রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৮। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

চৌকোণা পরোটা আর আলুভাজি

এবার বলব কাজী সাহেবের বাড়ির রান্নাঘরের গল্প। দেশের বাড়ি থেকে বারুইপুরে ফিরে আমরা প্রায় দুই আড়াই বছর কাজী সাহেবদের বাড়িতে ছিলাম। সেইসময় মায়ের রান্নাঘর কেমন ছিল তা তো বলেইছি, এবার কাজীসাহেবদের বাড়ির রান্নাঘরের কথা। এই রান্নাঘরের সাথে আমার প্রিয় চৌকো সাদা পরটা আর আলুভাজার সম্পর্ক, তাহেরী ভাত আর বিরিয়ানী খাওয়ার সম্পর্ক, লাল ভাত আর মুরগীর ভুনা খাওয়ার সম্পর্ক। এইসব রান্নাগুলির প্রত্যেকটির স্বাদ আমি প্রথমবার এই রান্নাঘর থেকেই পেয়েছি। রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা বম্মা আর নানি প্রায় প্রতিদিন জলখাবারের পরটা আর অমন স্পেশাল কিছু রান্না হলেই আমার জন্য দিয়ে যেতেন। তখন আমার ছিল সকালবেলার স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে সাদা অথচ মুচমুচে করে ভাজা পরটা আর আলুভাজা পেলে মন খুশি হয়ে যেত।

কাজীসাহেবেরা চার ভাই ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের রান্নাঘর আলাদা ছিল। বড়নানা আর মেজোনানার রান্নাঘর ছিল পাশাপাশি। সেজভাইয়ের অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বম্মা, তখন তাঁদের একমাত্র ছেলে খুব ছোট। বাড়ি থেকে তাঁর পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করা হলে, ছেলের অযত্ন হবে এই আশঙ্কায় তিনি শ্বশুরবাড়িতে পালিয়ে আসেন, এবং বিবাহ করতে অস্বীকার করেন। এই অবস্থায়, বম্মার বাড়ির লোকজন মেয়ের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং শেষমেশ ভেবেচিন্তে তাঁরা বম্মার বোনের সাথে মেজোবাবুর বিয়ে দিলেন। মেজোবাবুর এই স্ত্রীকেই আমি নানি ডেকেছি। মেজোবাবুর সংসারে চিরকাল বম্মা অংশীদার ছিলেন। বম্মার ছেলে বড় হয়ে বিবাহিত হলে তাদের আলাদা সংসার হলেও বম্মা চিরকাল নানির সংসারেই থেকেছেন।

বড়বাবু আর মেজোবাবুকে আমি নানা ডাকতাম। তাদের বাড়িটিও ছিল একসাথে। মোটা মোটা চৌকো থামওয়ালা বারান্দা পেরিয়ে দুটি সুবিশাল ঘর ছিল তাদের দুজনের। দুটি ঘরেই সুবৃহৎ আয়না লাগানো পালঙ্ক ছিল।

এইবাড়ির পিছনে সাদা বালির মাঠ পেরিয়ে ছিল ছোটনানার বাড়ি। তাদের দোতলা বাড়ির নীচের তলায় সুবিশাল হলঘরে আমি প্রথম সাদা-কালো বক্স ওয়ালা টিভি দেখি। সারা পাড়া ঝেঁটিয়ে তাদের বাড়িতে টিভি দেখতে আসত, ছোটনানার পরিবার দুটি সোফায় বসতেন, আর বাকিরা বসতেন মেঝেতে।

অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছন্দ এই গোটা পরিবারটির রান্নাঘরের দুটি ধরণ ছিল। বড়নানা আর মেজোনানার সমস্ত রান্নাই কাঠের উনুনে হত, আর ছোটনানার বাড়িতে কাঠের উনুনের ব্যবস্থাই ছিল না। তাদের রান্না হত কয়লা বা গুলের তোলা উনুনে এবং একটি পিতলের কেরোসিন স্টোভে। স্টোভ ও যে পিতলের হয়, তা এই বাড়িতেই প্রথম দেখা।

বড়নানা ও মেজোনানার রান্নাঘর ছিল পাশাপাশি। রান্নাঘর বললাম বটে, রান্নাঘরের ভিতর একটা করে কাঠের উনুন ও করা ছিল বটে, তবে বর্ষাকাল ছাড়া আর কোনো সময়ে সেখানে মোটেই রান্না হত না। সেগুলিতে মূলত থাকতো রান্নার চাল ডাল ময়দা মশলা আর একধারে ডাঁই করে রাখা থাকত করাত-ঘর থেকে কেনা ছাঁটাই কাঠ।

নানি আর বম্মার রান্নার আসল জায়গা ছিল এই রান্নাঘরেরই উঠোন চত্বরে একটা জোড়া উনুনে। বড় নানির রান্নার জোড়া উনুন ছিল ঠিক এর পাশেই। প্রায় জন পনেরো লোকের রান্না হত একেকটা উনুনে। পরপর চারটে উনুন রোজ সকাল বিকেল একসাথে জ্বলে উঠত। কুটনো কোটায় বাটনাবাটায় গল্পে সে এক জমজমাট ব্যাপার।

রোজসকালে বড় নানা আর মেজোনানা একসাথে বাজারে যেতেন। এই এত্তবড় ঢাউস একটা বাজার ব্যাগ আর মাঝারি সাইজের আরেকটা মাছ মাংসের ব্যাগ ভরে তারা বাজার করতেন। বাজার আসামাত্র বড়নানি, নানি আর বম্মা হাত থেকে বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। দুইভাই এক এক করে ফিরিস্তি দিতেন, ” আজ কুমড়োর সঙ্গে পুঁইশাক এনেছি মাঝের মাথা দিয়ে ঘ্যাঁট রাঁধবে, মুসুর ডালের সাথে বিট গাজর কুঁচিয়ে দেবে, কাতলা মাছের পেটি কড়কড়ে করে ভেজে আলু পটল দিয়ে ঝোল করবে, ঝোলে ভালো করে আদাজিরেমরিচ বাটা দিতে ভুলবে না…” এইরকম আরো কিছু…

সকালের জলখাবারকে কাজী সাহেবের বাড়িতে বলা হত নাস্তা। এই নাস্তায় খুদভাতের সাথে জম্পেস করে মাখা আলুভাতে থাকতো, নতুবা থাকতো বেশ মোটাসোটা ধপধপে সাদা চৌকোণা পরটা এবং আলুভাজি। পরটার গায়ে হালকা করে ফুটে থাকত সোনালী বুদবুদের মতো এক আধটা পর‍টার ফোসকা। সে যে কী অসামান্য মুচমুচে ব্যাপার ছিল কী বলবো! যেদিন পরটা হবে সেদিন সকালে দেখতাম এই এত্ত বড় একখান বিস্তৃত কাঁসিতে এমনি চূড়ো করে ময়দা ঢালা হল। তারপর সেই চূড়োকে ভেঙে গর্ত করে মাঝারি সাইজের বাটির একবাটি গলানো ঘি ঢেলে দিয়ে নুন ছড়িয়ে তাকে বেশ দলাইমলাই করা হল। ময়দার সাথে ঘি মিশ খেলে তবে জল ঢেলে ময়দা মাখা। কাঁসিতে এত ময়দা থাকত, দেখতাম, বম্মার কনুই অবধি ময়দা গুঁড়ো লেগে আছে। সেই ময়দা মাখা হলে একটা বেশ বড়সড় সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা পড়ত। ততক্ষণে নানি আলু কেটেছে, ওদিকে জোড়া উনুনের একধারে কড়ায় সর্ষের তেলে লঙ্কা পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে আলুভাজা বসে গেছে, আর আরেকদিকে মিশকালো লোহার এতবড় চাটু তেতে উঠল। এবার নতুন মামী পরটা বেললেন, আর একটা বড়সড় অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো থেকে এতখানি ডালডার ডেলা গিয়ে পড়ল চাটুতে। ডালডা গলে গেলে দুচারটে আগুনসহ কাঠ, নানি সরিয়ে দিতেন উনুন থেকে। এবার হাল্কা আঁচে সময় দিয়ে অমন সাদা আর মুচমুচে পরটা বানানো হবে। আর অল্প আঁচে গুমে গুমে আলুভাজাও রসিয়ে উঠবে। ছুটির দিনে সকাল বেলায় এই জলখাবার হলেই আমি জানতাম, ঠিক আমার জন্য এক প্লেট পরটা আলুভাজা এসে যাবেই। আর, আসতো ও। বম্মা বা নানি ঠিক কাজের ফাঁকে কলাইয়ের প্লেটে করে আমাকে সকালের নাস্তা পৌঁছে দিতেন। সেই সময় ও বাড়িতে সবাই সকালের নাস্তা কলাইয়ের ছোট থালাতেই খেতেন। একটা ব্যাপার এই বাড়িতে দেখতাম, নাস্তা খেয়ে যে যার খাবার থালা সাবান দিয়ে মেজে ধুয়ে কলের পাশে জানালা দিয়ে  রান্নাঘরের বাসনের তাকে রেখে দিত। ভাত খাবার সময় ও তাই। এতে বাড়ির মেয়েদের অনেক কম বাসন মাজতে হত। এ প্রায় ১৯৮৫/৮৬ সালের কথা। তখন ছেলেরা তাদের খাবার থালা মাজবে এ ব্যাপার ভাবনাতে আনাও সমস্যার ছিল। আমার মামা বা মাসির বাড়িতে এমন দেখিনি।

 

প্রতিদিনের রান্নাবান্নায় ভাত ডাল মাছের ঝোল চললেও, শীতের দিনে মাঝে সাঝেই মুরগী বা হাঁসার কষা একটা তরকারি হত, লাল এবং বেশ তেল রগরগে একটা তরকারি। চ্যাপ্টা তিজেল হাঁড়িতে অনেকক্ষণ ধরে কষে কষে সেটা রাঁধা হত। তার আগে জবাই করা মুরগী বা হাঁসের পালক ছাড়াতে বসা হত। রিঙ্কু দিদি বা পলি দিদি বসে বসে পালক ছাড়াচ্ছে এ আমার বেশ মনে পড়ে। পালক ছাড়ানোর পর আগুন করে সেই পালকহীন গোটা মুরগী বা হাঁসের মাংসটিকে সেঁকে নেওয়া হত। তারপর ছালসমেত সেটিকে টুকরো করা হত। সেইকারণেই হয়ত মাংস খুব তেলতেলে হত। তিজেল হাঁড়ির উপরে লাল তেল ভেসে থাকত, আর তেমনি মনমোহক গন্ধ… কিন্তু কী ঝাল রে ভাই! আমি প্রথমবার খাওয়ার পর দুই চামচ চিনি কড়মড়িয়ে খেয়েও মুখের ঝাল কমাতে পারি নি, আর আমার কানে তালা লেগে গেছিল! তারপর যতই গন্ধ বেরোক, ভুলেও অই মাংস আর খেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না।

রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনের অই কোণে ছিল একখানা হাঁস মুরগীর থাকার ঘর। সেই ঘরের ছিল এইটুকু একখানা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ডের ছোট দরজার মতো দরজা। তখন আমি এতই প্যাংলা যে সেই দরজা দিয়েও গলে যেতাম। হাঁস মুরগীর পেটের নীচ থেকে ডিম সংগ্রহ করতে আমার বেশ মজা লাগতো। একবার সদ্য পাড়া একটা ডিম হাতে তুলে দেখি সেটা তলতল করছে, আমি অবাক হয়ে সেই ডিম নিয়ে নানির কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, এটা কি খারাপ ডিম পেড়েছে? নানি হেসে বললেন, “না ওটা সাজো ডিম”। ” সাজো” শব্দের অর্থ আমি তো বুঝতে পারছি না! তখন নতুন মামী হেসে বললেন,” “সাজো” মানে, সবে পেড়েছে।” আমি নতুন একটা শব্দ শিখলাম।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *