সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১৮। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

দুই
জানাবোঝার জন্য পুনরপি মিজুতানি-র শরণাপন্ন হতে হয়। একাধিক সমসাময়িক সরকারি দলিল উদ্ধৃত করে মিজুতানি দেখাচ্ছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ইউরেশিয়ান এবং গরীব য়ুরোপীয় শিশুদের শিক্ষার জন্য বিস্তর চেষ্টাচরিত্র করা হয়েছিলো। লাভ হয়নি। ১৯০৭ সালের ‘বঙ্গদেশের শিক্ষা বিষয়ক তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী প্রতিবেদন’ (থর্ড কুইনকুয়েনিয়ল রিপোর্ট অব এডুকেশন ইন বেঙ্গল)-এ বলা হচ্ছে, যে সব শিশুদের য়ুরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা নিতান্ত হতচ্ছাড়াদের মত উৎকট পরিবেশে বেড়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত, সবচাইতে ভবঘুরে হতভাগা ইউরেশিয়ানও মনে করে, তার সঙ্গে য়ুরোপের একটা যোগাযোগ থাকছেই, তার গায়ে অর্ধেক য়ুরোপীয় রক্ত, সুতরাং যে কোন শ্রমসাধ্য কাজ করা তার মর্যাদার উপযুক্ত নয়। এমন লোকজনের যখন সন্তানাদি হয়, তাদের গতি আর আলাদা কি হবে? ফলে, তাদের শিক্ষাদানের যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, এক যদি না…
এক যদি না অপদার্থ বাবা মা-র কাছ থেকে বাচ্চাদের একেবারে আলাদা করে নেওয়া যায়, নিয়ে তাদের পাঠানো যায় নতুন স্বাস্থ্যকর পরিবেশে, যেখানে তারা শিখবে নীতিবোধ, উচিত-অনুচিত, সাম্রাজ্যের ইতিহাস, এবং শ্রমের মর্যাদা। ভালো শিক্ষা পেতে গেলে ভালো বাড়ি, ভালো পরিবার চাই, সরকারের সিদ্ধান্ত। মিজুতানি দেখাচ্ছেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই রাণী ভিক্টোরিয়ার সরকার কলকাতার ইউরেশিয়ন বাচ্চাদের শিক্ষার্থে অর্থব্যয় করতে শুরু করে, এই কাজে আলাদা করে তবিল বরাদ্দ করা হয়। অর্থাৎ, অর্থের অভাবে, বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগের অভাবে ইউরেশিয়ন শিশুদের পড়াশুনো হচ্ছে না, ব্যাপারটা আদৌ এরকম নয়, আসলে বাপ-মা চায় না বলেই হচ্ছে না, সরকারের বক্তব্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বা অবস্থায়, গ্রাহাম সায়েব আবির্ভূত হচ্ছেন মুশকিলআসান সান্তা ক্লজের মতো, কালিম্পং-এর ঠান্ডা পাহাড়, সেই পাহাড়ের সবুজ ঢালে বসানো সাদা-নীল স্কট বাড়িঘর নিয়ে, বাড়িতে বাড়িতে নতুন ভালো ‘মা’, শিক্ষা ও শ্রমের অফুরন্ত সুযোগ, সর্বোপরি ড্যাডি গ্রাহাম নিজে, এই অলৌকিক সমাধান নিয়ে।
যে বাবা-মা(আসলে মূলত বাবা, মা বলতে প্রায়শই অ-য়ুরোপীয়-অর্থে দিশি-কোন মহিলা) সন্তানদের য়ুরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায় না, তারা কার্যত সন্তানদের ‘পরিত্যাগ’ করে, সরকারি ভাষ্যের নির্যাস। এহেন বাপ-মা-র খপ্পর থেকে বাচ্চাদের ‘বাঁচানো’ দরকার, সরকার ভাবলেন, এবং সেইমতো, কলকাতা বা অন্য বড় শহরের ইউরেশিয়ন শিশুদের ধরেপাকড়ে কালিম্পং-এ পাঠানো হতে থাকলো। তারা সবাই সত্যি সত্যিই ভবঘুরে পরিত্যক্ত ছিলো না, অনাথ তো নয়ই। গরীব বাবা-মার সন্তান প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হতে পারে না, এই ভিক্টোরিয় ভাবনা সাম্রাজ্যের সর্বত্র চালু ছিলো, এমন কি খোদ বিলেতেও, সে গল্প বলছেন লিডিয়া মর্ডক তাঁর ‘কল্পিত অনাথেরা’ বা ইম্যাজিন্ড অরফান্স বইতে। রটগার য়্যুনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০০৬ সালে ছাপা এই বইতে সুশিক্ষা ও চরিত্রগঠনের নামে বাবামা-র কাছ থেকে একরকম কেড়ে নেওয়া, জোর করে অনাথ বানানো বাচ্চাদের কথা বলা আছে, মর্ডক ও অন্যান্য লেখকদের অনুসরণ করে যে কথা বলছেন মিজুতানিও।
কালিম্পং-এর হোমের কথায় ফিরি। কলকাতার ‘অনাথ’ বালকবালিকা এবং ডুয়ার্স তরাই দার্জিলিং-এর বিভিন্ন য়ুরোপীয়(প্রধানত স্কট) ম্যানেজারকূল সঞ্জাত ইউরেশিয়ান শিশুরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের নতুন বাড়িতে আসতে থাকলো। নিজেদের বাড়িতে থাকলে জন্মে তাদের যা জুটতো না, সেই য়ুরোপীয় শিক্ষা নিতে। গ্রাহাম উঠেপড়ে লাগলেন যত দ্রুত সম্ভব তাদের উপনিবেশসই করার জন্য। কিন্তু তার আগে ঠিকঠাক শিক্ষা দরকার। বাচ্চারা যদি আবার তাদের বাবা-মা-র কব্জায় চলে যায়, তাদের শিক্ষাদীক্ষা সব জলে যাবে। ছুটির সময়গুলোয়, বিশেষত
দীর্ঘ শীতের ছুটিতে? কটেজ খালি করে বাচ্চারা যদি সবাই বাড়ি যায়, তখন কি হবে? হোমের কর্তারা ভেবে পড়লেন। শেষে ঠিক হলো, যদ্দূর পারা যায়, বাচ্চাদের হস্টেলে রেখে দেওয়া হোক। পাহাড়ি শীত খুব কড়া, বাচ্চারা বাড়ি যেতে চাইবেও, তবু যেতে দেওয়া চলবে না। এই ব্যাপারটা চুপিসাড়ে করতে হবে, যেহেতু সিদ্ধান্ত ছিলো, যে সব বাচ্চাদের বাবা মা বর্তমান, শীতের ছুটিতে তাদের বাড়ি যেতে দেওয়া হবে। কটেজ সারা বছর খুলে রাখা হতে থাকলো। গ্রাহামের সেক্রেটারিকে নির্দেশপত্র পাঠিয়ে হোম কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘শিশুদিগের আপন স্বার্থেই ছুটির সময় উহাদের কালিম্পং-এই রাখিতে হইবে’। বলা হলো:
পিতামাতাকে সন্তানের মঙ্গল বিষয়ে যত্নবান হইয়া ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে…সন্তানদের সহিত মিলিত হইবার স্বার্থপর প্রবণতাকে দমন করিতে হইবে।
১৯০৯ সালের একটি হোম ম্যাগাজিন উদ্ধৃত করে মিজুতানি জানাচ্ছেন, হোম কর্তৃপক্ষ আরো চিন্তিত ছিলেন বাবা-মা-দের ইস্কুল ও হস্টেল থেকে বাচ্চাদের একেবারে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার ঘটনায়। এই ধরনের স্কুল-ছাড়ানো বাবা-মা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘তরলমতি’, ‘ ‘খামখেয়ালি’, ‘যত্নহীন’, এমনকি ‘মূর্খ’ও। নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে যাবার ব্যাপারটাকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘প্রায় অপরাধমূলক’ বলে।
(ক্রমশ)