রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ১০। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
ন্যাদোস মাছের ঝাল
এবার আমার নিজের রান্নাঘরের কথা। আমার নিজের জীবনে আপাতত এই পর্যন্ত মোট ১১টি বাদাবদল, সুতরাং ১১টি রান্নাঘর। দোসরা অক্টোবর ১৯৯৭ সাল, যুগ্মজীবনে প্রথম রান্নাঘরে পা রাখা। এই বাসাবাড়ি ছিল সোনারপুরে। সেই বাড়িতে একটি ঘর, ঘর থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর। রান্নাঘর মানে পাঁচ ইঞ্চির ইঁটের গাঁথুনির মাথায় টিনের চাল, জানলা বলতে একটা সিমেন্টের জাফরি, রান্নাঘরের দরজাটি ও টিনের, তাতে একটা লোহার শিকল দিয়ে তালা চাবির ব্যবস্থা। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম বলে, রান্নাঘরের প্রাথমিক জিনিসপত্র নিজেদেরই কিনতে হল। একটা জনতা স্টোভ, একটা হাঁড়ি, একটা কড়া, একটা হাতা একটা ছুরি, দুটো বড় বড় চায়ের কাপ, একটা ছাঁকুনি একটা ছোট গামলা আর একটা প্লাস্টিকের বালতি —- এই নিয়ে আমার রান্নাঘরের সূত্রপাত। হাতে যা টাকা ছিল, তাতে কেজি দুই চাল, আড়াইশো ডাল, এককেজি আলু, নুন, হলুদ আর পাঁচ ফোড়ন কেনা হয়েছিল। আরো কেনা হয়েছিল টাটা চা, আড়াইশো চিনি, ধারা সর্ষের তেলের একটা ছোট প্যাকেট, এ-ওয়ান মারি, কোলগেট মাজন এবং কেরোসিন তেল। দুটি মেলামাইনের থালা আমার প্রাক্তন তখন বাড়ি থেকে সুটকেসে গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।
জনতা স্টোভ তো মাকে ব্যবহার করতে দেখেইছি, ভাবলাম টুক করে জ্বালিয়ে তুড়ি মেরে রান্না করে নেব…ভাই রে!! সেই স্টোভে সলতে পরানো কী আর যে সে কাজ!! উ: ঘেমে নেয়ে তেলে সলতেতে নাকানিচোবানি খেয়ে এক্কেরে যা তা অবস্থা হল! প্রায় চল্লিশ মিনিটের প্রচেষ্টায় বারোটা খোপে বারোটা সলতে পরালাম। প্রেম তখন মাথায় উঠেছে প্রায়। এই অবস্থা পার করে শেষে স্টোভ জ্বাললাম এবং টাটা চা করে নতুন কাপে ঢেলে ফেললাম। বিয়ের আগে কখনো চা খাই নি, এই আমার চা খাওয়া শুরু হল। চায়ের সাথে বেরোলো সেই এ-ওয়ান মারি। চল্লিশ মিনিট ধরে সলতে পরিয়ে তখন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে, চায়ের কাপে চা যখন শেষ হল দেখা গেল দুজন মিলে দুই শ গ্রাম বিস্কুট থেকে মাত্র পাঁচটা বাঁচাতে পেরেছি।
এবার ভাত রান্নার পালা। চাল ধুয়ে ভাত বসালাম। তাতে আমাকে তিনি উপদেশ দিলেন, চাল দশবার ধুয়ে নিতে। তাই করলাম। খোসাসুদ্ধ আলু আধখানা করে চালের মধ্যে দিয়ে ভাত বসানো গেল। দশবার হাতায় করে চাল তুলে দেখি ভাত সেদ্দ হল কিনা। ফ্যান গালতে গিয়ে যথারীতি হাতে ছ্যাঁকা খেলাম। ভাত নামিয়ে কড়ায় ডাল সেদ্দ বসালাম। মাকে যেমন করে দেখেছি, সেদ্দ ডাল গামলায় নামিয়ে কড়ায় তেল গরম করে পাঁচফোড়ন দিয়ে ফোড়ন দিলাম, সাথে একটু নুন মিষ্টি হলুদ… এবং ডাল নামাতে গিয়ে আবার ছ্যাঁকা খেলাম।
ফোসকা পড়া হাত নিয়ে খেতে বসে এই ঠিক এত্তবড় ঝুড়ির একঝুড়ি প্রশংসা পেলাম। তাতে প্রকৃত অর্থে হাতের জ্বালা টালা বিশেষ কমল না। তবে সেদিন তিনি বলেছিলেন, আমি মশলাপাতি এবং অন্যান্য জোগাড় পেলে নাকি দারুণ রান্না করবো। তা, সে আমি করেছিলাম বটে। গোটা বিবাহিত জীবন শুধু নানাবিধ সাবেকী এবং পরীক্ষামূলক রান্না করেই কাটিয়েছি বলা যায়।
তো যাইহোক, এই রান্না ঘরে আমার একটিও কৌটো ছিল না। সব কিছু তখন ঠোঙাতেই রাখতাম। মায় সর্ষের তেল অবধি টেট্রা প্যাকেই রয়ে যেত। সর্ষের তেলেও যে পিঁপড়ে ধরে তা এই রান্নাঘরেই দেখেছিলাম। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, এরা কি চিনি ক্যারামেলাইজ করে তেলের রঙ করে?! না হলে সর্ষের ঝাঁজে পিঁপড়ে আসার কথাই তো নয়!!
জীবনের এই প্রথম রান্নাঘরটিকে কিছুই সাজানো গোছানো হয় নি। টাকা পয়সাও প্রায় ছিল না, আর ইচ্ছেটিও তখন গড়ে ওঠে নি। প্রাক্তন বর তখন সেলসের কাজে ভোরে বেরিয়ে যেত চা বিস্কুট খেয়ে। আমি আর নিজের জন্য রান্না করতাম না। মুড়ি বা একআধটা বিস্কুট খেয়ে পড়ে থাকতাম। তখন বিকেল তিনটে নাগাদ সোনারপুরে বাজার বসে যেত। সেখান থেকে সামান্য আনাজ আর হাতে পয়সা থাকলে গুনে গুনে ঠিক দুটি মাছ কিনতাম। দুটো ছোট চারা পোনা, বা বাটা ই কিনতাম বেশি। পয়সা কম থাকলে ডিম, আরো কম থাকলে শুধুই সবজি। তাতে দু:খ কিছু ছিল না।
মাছ কিনলে খুব সমস্যায় পড়তাম, ছুরি দিয়ে মাছ কাটতে হত বলে। এইসময় আমার ডিসেকশন বক্স খুব কাজে এল। ভাগ্যিস জ্যুলজি অনার্স নিয়ে পড়তাম তখন! পরে টুকটুক করে পয়সা জমিয়ে একটি ছোট বঁটি কিনেছিলাম।
এই বাসার পর আমরা চলে গেছিলাম গড়িয়ায়। গড়িয়ায় বেশ সুন্দর একখানি গ্যাসের টেবিল ওয়ালা রান্নাঘর পেলাম। কিন্তু তখন আমার গ্যাস নেই। সেই জনতা স্টোভই। তখন রান্নাঘরে বেশকিছু কৌটোকৌটি হয়েছে, মা একখান প্রেশার কুকার কিনে দিয়েছে। তখন আবার পরীক্ষা দেব বলে দুদ্দাড় করে প্রেসার কুকারে রান্নাবাড়া করে নিই। এই সময় ও আমি বিশেষ রাঁধতে-টাঁধতে ভালোবাসি না। আসলে তখন এত অপ্রতুল জোগান ছিল, এত কষ্টের সংসার যে ডালভাতের চেয়ে বেশি কিছু রাঁধলেই মনে হত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে।
এইসময়, গড়িয়া স্টেশনের লাগোয়া একটি খাল সেঁচে ফেলা হল। প্রচুর ন্যাদোস মাছ উঠল। আমাদের বাড়িওয়ালা ২০টাকা দিয়ে একবালতি মাছ নিয়ে এলেন। আমাদের ডেকে বললেন,” পাঁচ টাকা দাও, তোমাদের জন্য নিয়ে আসি।” একগামলা জ্যান্ত লাফানো ন্যাদোস মাছ যে পাঁচ টাকায় পাওয়া যেতে পারে এ তো আমরা তখন ভাবতেই পারি না। সেই মাছ আমরা তিনদিন ধরে খেলাম, মাছগুলি প্লাস্টিকের বালতিতে দিব্যি জ্যান্ত ছিল তিন দিন। অভাবের সংসারে সেই মাছের ঝোল ঝাল ভাজা চচ্চড়ি আমাদের খুব তৃপ্তি দিয়েছিল। বিশেষত, ন্যাদোস মাছের ঝালের স্বাদ এখনো যেন জিভে লেগে আছে।
এরপরের রান্নাঘর মল্লিকপুরে,অসম্ভব স্নেহময়ী এক কাকীমার বাড়িতে। আমাকে প্রথম দেখেই তিনি বলেছিলেন, “ওমা এ যে আমার পম্পি গো”। পম্পি তাঁর মেয়ের নাম। যে কয়দিন থেকেছি তাঁর কাছে, মায়ের স্নেহই পেয়েছি। এই বাড়িতেই আমার রোদ্দুরের জন্ম। এইখানেই আমার সঠিক সংসার যেন শুরু হল। এইবাড়ির রান্নাঘর ছিল দারুণ। কাকীমার সখের রান্নাঘর এটি, অনেকটা আমার মায়ের রান্নাঘরের ধরণে তৈরি করা। বেশ গোছানো তাক এবং গ্যাসের টেবিল, দুটি বড় বড় জানালা, আলোহাওয়ায় ঝলমলে একটি স্বাস্থ্যকর রান্নাঘর। কিন্তু রাঁধার জিনিস তেমন কিছু জোগাড় করতে পারতাম না। তখন আমরা টিউশনের দিকে ঝুঁকছি, কারণ সেলসের কাজে আমার প্রাক্তনের শরীর দিচ্ছিল না ঠিক। অসম্ভব টানাটানির সময়। এর মধ্যে রোদ্দুর পেটে এসে গেল। তখন আমার প্রায় রাক্ষসের খিদে, আর খাবার দাবার খুব কম।
মাসের শেষে হাতে টাকা পয়সা প্রায় থাকত না বললেই চলে।
রোদ্দুরের জন্মের পর এই অবস্থা খানিকটা কাটলো। তখন বেশ ভালো টিউশন করতে শুরু করেছে আমার প্রাক্তন। এইসময় আরেকটি জনতা স্টোভ কিনলাম রান্নাঘরের জন্য। প্রতিটি পয়সা নিঁখুত হিসেব করে সংসার চালাতাম, তাতে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও না খেতে পাওয়ার কষ্ট আর ছিল না। এই রান্নাঘরে আমার রাঁধার প্রতি আগ্রহ তৈরি হল এইবার। এখানে আমি রেঁধেছি থোড়ের কাটলেট, চিকেন বিরিয়ানি, সবুজ লুচি মটরশুঁটি বা হিং-এর কচুরি, নানাস্বাদের আলুর দম, শিং মাছের হিঙ্গী, নারকেলের পোলাও…এমন বিভিন্ন রসালো রান্না। তবে এগুলি খুব ই কালেভদ্রে হত। টাকাপয়সা টুকটাক জমলে, তবেই।
কাকীমার বাড়ি থেকে আমরা মল্লিকপুরেই হসপিটাল পাড়ায় আরেকটি বাড়িতে চলে আসি। এইবাড়িতে রান্নাঘর বলে কিছুই ছিল না, একটুকরো বারান্দায় রান্না করতাম। খুব অসুবিধাজনক ব্যাপার ছিল। তবে এইসময় আমার সঙ্গী হল একখানি ছোট ক্লিক্স-গ্যাস। জন্মদিনে মা উপহার দিয়েছিলেন। এতে আমার রান্নার কষ্ট অনেক কমে গেল। বিশেষত জনতা স্টোভের সলতে পরানো থেকে রেহাই পেলাম।
এই বাড়িতে রান্নাঘরে একটা ছোট তাক ছিল মাত্র। ফলে সব কিছু শোয়ার ঘরে খাটের তলায় রাখা থাকতো। কী যে সমস্যা লাগতো! আর গ্যাস টেবিল না থাকায় মেঝেয় বসে বসে রান্না। খুব ঝামেলায় কেটেছে এই রান্নাঘরের সময়টুকু।
এরপর আবার বাসাবদল। এবার আবার এলাম বারুইপুর। বারুইপুরে এখনো অবধি সাতবার বাসাবদল হয়েছে। এবার এই সাত রান্নাঘরের গল্প।
(ক্রমশ)