রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ১১। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

বারুইপুরে ফিরলাম ২০০২ সালে। রোদ্দুর তখন প্রায় তিন বছরের। একটা ঘর, তার লাগোয়া রান্নাঘর বাথরুম। এই প্রথম সবকিছু একছাদের তলায় পেলাম। রান্নাঘরে গ্যাসের টেবিল তাক ইত্যাদিও আছে। তবে সবটাই খুব ছোট। রান্নাঘরে একজনের বেশি দাঁড়ানো যেত না। এই সময়ও আমার সঙ্গী ক্লিক্স। রান্নার সখ বাড়ায়, অজস্র কচি মেজো বুড়ো কৌটো এবং তাতে হরেক রকমের মশলায় তাক ভর্তি। তখন প্রাক্তন প্রচুর টিউশন করছে, অভাব দূর হচ্ছে ধীরে ধীরে। এইবাড়ি থেকেই আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হল।  এই বছর আমার অভিজ্ঞতায় বারুইপুরে গ্রীষ্মকালে লু বইল। সবরকম সবজি সেদ্দ করে নিয়ে তাতে জিরে কাঁচলংকা ফোড়ন দিয়ে একটা হালকা স্যুপ খুবই খাওয়া চলল আমাদের বাড়িতে। ওইসময় আরো একটা দারুণ ঝাপ্টা এল। প্রাক্তন বরের কী একটা ওষুধ খেয়ে সাময়িকভাবে কিডনী কাজ করা বন্ধ করে দিল। সে একেবারে যমে মানুষে টানাটানি দশা। ছেলেকে একবার মায়ের কাছে একবার প্রাক্তন শ্বশুর বাড়িতে রেখে সারাক্ষণ হসপিটালে পড়ে আছি। এইসময় আমাদের বাড়িওয়ালী আমাকে বললেন, চাবি আমার কাছে রেখে যাও, কাজের লোককে দিয়ে ঘর দোর মুছিয়ে রাখবো। আমি সাদা মনে দিয়েও ফেললাম। তিনি এত অভদ্র ছিলেন, যে সারা বাড়ির সমস্ত কিছু হাঁটকে দেখে ছিলেন, মায় রান্নাঘরের মশলার কৌটো অবধি!! তাছাড়া আমার বিছানায় শুয়ে বসে টিভি দ্যাখা ওয়াশরুম ব্যবহার করা তো ছিলই। খারাপ সময়ে মানুষ চেনা যায় বলে না, তা সে অভিজ্ঞতা এবার হল। অন্য সবকিছু ক্ষমা করা গেলেও রান্নাঘরে মশলার কৌটোতে হাত দেওয়া মোটেই বরদাস্ত করতে পারি নি, ফলে আবার বাসা বদল।

প্রাক্তন বর সুস্থ হওয়ার পরে পরেই বাসা বদল করে চলে এলাম দোলতলায়। এই প্রথম একটি দুই কামরা বাড়ির নীচের তলার সম্পুর্ণ অংশ আমরা ভাড়া নিলাম। তখন একটা ঘর পড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হত। রান্নাঘর সেই একই রকম, একজনের বেশি দাঁড়ানো যায় না। তবে এই রান্নাঘরটিকে আমি সাজিয়েছিলাম। বিভিন্ন ধরণের বাহারি কৌটো, জলখাবার খাওয়ার খোপকাটা থালা, ” গল্প হলেও সত্যি” সিনেমার মতো নানা সাইজের হাতা– ডালের হাতা পায়েসের হাতা ঝোলের হাতা টেবিল চামচ চা-চামচ আইসক্রিম খাওয়ার চৌকো চামচ লুচি ভাজার ঝাঁঝরি ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে। তারপর মায়ের দেওয়া একটি পুরোনো কাঠের মিটকেসের মাথায় একটি খেলনাবাটির মাটির হাঁড়িকুঁড়ি একটি মাটির থালায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম। তার পাশেই ছিল একটা বাহারি গাছ। রান্নাঘরে ঢোকার মুখেই এই ব্যাপারটা নজরে আসতো, আর আমার মন ভালো হয়ে যেত। এই বাড়িতেই আমার হল সিলিন্ডার ওয়ালা গ্যাসের উনুন। রান্নাবান্না করার কষ্ট অর্ধেক কমে গেল। আমিও আজ লুচি কি কাল আলুর পরোটা, আজ ডিমের পনির কি কাল ফিস ফ্রাই এসব বানানোয় মন প্রাণ সর্বস্ব দিয়ে ফেললাম। রান্না একটা নেশার মতো। রান্নাঘর সাজানোও একটা নেশা। এই দুই নেশার কবলে একত্রে যে পড়েছে, তার মুক্তি পাওয়া ভয়ানক কঠিন। একেবারে মদ ও সিগারেটের যুগ্ম নেশার মতো। একটার টানে আরেকটার মৌতাত বাড়ে অথবা এমন ও ভাবা যেতে পারে, যেখানে যার কাজ সেখানেই তার মুক্তি। সিনেমা থেকে চুরি করে কথাটি বললাম। কোন সিনেমা তা আশা করি বলে দিতে হবে না।

এই সময় আমি একটি স্কুলে পার্টটাইম শিক্ষিকার কাজ পেলাম। অতি সামান্য বেতন। তবু নিজের রোজগার তো! কয়দিন পর পেলাম একটি হাই স্কুলে পার্শ্বশিক্ষিকার চাকরি। বেতন সামান্য বাড়ল। আর আমার বাড়ল টাপারওয়্যারের কন্টেনার কেনার নেশা! একজন দিদি আসতেন স্কুলে রঙিন রঙিন ব্রোশিওর নিয়ে, আর সেই ব্রোশিওরে কন্টেনারের ছবি দেখে আমার মনে হত সবকিছু কিনে ফেলবো। বিভিন্ন সাইজের লালনীলহলুদসবুজসাদা কৌটোয় আমার রান্নাঘরটিকে একেবারে ঝকঝকে করে ফেলবো। বেতনের প্রায় আর্ধেক টাকায় সেইসব বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির কৌটো কিনতাম, রান্নাঘর সাজাতাম আর তার পাশে রাখা পুরানো কৌটোগুলিকে আমার চরম বেমানান মনে হত। ভাবতাম কবে ঐগুলিকে ও পালটে ফেলতে পারবো। পরের মাসে আবার কিনতাম… এমনি করে কিনতে কিনতে একসময় আমার কাছে টাপারওয়্যারের কিছু রেয়ার এডিশন ও এসে গেছিল। গোটা রান্নাঘর প্রায় টাপারওয়্যার রান্নাঘর বানিয়ে ফেলেছিলাম, এমন কি জলের বোতল, তেলের বোতল সসের বোতল অবধি। আগেই বলেছি, নেশায় পড়ে গেছিলাম।

এই বাসা থেকে আমরা চলে গেছিলাম গোলপুকুরে, সেখানেও একই ধরণের বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল। এখানে আমার কুট্টু হল। দুই ছেলে স্কুল সামলে আমার তখন ভরপুর ব্যস্ততা। এই রান্নাঘরে আরো যেটি সুবিধা পেলাম, তা হল রানিং ওয়াটার। আর একটা ফ্রিজ ও আমরা এই সময় কিনে ফেললাম। প্রচুর ঝলমলে কৌটো রান্নার গ্যাস এবং রানিং ওয়াটার ও ফ্রিজ — রান্নাঘরের ব্যবস্থা এখানে এসে প্রায় পরিপূর্ণ রূপ পেল বলা যায়। এইসময় বারুইপুরে একটি দুটি ভালো রেস্টুরেন্ট হল। আমরা একটু আধটু বাইরে খেতে গেলাম। তখন রান্না নিয়ে আমি ভীষণ পরীক্ষামূলক মনোভাবে অবস্থান করছি। গ্রেভি চাউমিন খেয়ে এসে কী কী উপকরণ দিয়ে রেঁধেছে  বুঝে ফেললাম এবং বাড়িতে একই স্বাদের গ্রেভি চাউমিন রেঁধে ফেললাম। চিলি চিকেনের বেলাতেও তাই!! ধন্য ধন্য পড়ে গেল। তখন এমন হুট বলতে ইউ টিউব ছিল না, ফলে যা করেছিলাম সেটি খাবার খেয়ে স্বাদ বুঝেই করেছিলাম, কোনো রেসিপি ও দেখি নি। তখন সবে বাটন মোবাইল ফোন উঠেছে, তাতে এমন চাইলেই গুগুল করা যেত না। মোদ্দা কথা হল, তখন আমি খাবার খেয়ে একই স্বাদের সেই খাবার বানাতে পারছিলাম। রান্নাঘরের তখন তুঙ্গ অবস্থা। আজ কাঁচকলার কোপ্তা তো কাল লেমন চিকেন, পরশু চাপড় ঘন্ট তো তরশু ভেজ মাঞ্চুরিয়ান… এমন চলতেই থাকলো। তার সাথে আমূলের সাদা ঘিয়ে ভাজা অসামান্য নরম লুচি আর ঠাকুর বাড়ির কুমড়োর ছক্কা, বাসন্তী পোলাও এর সাথে খাসির মাংস কষা এসব সাবেকী ব্যাপার স্যাপার ও চলত সমান তালে। একসময়ের না খেতে পাওয়া পেট এমন করেই পুষিয়ে নিচ্ছিল এমন বলাই যায়!

এরপরের বাসস্থান কিরণ হাইটের তিনতলার ফ্ল্যাট। রান্নাঘরের যেটুকু পরিপূর্ণ হতে বাকি ছিল, তা এখানে পূর্ণ হল। এখানে রান্নাঘরের দেওয়ালে চকচকে টাইলস বসানো। তবে অই সেই একজনই রান্নাঘরে থাকতে পারবে। ছোট্ট রান্নাঘর কিন্তু পরিপাটি। এখানেও আমার রান্নাবান্না যথারীতি চার ছয় হাঁকিয়েছে, কোনোদিন জিরো করেছি মনেই পড়ে না।

এই বাড়ি থেকে আমরা নিজেদের একটা বাড়ি করার কথা ভাবতে শুরু করি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *