সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১০। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

গ্রাহাম সাহেব ও তাঁর ইস্কুলবাড়ি

সেইসময়কার অনেক কিছু আর নেই বটে, তবে গ্রাহাম সাহেবের তৈরি ইস্কুল, যেটাকে এখন গ্রাহামস হোম বলে ডাকা হয়, সায়েবের স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থেকে গেছে। মহারাণী ওরফে ডম্বর চক থেকে লাভা গরুবাথান যাবার বড় রাস্তায় খানিক দূর গেলেই, বাঁদিকে দেয়লো কিম্বা ডেলো পাহাড়ের চড়াই পথ। এক সময় সে পথে প্রচুর হাঁটাহাটি হয়েছে, কালিমপং এলে দেয়লো পাহাড়ে চড়তেই হতো। চড়াই রাস্তার প্রথম একটা দুটো বাঁক ঘুরলেই গ্রাহাম সায়েবের মুল্লুক শুরু হয়ে যাবে। পাহাড় জুড়ে পাইন, উতিস, পিপল, অন্য বড় বড় গাছ, পথের ডানদিকে বাঁদিকে সেই গাছেদের ঘন ছায়া, পাহাড়ের ঢালে ভেজা ঘাসের ছায়াচ্ছন্ন গাঢ় সবুজ। সেই সবুজের মধ্যে ছোট বড় সব পাথরের বাড়ি, তাদের লাল রঙের টিনের চাল, লাল নীল দরজা জানলা, সাদা বা ধূসর রঙের গা। ঢালু গড়ানে চাল থেকে চিমনি উঠে গেছে। শুরুর সময় থেকেই বাড়িগুলোকে কটেজ বলার চল ছিলো। ইস্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের থাকার জায়গা। পাহাড়ে উঠছেন, গাছের মধ্যে মধ্যে কটেজ দেখা যাচ্ছে, ডাইনে দেয়লো যাবার পথ সা সা চড়াই উঠছে, বাঁদিকে গ্রাহাম সায়েবের হোম/ইস্কুল ঢোকার নীলচে-ধূসর খাসদরজা। দার্জিলিংয়ের জলাপাহাড়ে সন্ত পৌল বা সেন্ট পলস ইস্কুলে ঢুকলে সময়টময় নিয়ে যেমন একটা বিভ্রম হয়, কালিমপংয়ের গ্রাহামস হোমও হুবহু ওইরকম, শুধু ইস্কুলের ঘরবাড়িগুলো কিঞ্চিৎ সাদামাটা, অত জাঁকজমক নেই। গ্রাহামস হোম নিয়ে নানা রকম, নানান ধরনের গল্প আছে। তার বেশিটা এই বই ওই বই থেকে জানা, এক আধটা আবার আমার নিজেরও।

নিজের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। বেশ কিছু বছর আগের কথা। কি একটা সভাসমিতি উপলক্ষে কিছু বিদেশি বন্ধু কলকাতায় এসেছেন, অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গিয়েছে, তাঁরা যে হোটেলে উঠেছেন, সবাই মিলে সেখানে কথাবার্তা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের ডরসেট থেকে এসেছেন সারা, তিনি থাকেন সেখানকার স্টারমিনস্টার নিউটন বলে একটা গ্রামে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো নর্থ বেঙ্গলে থাকো, কালিমপং জায়গাটায় যাও টাও? জানতে চাইলাম, এ প্রশ্ন কেন। সারা বললেন, একটা নিতান্তই ব্যাক্তিগত কারণে। মানে একটা ছোট কাজ যদি করে দিতে পারো, বড় ভালো হয়। কালিমপং-এর সঙ্গে তাঁর কোন সংযোগ ছিলো কিম্বা আছে কিনা, জিজ্ঞেস করলাম। সারা বললেন, ঠিক আমার নয়, আমার এক পড়শির। বয়স্ক মহিলা, একাই থাকেন, বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোন না। আমি ইন্ডিয়া, বিশেষ করে বাংলায় আসছি শুনে খুব উৎসাহিত হলেন, জানতে চাইলেন কোনভাবে কালিমপং-এর কাছাকাছি যাবো কিনা? এই অবধি বলে সারা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, কালিমপং-এ গ্রাহামস হোম বলে একটা স্কুল আছে কি? স্কুল, এবং অরফানেজ বা অনাথাশ্রম? বললাম, আছে তো বটেই। সারা বললেন, তুমি সেখানে গেছ? আর একবার যেতে পারবে? খুব কৌতূহল হলো। গ্রাহামস হোমের, গ্রাহাম সায়েবের নাম শোনা ছিলো, দেয়লো যাবার পথে অনেকবার সুদৃশ্য পুরোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়েছে। পাহাড়ে যেতাম নিসর্গ দেখতে, ছবি দেখতে, হোমের সায়েবি বাড়িটাড়ি সেই ছবির অংশ, দেখতে বড় ভালো। এর বাইরে, ওই জায়গাটা সম্পর্কে জানবার আগ্রহ হয়নি, ভিতরে ঢুকে দেখাও হয়নি। সাগরপারের দূর ইংল্যান্ড, দূরতর ডরসেট,  ও আরো আরো দূর সারাদের গ্রাম স্টারমিনস্টার নিউটন, সেখানকার একজন বয়স্ক মহিলা কালিম্পং-এর গ্রাহামস হোম নিয়ে এত আগ্রহী কেন? ওঁর বাবা, দাদু, বা পরিবারের কেউ কি কালিম্পং-এ ছিলেন কখনো? প্ল্যান্টার সায়েব, কিম্বা সরকারি কর্তা বা সিভিল সর্ভেন্ট? সারা বললেন, না না, তেমন কিছু নয়। উনি সে অর্থে পুরো সায়েবও নন, সম্ভবত ওঁর মা পাহাড়ি, বাবা সায়েব। গ্রাহামস হোমের অনাথাশ্রমে, ইস্কুলে শৈশবকৈশোর কেটেছে, দেশগাঁ ঘরবাড়ি বলতে যা বোঝায়, হোমই ওঁর কাছে সব। খুব বলেন হোমের কথা, কালিম্পং-এর কথা। খুব যেতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে সবকিছু আগের মতো আছে তো? নিজে তো আর সেখানে ফিরতে পারবেন না, এখন সারা যদি একবার দেখে আসতে পারেন, দেখে এসে সেখানকার কিছু ছবি দেখাতে পারেন? আমার তো এবার যাওয়া হলো না, তুমি যদি কখনো যাও, কয়েকটা ছবি তুলে আমাকে পাঠাতে পারো, মহিলাকে আমি দেখাতে পারি, সারার সর্নিবন্ধ অনুরোধ। মধ্য কলকাতায় বসে কথা হচ্ছে, কোথায় হিমালয়ের গায়ে লেগে থাকা এক ফালি কালিম্পং, কোথায় ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডে ডরসেট, সেখানে এক নিঃসঙ্গ স্মৃতিকাতর মহিলা, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অশক্ত, বিষণ্ণ। এই গল্পের মধ্যে আমি কি করে ঢুকে পড়লাম, কে জানে? সারার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো, কথা দিয়ে ফেললাম, যাবো, কালিম্পং-এ গিয়ে গ্রাহামস হোমের ভিতরে ঢুকবো, ছবি তুলবো, পাঠিয়েও দেবো। মানে, পাঠাতেই হবে।

পাঠাতে তো হবে। কিন্তু, কি করে? কালিম্পং আসি যাই, হোমের মধ্য দিয়ে দেয়লো বেড়াতে যাই, দেয়লোর ঘাসে ছাওয়া পাহাড়চূড়ো রংবেরঙের ফুলবাগান, ছোটবড় হোটেলবাড়ি, তৎসংলগ্ন রগরগে কেচ্ছাকাহিনী(ডেলো পাহাড়ে কি ঘটিয়া থাকে? বা ঘটিতেছিলো)পপকর্ণ এবং আইসক্রিম-এর গুমটি, দোলনাখেলনা, টাট্টু ঘোড়া, অগুন্তি ট্যুরিস্ট ও তৎসঞ্জাত মোবাইল ছবিতে ভরে উঠতে থাকে, মাস বছর ঘোরে, আমার হাঁটুতে ব্যথা বাড়ে ও মাথার চুলের সাদা ঘনতর হয়, গ্রাহাম সায়েবের বাড়ি ও ইস্কুলের ভিতর ঢুকে ওঠা আর হয় না। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে,  ডরসেটের গ্রামে এক বৃদ্ধা অপেক্ষা করে আছেন,  কালিম্পং থেকে কখন ছবি আসবে, খবর আসবে। হয়তো অপেক্ষা করতে করতে ভুলেই গিয়েছেন, হয়তো আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, বেঁচে আছেন কিনা কে জানে। সারাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। তীব্র অপরাধবোধে দীর্ণ হতে থাকি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *