সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
অনেকগুলো বছর এই করে যাবার পর, একদিন সত্যিই হোমের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। মূল অঙ্গন বা ক্যাম্পাসের শুরুতে কিছু অফিসবাড়ি ও কারখানা(হোমের আবাসিকরা নানা রকমের জিনিসপত্র বানাতো, হয়তো এখনো বানায়), সেসব পেরিয়ে একটু এগুলেই সরু চড়াই পথ ইস্কুলের দিকে উঠছে, সেই বাঁকে গ্রাহাম সায়েবের আদি বাড়ি, অধুনা হোমের অধ্যক্ষ থুড়ি প্রিন্সিপালের নিবাস। সামনে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া থাকলে কি হয়, সবুজ লন, গাছগাছালি এসব নিয়ে, ধূসর পাথরে বানানো ঢালু টিনের লাল চাল ওয়ালা দোতলা বাড়িটি দেখতে বড় ভালো। প্রথম যেদিন যাই, বর্ষাঘন মেঘমেদুর দিন, বাড়ির সামনের মাঠে, বাড়ির পাথরে, বেড়ার কাঁটাতারে কুয়াশা জড়িয়ে ছিলো। কুয়াশার মধ্য দিয়ে ওপরে গেলাম। ওপর বলতে, যে পাহাড়ের ঢালে হোমের ঘরবাড়ি, তার মাথায়। সেখানে গ্রাহাম সায়েবের স্ত্রী, কেট বা ক্যাথরিনের নামে সুদৃশ্য গীর্জা, ক্যাথরিন গ্রাহাম চ্যাপেল। গীর্জা ছাড়িয়ে একটু গেলেই জুবিলি হাউস, কালিম্পং মিশনের সঙ্গে গ্রাহাম সায়েবের সংযোগের সুবর্ণ জয়ন্তী পূর্তি উৎসব, অর্থাৎ জুবিলি উপলক্ষে তৈরি সায়েবের নতুন বাসস্থান। জুবিলি হাউস বা গীর্জার চাতাল থেকে নিচে তাকালে প্রায় পুরো ইসকুলটা দেখা যায়। মনে আছে, কুয়াশা একটু একটু করে সরছে, গাছ থেকে টিনের চাল থেকে ঝরে পড়ছে জল, ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে মেটে হলুদ রঙের লাল টিনের চাল দেওয়া ইসকুলবাড়িগুলো, বড় বড় খেলার মাঠ, লম্বা ঘড়িঘর। সুন্দর, নরম, জলরঙের ছবি, আঠেরো উনিশ শতকে সাহেব মেমসাহেবরা সচরাচর যেমন নিসর্গছবি বা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন, হুবহু তেমন। দেখতে দেখতে ঘন্টা পড়লো, দুই স্কুলবাড়ির মধ্যের সরুপথ ঢেকে গেলো ছোটবড় ছেলেমেয়েদের ভিড়ে, মেঘের মধ্যে দুলতে কাঁপতে থাকলো তাদের রঙীন সোয়েটার আর ছাতার ভিড়। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, অনেক ছবি তুললাম। ওপর থেকে তো বটেই, নিচে নেমেও।
ছবি তোলা হলো। পাঠানোও। সারার কাছ থেকে উত্তর আসে না, ভাবছি, নিশ্চয় যা দুশ্চিন্তা করছিলাম তাই-ই ঘটেছে, অনেকদিন হয়ে গেলো, সারার প্রতিবেশী বন্ধু নিশ্চয়ই আর বর্তমান নেই। হাল ছেড়ে দিয়েছি বলা যায়, এমন সময় চিঠি এলো। চিঠি বলতে এ সময়কার চিঠি, ই-মেইল। সে চিঠির কিছুটা তুলে দেওয়াই যায়, হয়তো এই গল্পে বেমানান হবে না:
উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেলো…আমাদের অফিসের ইন্টারনেট টা খারাপ ছিলো, আমার পড়োশিও বাড়িতে ছিলেন না।
ছবি দেখে ওঁর খুব, খুব ভালো লেগেছে! প্রথম প্রথম তো কিছুই চিনতে পারছিলেন না। আমি একটু অপ্রস্তুত মতো হয়ে পড়লাম, সত্যিই কি সবকিছু এতটাই বদলে গেছে? তারপরে, আস্তে আস্তে একটা একটা করে জায়গা দেখাতে শুরু করলেন। মনে হয়, প্রথমটায় নতুন গাছপালা, বাড়িঘরে নতুন রঙ, ওপর থেকে নেওয়া ছবি, এসব দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বললেন কোথায় বেড়া দেওয়া ছিলো, কোন জায়গাকে কি বলে ডাকা হতো–জুবিলি নামের বাড়িটায় ডক্টর গ্রাহাম থাকতেন।
গীর্জা এবং পাহাড়টার কথা ওঁর পরিষ্কার মনে আছে। বাচ্চাদের ইস্কুলের পোশাক তখনকার তুলনায় আরো কেতাদুরস্ত হয়েছে, এবং স্কুলে থাকা অবস্থায় উনি পায়ে কখনো জুতো দেন নি…
খুব যত্নে, সস্নেহে গ্রাহাম সাহেবের কথা বলছিলেন। প্রায়ই বলেন। মনে হয়, ওঁর ছোটবেলার বাড়ি, পরিবার, স্বজন, সবটাই এই ইস্কুল। উনি যখন খুব ছোট, ওঁর মা মারা যান। বাবাকে কখনো দেখেছিলেন বলে মনে হয়না। তাঁর কথা কিছু মনে করতেও পারেননা।
ওঁর আত্মীয়-পরিজনদের সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। কারুর সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ নেই। সম্ভবত তাঁরা কেউ জীবিতও নেই। এক মাসি ছিলেন, আর তাঁর দুই ছেলে…
ভাগ্যিস তুমি ওখানে গিয়ে ছবিগুলো তুলেছিলে…কিছুক্ষণের জন্যে হলেও, উনি খুব খুশি হলেন। মনে হয় না, পুরোনো কথাগল্প বলবার, ভাগ করে নেবার মতো ওঁর আর কেউ আছে…
ওপরের চিঠিটার পর থেকে অনেক সময় বয়ে গেছে, সারার বন্ধু এখন কেমন আছেন বা আদৌ আছেন কিনা জানা নেই। গ্রাহাম সাহেবের সময়কার আবাসিক, যে সময়ে আমি ছবি পাঠাচ্ছি, সারার চিঠি আসছে, ওঁর বয়স অন্তত আশির কাছাকাছি। এই গল্পটা নিছকই আমার নিজের অসম্পূর্ণ আধখানা গল্প বটে, অথচ আরো অনেক অনেক গল্পের সঙ্গে তা জড়িয়ে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যেতে পারে। হোমের ইতিহাসটা যেমন। এ দেশে, অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে এবং হিমালয় পাহাড়ে সায়েবশাসন কায়েম ও সায়েবি আধা-সায়েবি বসতি পত্তনের যে ইতিহাসের কথা ইতিপূর্বে আমরা বহুবার বলেছি, গ্রাহাম সায়েবের বাড়ি/ইস্কুলের ইতিহাস তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেখান থেকেই তৈরি হয়। গ্রাহাম খুব উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন, পাহাড়িদের খুব ভালোবাসতেন, কালিম্পং শহরটাকে ধরে ধরে ধাপে ধাপে সাজিয়েছেন, এসব মনে রাখবার পরেও সুতরাং উপনিবেশ, ঔপনিবেশিকতা আদি শব্দ ও ধারণা তাঁর কাজকর্মের স্থানীয় ও আপাত দয়ার্দ্র চারিত্রের মধ্যে ঢুকে আসে। শাসন, সায়েবশাসন, সভ্য-অসভ্য, উন্নত-অনুন্নত, ওরা-আমরা এবং রাজা-প্রজা ইত্যাদির অমোঘ ধারণাজ্যামিতি সেই ইতিহাসকে ধারণ করে, সম্ভব করে তোলে। একটু বিশদে হোম পত্তনের আদিপর্বটা বলা যাক।
হোম কি করে গড়ে উঠলো সে গল্প বিশদে বলেছেন গ্রাহামের জীবনীকার মিন্টো সাহেব। গ্রাহামের নিজের লেখা ও চিঠিপত্র ও সমসাময়িক রাজপুরুষ ও অন্যান্যদের লেখা উদ্ধৃত করে মিন্টো দেখিয়েছেন, হোম তৈরির সঙ্গে প্রথমাবধি পাহাড়ের নিচের দুয়ার এলাকার বিস্তীর্ণ চা বাগিচা অঞ্চলের যোগাযোগ ছিলো। সে যোগাযোগের প্রথম সূত্র যদি হয় অধিকাংশ বাগিচামালিক ও ম্যানেজার ইত্যাদির স্কটদেশীয় উৎস, দ্বিতীয়টি, বাগিচামালিক বা প্ল্যান্টারদের নিঃসঙ্গ দুঃখময় জীবন প্রসঙ্গে গ্রাহামের ঐকান্তিক সহমর্মিতা।
প্রাক-সায়েব পুরোনো সময়ের ডালিং এবং সায়েবকালের কালিম্পং পাহাড়ে বাগিচাতন্ত্র শিকড় গাড়তে পারেনি, এক তিস্তা উপত্যকার বাঁ ঢালের সিঙ্কনা এলাকা বাদ দিলে তিস্তা থেকে রিল্লি, এবং রিল্লি থেকে লিস, ঘিস এবং চেল আদি নদীর জলবিভাজিকা বা ওয়াটারশেড এলাকাগুলোকে সায়েশাসকরা ঘাঁটিয়েছেন কম, পাহাড়ের মাথার দিকের বনজঙ্গল কাটা হয়েছে কম, যেখানে নদীমুখী ঢাল পরিষ্কার করে কাটা হয়েছে, সেখানে সায়েবদখল কায়েম হয়নি, দার্জিলিং পাহাড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা ও স্থানীয় লেপচা ও ভোটে রাইয়তরা জমি পেয়েছেন, পেয়েছেন নেপাল থেকে আসা পাহাড়িরাও। অথচ কালিম্পং পাহাড় থেকে সমতলে নামলেই অন্য ছবি। বনজঙ্গল, ঘাসজমি, নদী, যেখানেই যাওয়া যায়, নিশ্ছিদ্র সায়েবশাসন। বনের সায়েব, বাগিচার সায়েব। তার মানে বাঙালি বাবুসকল, এবং রাঢ়বঙ্গ জঙ্গলমাহাল ছোটনাগপুর সাঁওতাল পরগণা ময়ুরভঞ্জ থেকে ফুঁসলে ভাগিয়ে আনা, চালান করা কুলি কামিনের দল। দুয়ার বা ডুয়ার্সের সায়েবি বাগিচাতন্ত্র, বনসায়েব ও বিভিন্ন রকমের কুলি ও শ্রম প্রসঙ্গে আমাদের অনেক কথা, বহু গল্প করতেই হবে। আপাতত, কালিম্পং পাহাড়ের গ্রাহাম সায়েব এবং দুয়ার-সমতলের বাগিচাসায়েবদের যোগাযোগে কি করে দেয়লো পাহাড়ের হোম গড়ে উঠলো, পল্লবিত হলো, সেই কাহিনী।
(ক্রমশ)