এবার চল।

মেয়ের হাত ধরে ফিরতে থাকি। একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙি। একটা একটা করে দশক।

অলকবাবুরা  পড়িয়ে চলেন……

‘Tell them I came’

ঋণ– ‘The ListenersBY WALTER DE LA MARE

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *