সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১৭। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

য়ুরোপীয় শিক্ষা, ইউরেশিয়ন ‘প্রশ্ন’ ও কালিম্পং সমাধান

এক

অনাথ আতুরদের জোগাড় করে, হয়তো বা আস্তাকুড় থেকে তুলে এনে এমন পরিবেশে রাখা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যকর, পরিষ্কার এবং চরিত্র গঠনে সহায়ক। কিন্তু তারা ‘ভালো’ বা ‘উপযুক্ত’ হয়ে উঠলে, সেখানেও তাদের অনেকদিন ধরে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না, নিতান্ত অল্প বয়সেই নিজেদের পরিপার্শ্ব পরিবেশ শিকড়বাকড় থেকে টেনে উপড়ে চালান করে দেওয়া হচ্ছে বহু, বহুদূর। বারনারডোর অনুগামী গ্রাহাম চাইছিলেন,  নিজের কালিম্পং-এর হোমে ওইরকম ‘বাড়ি’র আবহাওয়া তৈরি করতে, যে বাড়িতে  থাকতে আসা শুধু চলে যাবার জন্য। মিজুতানি এবং অ্যান্ড্রু(এবং মিন্টোও) দুজনেই বলছেন, হোমের আবাসিক শিশুদের মনের কথাটা ভাবা হয়নি। তারা যেখানেই থাক, নিজের পরিবেশে ছিলো, নিজের নিজের মায়ের কাছে, মা না থাকলে আত্মীয় পরিজনদের কাছে। সেই পরিবেশ থেকে আমূল উপড়ে ফেলে তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে বানানো কটেজবাড়িতে, মায়ের জায়গা নিচ্ছেন ‘ফস্টর মাদার’ বা পালিকা মা, তাঁকে ‘আন্টি’ বলে ডাকতে হয়। বাবা হচ্ছেন স্বয়ং গ্রাহাম, তাঁকে ডাকা হতো ‘ড্যাডি   গ্রাহাম’ বলে।

মিজুতানি-র কাজ থেকে আরো জানা যাচ্ছে, কালিম্পং-এর হোমের জন্য ১৯০১ সালে উডবর্ন কটেজ নামে প্রথম যে সম্পূর্ণ কটেজবাড়ি তৈরি হয়, সেখানে ‘মা’ হয়ে থাকবার জন্য খোদ স্কটল্যান্ডের ইলফোর্ডস্থিত বার্নার্ডো হোম থেকে মিস হান্টারকে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ, জায়গাটা কালিম্পং হতে পারে, আসল সায়েবরাজত্ব থেকে বহুদূর,  যার চারদিকে নানারকম নেটিভ ঝামেলা ও গড়বড় ছড়িয়ে, বলতে গেলে সবেমাত্র যেখানে সায়েবদের পা পড়েছে। তথাপি, তাতে কিছু যায় আসে না, জায়গাটাকে দেখতে হবে স্রেফ জায়গা হিসেবে, ঠান্ডা, ভেজা, পাহাড়ি। যে বাড়িতে বাচ্চারা থাকতে আসবে, তাও দেখতে হবে অবিকল সায়েববাড়ির মতো। বাড়ির কর্ত্রী হবেন স্কটল্যান্ড থেকে আসা কিম্বা নিদেনপক্ষে বিলেত থেকে আসা সাদা চামড়ার মেমসায়েব। বিলিতি অনাথ ভিখিরি শিশুদের যে জাতীয় কর্মশিক্ষা ও নীতিশিক্ষা দিয়ে সায়েবসাম্রাজ্যের যোগ্য করে তুলছিলেন বার্নার্ডো সায়েব, হুবহু সেইরকম শিক্ষায় শিক্ষিত হবে গ্রাহামের হোমের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আবাসিক ছাত্ররা। গ্রাহাম বিশ্বাস করতেন, আসল ব্যাপার হচ্ছে পরিবেশ। ঠিকঠাক পরিবেশ তৈরি করা গেলে দেয়লো পাহাড় থেকে স্কটল্যান্ডের ইলফোর্ডকে আলাদা করে বোঝা যাবে না। বার্নার্ডো সায়েব তাঁর হোমের বাচ্চাদের কানাডা পাঠাচ্ছিলেন, গ্রাহাম পাঠাবেন অস্ট্রেলিয়া কিম্বা নিদেন নিউজিল্যান্ডে। বিলিতি সায়েবশাসকেরা ব্রিটেনের  ‘সাদা’ পরিবেশে একগাদা ইউরেশিয়ান বাচ্চা ঢোকাতে বিশেষ রাজি ছিলো না, ফলে গ্রাহাম চেষ্টা করছিলেন যাতে তাঁর ইস্কুলের ছাত্রদের উপনিবেশগুলোয় পাঠানো যায়।

মিন্টো দেখিয়েছেন, মিশ্ররক্ত ইউরেশিয়ান শিশুদের উন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে কালিম্পং মিশনের অন্যান্য সায়েব মিশনারিদের সমূহ অনাগ্রহ ছিলো, তাঁরা মনেই করতেন না, এটা সায়েব ধর্মযাজকদের উপযুক্ত কাজ। মিন্টো ও মিজুতানি দুজনেই বলছেন, স্কটল্যান্ডের যে  চর্চের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহাম ভারতে এসেছিলেন, শুরুতে তাঁদেরও মনোভাব ছিলো, এইসব কাজ চার্চ ও সাম্রাজ্যের গরিমার সঙ্গে মানানসই নয়। শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক হিসেবে গ্রাহামের নামডাক ছড়ালে, পরে অবশ্য তাঁর চার্চ বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তাঁকে চার্চ অব স্কটল্যান্ডের সাধারণ সভার সঞ্চালক বা ‘মডরেটর’ হিসেবে নিযুক্ত করে। কিন্তু সে ১৯৩১ সালের কথা। শুরুর দিকে গ্রাহামকে নির্ভর করতে হচ্ছিলো ভারতের প্রশাসনিক কর্তাদের ওপর। তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি, ইতিপূর্বে যেমন বলা হয়েছে, ভারতীয় সায়েবকর্তারা গ্রাহামকে আগাগোড়া সাহায্য করে গিয়েছেন। সুতরাং, তাঁর মিশনবন্ধুরা যাই-ই ভাবুন, আর তাঁর নিজের চার্চ সাহায্য নাই-ই করুক, গ্রাহামের কাজ আটকায়নি।

কাজ আটকায়নি, এবং দফায় দফায় হোমের বাচ্চাদের বিভিন্ন উপনিবেশে পাঠানো হয়েছে। ছাত্র বা আবাসিক সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছিলো। গুটি কয়েক শিশুকে নিয়ে হোমের কাজ শুরু হয়েছিলো বটে। দ্রুত সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০, দশ বছর যাবার পর। আরো পনেরো বছর পর, ১৯২৫-এ, হোমের মোট আবাসিক ৬৩০, শুরু থেকে সে পর্যন্ত মোট ছাত্র ভর্তি হয়েছে ১৬৭১, যার চল্লিশ ভাগ ছাত্রী। কটেজবাড়ি ২৫টা, প্রত্যেকটাতে গড়ে ৩২ জন বাসিন্দা। এই সব তথ্য হোমের নিজস্ব পত্রিকা অর্থাৎ সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ কলোনিয়াল হোমস-এর ম্যাগাজিন থেকে পাওয়া।

মিজুতানি দেখাচ্ছেন, কীভাবে ভারতের ও সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গ্রাহামের ইস্কুল প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিশ শতকের প্রথম দিকটায় গ্রাহাম স্বনামধন্য, ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের বিশেষ পছন্দের লোক। শুধু নতুন ধরণের ইস্কুল খোলার কারণে নয়। গ্রাহাম এমন কাজ করছিলেন, যা আসলে রাষ্ট্রের করার কথা। কি করার কথা? সাদা চামড়ার য়ুরোপীয় ও মিশ্ররক্ত ইউরেশিয়ানদের নেটিভ আস্তাকুঁড়ের দারিদ্র্য ও অবহেলা থেকে তুলে এনে যথাবিহিত মর্যাদায় সমাজে পুনর্বাসিত করা, যাতে তারা সাম্রাজ্যের মানসম্মান রক্ষা করার উপযুক্ত হতে পারে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যের নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারে। সমসাময়িক নথি উদ্ধৃত করে মিজুতানি জানাচ্ছেন, একটা লব্জ চালু হয়ে গিয়েছিলো : আরো আরো কালিম্পং চাই! একটা হোম দিয়ে গ্রাহাম কজনকে বাঁচাতে পারবেন? ইউরেশিয়ান বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা তো দেশভর ছড়িয়ে। সবেধন নীলমণি একটা ইস্কুল তাদের কজনকে জায়গা দিতে পারে? বাকিরা কোথায় যাবে? কি হবে তাঁদের?

এ প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। হওয়া সম্ভব ছিলও না। আমাদের এই গল্প ভারতের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ বা সেই সমাজের ইতিহাস নিয়ে নয়। সুতরাং, হোম যাঁদের নিতে পারলো না, বা নিলেও, সায়েবি উপনিবেশে যাঁদের জায়গা হলো না, তাঁদের সবার গল্প বা ইতিবৃত্ত এখানে বলা যাবে না। তবুও, ‘ইউরেশিয়ান প্রশ্ন’ বলতে সে সময়ের সায়েব সরকার ঠিক কী বুঝতো, সে বিষয়ে কিছু বিশদে কথা বলা দরকার। নাহলে, গ্রাহামের হোমের আবাসিকদের নিয়ে আরো যেসব কথাগল্প আমরা বলবো, তা ঠিকমতো বোঝা যাবে না। কেন সায়েবসরকার গ্রাহামকে এত গুরুত্ব দিতেন, সেটা বোঝার জন্যও ‘ইউরেশিয়ান প্রশ্ন/সমস্যা’ ব্যাপারটা খানিক জানা দরকার।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *