শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ৩–লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

1

উত্তাল সত্তর দশক, সমাজতন্ত্রের রোম্যান্টিকতা, এমারজেন্সি, ‘ফ্যান দাও’ বা দাঙ্গার লালসা  কেমন করে ছুঁয়ে যায় কৈবর্ত্য পাড়ার জেগে ওঠায়, নীলকর সাহবের অত্যাচারে, জমিদারের চাবুকে বা বাদশার দরবারে,  সেসব বোঝার বয়স সেটা নয়। প্রামাণ্য দলিলের কিছুই আর অবশিষ্ট  নাই। শুধু মনে হয়, মুদ্রিত অক্ষর আর পালাকারের কল্পনার সাথে আপন মনের মাধুরী না মেশালে শঙ্কর মাস্টারের মত মানুষরা, যাদের মানসিক বসবাস গ্রীনরুমে, তারা বোধহয় শান্তি পায় না।

যাত্রার গানের বড় ভরসা, মাটিয়ারির ঘড়ে ঘড়ে যাঁর গানের ছাত্রছাত্রী, সেই মোহন চন্দ্র মিশ্র বা বিদ্যুৎ দাস বৈরাগ্য। সংস্কৃত শ্লোক বা শব্দের উচ্চারণের জন্য সাহায্যের দরকার পড়লে, মাটিয়ারির শেষ চতুষ্পাঠী ছকু পণ্ডিত অথবা হাইস্কুলের শিক্ষক তিনকড়িবাবু। বাদশাহী দরবারের উর্দু, আরবী শব্দ বা নমাজের জন্য মুসলিমপাড়া মসজিদের মৌলবীসাহেব। তথ্যের দরকারে বা ইতিহাসের আলোচনায়,  শিশিরদার চালের দোকানের সামনে নরেশ মল্লিক বা চাটুজ্জেদের ‘আর কি বল’ মুদিখানা দোকানের সামনে ‘স্টেটসম্যান’-এ চোখ রাখা রবিবাবু। আর এসবের টুকরো টুকরো অংশ, দরকারে বা অদরকারে, উঠে আসে শঙ্কর মাস্টারের পকেটডায়েরিতে যেখানে সংসারের হিসাবের পাশে  উঁকি মারে আলিবর্দী খাঁ, বাজারের লিস্টের পাশে নভেম্বর বিপ্লব, দেনা পাওনার যোগ বিয়োগের পাশে ছোটো বকুলপুরের যাত্রী।

গান নির্ভর ‘বিবেক’ চরিত্রে গায়কের দুর্বলতা ঢেকে ‘বিবেক’-এর ভূমিকাটিকে শক্তিশালী করতে  উঠে আসে সাহিত্য। উঠে আসে আনন্দবাজার, যুগান্তর। এমন কি আমাদের কোটেশনের খাতার পাতাও।

সেই যুগে আমরা অনেকেই রেডিওতে শোনা গানের কথা, বই-পত্রিকা থেকে কোনো ভাল লাগা লাইন বা  কোন কোটেশন,  খাতায় বা ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। শঙ্কর মাস্টার সেখানেও হানা দিত। সেইসব দিনের খোঁজে যখন কিছু জীর্ণ পোস্টকার্ড, শতচ্ছিন্ন কাগজপত্র ঘাঁটছি তখন কোটেশন খাতার এক হলদেটে পাতা উঠে এল হাতে এবং মনে পড়ে গেল, কোনো এক  বিদ্রোহের দৃশ্য আঁকতে গিয়ে শঙ্কর মাস্টার এমনই কিছু শব্দ খুঁজছিল। আনন্দবাজারে জয়ন্ত ঘোষাল এখন যে রাজনৈতিক প্রতিবেদন লেখেন একসময় সেই প্রতিবেদন লিখতেন বরুণ সেনগুপ্ত। ‘বর্তমান’ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

‘ওরা যেদিন ক্ষেপবে, যেদিন ফুটপাতের হকারিতে না গিয়ে বা চাকরির জন্য শুকনো মুখে দুয়ারে দুয়ারে না ঘুরে অফিস-কাছারিতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে হানা দেবে, সেদিন কিন্তু আমি, আপনি উড়ে যাব, আমাদের সুখের প্রাধান্য, ‘আরও চাই’ চীৎকার ওদের ধ্বংসলীলায় তলিয়ে যাবে’। (বরুণ সেনগুপ্ত)

এ হেন শঙ্কর মাস্টারের মঞ্চে অভিনয় দেখার কোন স্মৃতি আমার নাই। সত্তরের মাঝামাঝি বা আশিতে, নির্দেশনায় বা প্রশিক্ষণে শঙ্কর মাস্টা্রের আগ্রহ বেশি। সেই সময় যে কয়েকটি মঞ্চে সে অভিনেতা হিসাবে উঠেছিল, হয় তা মাটিয়ারির বাইরে অথবা কোনো না কোনো কারণে সেই নির্দিষ্ট মঞ্চের সামনে আমার পৌঁছানো হয় নি। ইচ্ছা ছিল, দুই প্রজন্ম মিলে একসাথে একবার  অভিনয় করতে উঠব মঞ্চে, কিন্তু সময় বা সুযোগের অভাবে তা আর হয়ে ওঠে নি।

তবে দিনের পর দিন বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে যাত্রা-আলোচনা বা মহড়া দেখে আমার কিছু ধারণা হয়েছিল। যেমন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি দেখাতে অবধারিতভাবে নমাজ ও হরিনামের যুগলবন্দী, খল চরিত্রের হাতের আঙুলের অর্থপূর্ণ ব্যবহার, একটি দৃশ্যের শেষ সংলাপ নিয়ে পরবর্তী দৃশ্যের শুরু, জমিদার বা রাজা বাদশার দরবারে বাঈজী নাচ, যার জন্য একমাত্র পছন্দ আশরাফ আলি মণ্ডল।

শঙ্কর মাস্টারের মত ছিল, একজন অভিনেতার অভিনয় শুরু হয়, ডায়াসের ঢালু অংশে পা রাখার সময় থেকে। যেহেতু খোলা মঞ্চ, গ্রীনরুম থেকে বেরুনোমাত্র, প্রবেশ থেকে প্রস্থানের প্রতিটি মূহুর্তে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে সে দর্শকের স্ক্যানারে।  তাই চরিত্রগুলির, বিশেষতঃ মুখ্য চরিত্রগুলির, অভিনয় হওয়া উচিত উইংস টু উইংস।  যাত্রার লম্বা সংলাপে কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, কন্ঠকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিকঠাক না হলে দৃশ্যে একঘেয়েমি আসে। দর্শক উশখুশ করতে থাকে।

 

যাত্রায় স্বপনকুমার প্রথম মাইক্রোফোনের ব্যবহার চালু করেন। হ্যাজাকের যুগে আভিনয় জীবন শুরু করা শঙ্কর মাস্টার শুধুমাত্র মাইক্রোফোনের ভরসায় সংলাপ বলা পছন্দ করত না, কারণ খোলা মঞ্চের সর্বত্র বা প্রবেশ, প্রস্থান থেকে সংলাপ বলার সময় মাইক্রোফোনের সহায়তা সবসময় নাও মিলতে পারে। তাই, দর্শকাসনের শেষ মানুষটির কাছে যাতে সংলাপ পৌঁছায় সেদিকে খেয়াল রাখা একজন অভিনেতার দায়িত্ব। শঙ্কর মাস্টার মুখে মুখে সংলাপ বানাতে পারত। উৎসাহ দিত সে অনুশীলনের।

 

ওই সময়ের অভিনেতারা, বিশেষতঃ গ্রাম বাংলার এইসব অ্যামেচার দলের অভিনেতারা, খুব বেশি উচ্চমানের যাত্রা বা নাটক দেখার সুযোগ পেতেন, তা নয়। তাঁদের যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তালিম ছিল, তাও নয়, কিন্তু নিজের বিশ্লেষণ দিয়ে, ধারণা দিয়ে এবং আগের প্রজন্মের কাজ দেখে, তাঁরা নিজেরা অনুশীলণ করতেন এবং করাতেন।

 

সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আসছে যাত্রার দৃশ্যায়নে, সংলাপে।যাত্রার ঝোড়ো অঙ্গভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।‘আকাশবাণী কলকাতা’-র শ্রুতিনাটকের প্রভাব পড়ছে যাত্রার সংলাপ ও আবহে। বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রীর অপ্রতুলতা ঢাকছে ফিলিপ্সের শোয়ানো টেপ।  চড়া স্কেলে উচ্চারিত স্টিরিওটাইপ সংলাপ নিয়ে চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষা। এ গ্রামের সিনেমাহল ‘কালিকা টকিজ’-এর উত্তম, সৌমিত্র, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, বিকাশ রায়রা প্রভাব ফেলছে যাত্রায়। শেষ দৃশ্যের শেষ অংশ উঠে আসছে প্রথম দৃশ্যে। ফ্ল্যাশব্যাকে যাত্রা শুরু হচ্ছে। সম্ভবতঃ ‘লাল পাথর’-র প্রভাব। শঙ্কর মাস্টার অভিনেতার ক্ষমতা, দৃশ্যের দাবি বুঝে সেসব প্রয়োগ করছে। আর এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য চলছে নিবিড় অনুশীলন। এমনই এক স্মৃতি ‘পলাতক’ ঘিরে।

 

এক শেষ বিকেলের প্রায় নির্জন বাড়ি। ছাদে মাদুর পেতে শঙ্কর মাস্টার লেখালেখি করতে করতে উঠে গেল ঘড়ে। কানে এল হা হা হাসির শব্দ। ওই ঘরের ছাদের দিকে একটা ছোট্ট জানলা। জানলায় উঁকি দিয়ে দেখি, পাসপোর্ট সাইজের প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় যে আয়নায়, তেমনই এক আয়নার সামনে দাড়িয়ে শঙ্কর মাস্টার পাগলের মত হা হা করে আসছে। সে হাসি খাদের দিকে নেমে আসতে আসতে কান্নার রূপ নিল। দু চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। জানলায় ছেলেকে দেখে স্বগতোক্তি- নিজে না পারলে শেখাবো কি করে! আজও অনুপকুমারের ওই ক্লাসিক  দৃশ্যটা মনে পড়লে সেই পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়ে চোখে।

Author

1 thought on “শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ৩–লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *