রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৯। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

বম্মার পোষা মুরগীগুলো সারাদিন রান্নাঘরের পাশে পাশে ঘুরে বেড়াতো। দুচারটে পাতকুড়ানো ভাত ওদের জন্য উঠোনের এককোণে দেওয়া থাকতো। আমি ওদের ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁড়ে কেঁচো খেতেও দেখেছি। আর হাঁসের দল সারাদিন পুকুরে চরে বেড়াতো। দুপুরে মাটির একটা লম্বা পাত্রে ফ্যান্টুকু ঢেকে দিলেই ওরা ঠোঁট ডুবিয়ে ” ম্যাক ম্যাক” শব্দ করে সেই ফ্যান খেতে থাকতো। সত্যিই দেখতাম, ওদের ঠোঁটের ছোঁয়ায় ভাতের ফ্যান যেন ছানা কেটে গেছে। সন্ধ্যে হলেই বম্মা বিশেষ সুরে ওদের ডাক দিতেন, “আ আ আ আ চই চই চই চই…. আ আ আ…” সেই ডাক শুনে হাঁসের দল পুকুর পাড়ে উঠে ডানাটানা ঝেড়ে লাইন দিয়ে চলত তাদের ঘরের দিকে। খুব মজা পেতাম ওদের দুলে দুলে লাইন দিয়ে চলা দেখতে।

ডিম পাড়ার মরসুমে যখন বেশ অনেক ডিম জমত, তখন ভাতের সাথে “ডিম-লাল ভাজি” খাওয়া হত। ব্যাপারটি তেমন কিছুই না, পেঁয়াজ কুঁচিয়ে তাকে প্রায় ক্যারামেলাইজ করে ভাজা হত, তার সাথে দেওয়া হত নুন হলুদ লঙ্কা মাখিয়ে ভেজে রাখা সেদ্দ ডিম। মাত্র দুটি উপকরণে এমন সুন্দর স্বাদের রান্না যে হতে পারে, সেটা না খেলে বোঝা যাবে না। সিদ্দ ডিমটিকে ভেজে লালচে করে ফেলা হত, আর পেঁয়াজের রঙ ও লালচে বাদামী– এজন্য বোধহয় অমন নাম। এই রান্না হলেও আমার জন্য বাটি করে চলে আসতই।

এই বাড়িতে বিকেলবেলার উঠোনের রান্নাঘরের কথা খুব মনে পড়ে। বিকেলের আলো থাকতে থাকতে সবাই তরকারি রেঁধে ফেলে সন্ধের ঝুঁঝিয়ে আসা আলোতে ভাতের হাঁড়িটি বসাতো। রান্নার উনুনের পাশে জ্বলে উঠত পিতলের লম্বা লম্বা,ঠ্যাং ওয়ালা লম্ফ। সেই লম্ফের আলোয় ঘোমটা দেওয়া বম্মা নানি মামীকে দূর থেকে সহজ পাঠের বড়ো বউয়ের ছবির মতো দেখতে লাগতো। মাথার উপরে সাঁঝের আকাশে তখন একটি দুটি তারা  ফুটত। ভদু কোথা থেকে শুনেছিল একটা তারা দেখতে পাওয়া খুব খারাপ। আমরা দুই বন্ধুতে তখন হন্যে হয়ে সাঁঝ আকাশে আরেকটা তারা খুঁজে ফিরতাম। দুটো তারা দেখতে পেয়ে তবে শান্তি। ততক্ষণে ভাতের হাঁড়ির ফ্যান ঝরছে।

আর রমজান মাসে এই উনুনের চারপাশে তো সাজো সাজো রব।

ঈদের আগে টানা একমাস সবাই রোজা রাখতেন। আমার বন্ধু ভোদু ও দুটো রোজা রাখল। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একদিন জিগ্যেস করে ফেললাম,তোর কষ্ট হয় না,খিদে পাচ্ছে না! ও গম্ভীর জ্ঞানীর মতো আমাকে বলল, এসব কথা যে রোজা রাখে তাকে বলতে নেই, শুনলেও তার গুনাহ হয়। আমি ভয়ে ভয়ে চলে এসে বড় নানি আর বম্মার গাঘেঁষে দাঁড়াই। ওরা তখন ইফতারের জোগাড় করছে। পেঁয়াজ লঙ্কা কেটে বেশ করে চটকে তাতে বেসন দিয়ে মেড়ে পেঁয়াজি হবে। ওপাশে বড়মামী একটা এত্ত বড় থালায় ফল কেটে সাজিয়ে রাখছে। ভিতরের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নারকোলের পোলাও আর গরুর ভুনা বা মোরগ কষার গন্ধ। আর সবচে প্রিয় যে জিনিসটি আমার ছিল তা হল ঠান্ডা শরবৎ। এই শরবৎ খেয়েই সবাই রোজা ভাঙত। তখন ফ্রিজের অপ্রতুলতা ছিল। ছোটনানা,মানে কাজিসাহেবের ছোটভাইয়ের বাড়িতে ছিল ফ্রিজ। মাঝে মাঝে সেখান থেকে বরফের বাটি আনার দায়িত্ব পেলে বর্তে যেতাম। বড়নানা, মানে কাজিসাহেবের বাড়ি থেকে ছোটনানার বাড়ির মাঝে একটা ছোটমাঠ ছিল, সেটুকু পেরিয়ে বরফ আনতে হাত যেন জমে হিম। ফ্রকের তলা দিয়ে বাটির তলাটুকু ধরে একছুটে বরফ এনে হাজির করতাম। বড় বড় কাঁসার ভারি গ্লাসে সরবৎ সাজিয়ে রাখা হত, তাতে গোলাপের গন্ধ। গোলাপের পাপড়িও ছড়ানো হত কোনোকোনো দিন শখ করে।এই বিপুল আয়োজন থেকে আমার জন্য একটি ভাগ ঠিক দিয়ে যেত বড়নানি বা বম্মা। মনে আছে,তখন সবে বিজ্ঞান পড়া শুরু করেছি,ক্লাস টু।  বাতাসের জলীয়বাষ্প যে কম উষ্ণতায় জলে পরিণত হয় সেই পরীক্ষা এই সরবতের গ্লাসেই করেছিলাম। হিম ঠান্ডা সরবতের প্রত্যেক গ্লাসে একটুকরো বরফ ভাসতো প্রতিদিন। সেদিন খেতে গিয়ে জলীয়বাষ্পর কথা মনে পড়লে, গামছা দিয়ে গ্লাসের বাইরেটা খুব শুকনো করে মুছে দিলাম। একমিনিট বাদে, ওমা! কণা কণা জল জমেছে গ্লাসের গায়ে! এমনি করে রোজার তিরিশটি দিন কেটে যেত। ঈদের আগের দিন রিঙ্কুদিদি টিঙ্কুদিদি পলি দিদি ওরা সবাই মেহেন্দীপাতা বেটে হাতে নক্সা করত। এখনকার মতো অত তাক লাগানো চমকদার কিছু না, হাতের মাঝখানে একটা গোল করা হত, আর আঙুলের মাথা গুলোয় লাগানো হত পাতা-বাটা। এই মেহেন্দীর ডিজাইন নিয়ে সবাই  উঠোনে উনোনের পাশে বসে হাত শুকিয়ে নিত। মেহেন্দীর পাতা শুকিয়ে উঠলে পুকুরে গিয়ে হাত ধুয়ে, মুছে একফোঁটা সর্ষের তেল হাতে ঘষে নিত। বেশ লালচে উৎসবের রঙ লেগে যেত সবার হাতে। এই বাড়িতে ঈদের দিন সকালে আমি সবাইকে দেখে অবাক। প্রতিদিনের দেখা মানুষগুলি সাদা পাঞ্জাবি পাজামা আর সাদা টুপিতে যেন অন্য কোন অপার্থিব জায়গার মানুষজন হয়ে গেছিল। সবাইয়ের গায়ে নতুন জামা নতুন কাপড়, হই হই করে সেজেগুজে সবাই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে উঠছে, সে এক আশ্চর্য আনন্দের যেন হাট বসে গেল। আমি আর বোন ও আমাদের নতুন জামা পরে টুকটুক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম সেই আনন্দযজ্ঞে। সে একটা দিন গেছে…

মেজো নানার ছয় ছেলের সাথে এক মেয়েও ছিল। তার ডাকনাম ছিল বাম্পো। এই বাম্পো পিসির সাথে আমার মায়ের খুব গলায় গলায় ভাব ছিল। বাপের বাড়ি এলেই, সে,” ও আরতিদি” বলে মায়ের সাথে একঝুড়ি গল্প নিয়ে বসে যেত। এই বাম্পোপিসির ছেলে দীপু ছিল আমার বয়সী। তার মুসলমানী মেজো নানার বাড়িতেই হল। ঘরোয়া অনুষ্ঠান। কিন্তু কাজী সাহেবদের বাড়িতে চারভাইয়ের পরিবার মিলে প্রায় ৮০/৯০ জনের রান্না। সেদিন দেখলাম কাজী সাহেবদের পারিবারিক  বাসন রাখার ঘর থেকে বেরোলো এই এত্ত বড় বড় পিতলের নকশাকাটা হাঁড়ি তিন চারটে। এই এত্তবড় কড়াই গামলা খুন্তি ঝাঁঝরি, সব পিতলের। আমার মনে হল যেন আলিবাবার রান্নাঘর থেকে জিনিসপত্র কী করে এখানে চলে এসেছে। অমন সুন্দর নকশাদার হাঁড়িকুঁড়ি আমি আর কোথাও দেখি নি। উঠোনের মাঝখানে একটা বিশাল সামিয়ানা টাঙিয়ে রাঁধাবাড়ার জোগাড় চলতে লাগলো। এই প্রথম আমি বিরিয়ানী নামক খাবারের নাম শুনলাম। অবাক হয়ে আরো দেখলাম, আজ সদ্য তৈরি উনুনে কড়াই বসিয়ে তাতে খুন্তি নাড়ছেন স্বয়ং মেজোনানা। সেদিন হেঁসেল থেকে তিনি মেয়েদের ছুটি দিয়ে দিলেন। ছয় ছেলেকে নিয়ে কী তরিবৎ করেই না তিনি রেঁধে ফেললেন অসামান্য বিরিয়ানী, স্বাদে গন্ধে গোটা বাড়িকে একাই তিনি মাতিয়ে দিলেন। বিরিয়ানির গন্ধে গোটা বাড়ি ভুরভুর করতে লাগলো।

মেজনানার রান্নাঘরের তুলনায় ছোটনানার রান্নাঘর ছিল অনেক গোছানো। তাঁদের কোনদিনই খোলা আকাশের তলায় রান্না করতে দেখি নি। বরাবরই কয়লা বা গুলের তোলা উনুন, আর পিতলের কেরোসিন স্টোভ। এই রান্নাঘরে একবার একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। ছোটনানির শরীর খারাপ থাকায় একবার সকালবেলায় বম্মা এলেন ওদের জলখাবারে রুটি করতে। রুটি আলু ভাজি করে সবার জন্য গুছিয়ে রেখে তিনি নিজে একটা রুটি আলুভাজি দিয়ে খেয়েও ফেললেন। এরপর ববিদাদা এসে সেই রুটি খেতে গিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলো, রুটি এমন বিদঘুটে খেতে কেন!? ববিদাদা সেই রুটি নিয়ে অসুস্থ মায়ের কাছে গেল সন্দেহভঞ্জন করতে। তিনি তো রুটি খেয়ে সোজা উঠে বসলেন! যাহোক করে বম্মার কাছে এসে বললেন, “কোন কৌটো থেকে ময়দা নিয়েছ?” বম্মা কৌটোটি দেখালে তিনি বললেন, “কী সব্বোনাশ! এ তো খাবার সোডা! রান্নাঘরের কৌটোকাউটি ধোবো বলে এককেজি এনে রেখেছিলাম!!!” তখন সবাই,” ওরে ফ্যাল ফ্যাল রুটি ফ্যাল… কে কে খেয়েছিস? ক’গাল  খেয়েছিস? আমাদের কী সব্বোনাশ হল গো…”এসব কথা বলতে বলতে কর্তব্য অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ল। এর মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বম্মা। বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলে চললেন, “ওরে আমি এবার মরে যাবো! ওরে আমার কি হবে রে… আমায় তোরা কেউ হসপিটালে নিয়ে চল রে…” সবাই তখন তাকে ব্যস্ত করে তুলেছে, “তোমার জিবের কী দশা! তোমার চোখের কী দশা! তুমি সোডা মাখলে জল দিয়ে তবু বুঝতে কেন পারলে না!…” আর তিঁনি তত ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত ছোটনানা সবাইকে সরিয়ে বম্মাকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। সেখানে তিনি টানা দুইদিন স্যালাইন টেনে ফিট হয়ে বাড়ি ফিরলেন।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *