রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৭। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

বড়মাসির রান্নাঘরের কথা বলবো, আর রান্নাপুজোর কথা বলবো না, তা কক্ষোনো হয় না।

আমার বড়মাসির বাড়িতে বেশ ধুম করে রান্নাপুজো হত। এই পূজায় ভোগ হিসেবে রকমারি আমিষ ও নিরামিষ পদ নিবেদন করা হত। এই পুজো আসলে মনসাদেবীর পুজো। মাসির বাড়িতে দেখতাম পাঁচরকম ভাজা, কচু ওল চালকুমড়ো মিষ্টি কুমড়োর নানাবিধ তরকারি, ডালচচ্চড়ি,  ইলিশ মাছ চিংড়ি মাছ পোনা মাছ ভাজা, পাকাকলার বড়া ভাজা, তেলের পিঠে, মালপো পায়েস এমন রকমারি সব রান্নাবান্না হত। রান্নাপুজোর সুগন্ধিত স্মৃতি আমার ছোটবেলাকে এখনো আমোদিত করে রেখেছে। চোখ বুজলে বড়মাসির হাতে রাঁধা ডাল চচ্চড়ির সুগন্ধ যেন টের পাই।

রান্নাপুজোর রান্নাবান্না শুরু হত পুজোর আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। আমার বড়মেসো তার আগের দিন আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতেন। সে ছিল এক দারুণ অভিযান আমার কাছে। আমার বয়স তখন বছর তিনেক, তখন থেকেই আমি মা বাবা ছাড়া একা একাই তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে লাফাতে মেসোর কাঁধে চড়ে বড়মাসির বাড়ি চলে যেতাম। খুব মনে পড়ে বড় মেসোর কাকভোরে এসে, আমাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ… তিনি প্রথমে মায়ের নাম ধরে ডাক দিতেন, ” আরু, উঠে পড়… ” আর তারপরেই সুর করে ডাক দিতেন, “মু–—ন—কা—-”

কড়া নাড়ার শব্দেই আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমি লাফিয়ে উঠেই মা’কে বলতাম,”ব্রাশ দাও”।

আমার বড় মেসো অজিত দাস একসময় মোহনবাগানের প্লেয়ার ছিলেন। পরের দিকে তিনি অ্যাথলেটিক ট্রেনার  হয়েছিলেন। তাঁর হাতে তৈরি আমার ছোটদি মল্লিকা দাস  ন্যাশনাল লেভেলের অ্যাথলেট ছিলেন। সেইসময় মেসো জুনিয়র সেকশনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভোর চারটে থেকে ট্রেনিং দিতেন রাসমাঠে।

রান্নাপুজোর আগের দিন ভোরে তিনি ট্রেনিং শুরুর আগে আমাদের বাড়িতে হানা দিতেন। আমি অমনি ঘুম ভেঙে উঠে ব্রাশ করে বাসি জামা পালটে তাঁর কাঁধে চেপে রাসমাঠে রওনা দিতাম। সে সময় আমরা বুম্মির বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। বুম্মির বাড়ি থেকে রাসমাঠ একমিনিটের রাস্তা। ওই ভোরে, তখন আলো ফুটেছে কি ফোটে নি, মেসো আমায় রাসমাঠের বকুল তলায় নামিয়ে দিতেন। দাদাদের বা দিদিদের কেউ একজন কাছের বকুল ডালে উঠে গিয়ে ডাল ঝঁকিয়ে দিত, আর ঝরঝরিয়ে পড়ত বকুল ফুল। ওরা প্র‍্যাক্টিসে চলে যেত,  আর আমি কোঁচড় ভরে ফুল তুলে গুটিগুটি পায়ে রাসমঞ্চের উপর গিয়ে বসতাম। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় কী আরামটাই না লাগতো আমার! তারপর ওদের প্রাক্টিস শেষ হত, ওরা কোষাঘাটার পুকুরে তোয়ালে ভিজিয়ে ঘাম মুছে সেই ভেজা তোয়ালে ঘাড়ে ফেলে হইহই করে আমাকে কোলে তুলে নিত। আমার তোলা ফুলগুলিকে ততক্ষণে মেসো ধুতির খুঁটে বেঁধে নিয়েছে। এই দাদা থেকে অই দিদির কোলে চড়তে চড়তে কখন টুক করে দত্তপাড়া এসে পড়তো। বড় মাসি ততক্ষণে পঁইটে ধুয়েছেন। উঠোনে জলছড়া দিয়ে ঝাঁট দিয়েছেন। সেই তকতকে উঠোন মাড়িয়ে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম তাঁর কোলে, চুমুটুমু দিয়ে বেশ একপশলা আদরে ভিজে ঘরে ঢুকতাম। তখন হয়ত সবে ধুলিদির ঘুম ভেঙেছে, হাতে ব্রাশ, আদরের বহর দেখে মিটিমিটি হাসছে…

মেসো ততক্ষণে খুঁটে বাঁধা বকুল ফুলগুলি ঠাকুর ঘর থেকে বাখারির ঝুড়ি এনে, তাতে ঢেলে দিয়েছেন। বড়মাসি, আমাকে জিগ্যেস করলেন, “বাসি জামা ছেড়েছ?” আমি ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলতেই, তিনি বলছেন,” তাহলে তো জানো তুমি জানো…” আমিও একছুটে ঠাকুরঘরে আলাদা করে রাখা মালা গাঁথার সূঁচ-সুতো নিয়ে বসে পড়তাম। একমনে কতগুলো যে মালা গাঁথতাম…বড় মাসির ঠাকুর ঘরে অনেক ঠাকুর, তাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা থালা গেলাস…মালাও তো চাই, আলাদা আলাদা…

এরমধ্যে রান্নাঘরে কাঠের জোড়া উনুন ধরে উঠত। মাটি লেপা বড় ঝকঝকে অ্যালুমিনিয়ামের কেটলিতে চা বসত। মেসো একসময় গুডরিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন বলে চা চিনতেন খুব ভালো। সেই অসামান্য চায়ের সুগন্ধ এখনো স্মৃতিতে রয়ে গেছে। চায়ের সঙ্গে থাকতো লোকাল বেকারির লম্বা লম্বা জিবেগজা বিস্কুট। আমি ছোট ছিলাম বলে চা পেতাম না, বিস্কুটের সাথে আমার জন্য আসতো দুধ। কিছুতেই ভালো লাগতো না খেতে। ততক্ষণে প্রদীপদাদা কিংবা টমিদাদা উঠে পড়েছে, আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই দুধের গ্লাস ওদের মুখের মধ্যে ঢেলে দেওয়ার তালে থাকতাম।

চা শেষ হতে না হতেই ওদিকে ধুলিদিদি আটা মেখে ফেলেছে, বড়মাসি আলু কেটে সাদা আলুর তরকারি বসিয়ে দিয়েছে। বড়মাসির হাতের এই আলু চচ্চড়ির আমি বিশেষ খাওনদার ছিলাম। খুব ভালো লাগতো। রান্না পুজোর জন্য সকালের খাওয়া দাওয়ার পাট খুব তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলা হত। তারপর রান্নাঘর কষকষা করে ধুয়ে ফেলা হত। ট্রাঙ্ক থেকে বেরোতো পুজোর বাসনপত্র। ভারী পাথরের থালা গেলাস বাটি… ওতে মনসাদেবীর ভোগ দেওয়া হবে। বেরোতো বিভিন্ন সাইজের রেকাব, গামলা হাঁড়ি কড়াই খুন্তি ঝাঁঝরি…সব পিতল কাঁসা বা তামার। একতাল তেঁতুল দিয়ে সেইসব বাসন ঝকঝকে করে ফেলা হত। মেসো অসম্ভব শৈল্পিকভাবে উনুনের জন্য কাঠগুলি কেটে আনতেন। ছোট বড় মাঝারি সাইজের কাঠগুলি রাখার জন্য রান্নাঘরে আলাদা আলাদা জায়গা ছিল। রান্নাঘরের জোড়া উনুন মাটি দিয়ে লেপে নতুন করে ফেলা হত। পাশের বাগান থেকে কেটে আনা কলাপাতা সাইজ করে কেটে ধুয়ে রাখা হত। আর, আলপনার জন্য আলো-চাল ভেজানো হত। এরপর সবাই চান করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সামান্য একটু জিরিয়ে নিত। দুপুর ৩টে বাজলেই ভাত খেকো কাপড় ছেড়ে আমরা সবাই কাচা জামা কাপড় পরে নিতাম। মাসি ধুলিদি মলিদি ওরা সবাই আরেকবার চান করে কুটনো বাটনা করতে বসত। কুটনো কোটার একাংশ নিয়ে ধুলিদি বসত একটা জনতা স্টোভ জ্বেলে। আমাদের খাওয়া দাওয়ার যত ভাজাভুজি সব ধুলিদি ভাজবে। আর ঠাকুরের ভোগের রান্নার অংশ নিয়ে বড়মাসি ঢুকত রান্না ঘরে। রান্নাঘরের দোর বন্ধ হত। রান্না করার সময় আর একটি শব্দও তিনি করতে পারবেন না। ওদিকে মলিদি নারকেল কুরছে। সাঁ সাঁ করে ওর হাত চলছ, আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখি। এদিকে ধুলিদি মাঝারি সাইজের একটা কড়াইতে একবোতল তেল পুরো ঢেলে দিল। আমি তো অবাক! এত তেল! দিদি হেসে বললে আরো লাগবে। তারপর একে একে ভাজা হল আলু রাঙাআলু কাঁচকলা নারকেল বরবটি কচু। সত্যি সত্যি তেল কমে এতটুকু হয়ে গেল! ওদিকে রান্না ঘর থেকে তখন আসছে কলার বড়া,  তেলের পিঠে মালপো ভাজার সুবাস। আর ততক্ষণে মেসো বাজার থেকে এনে ফেলেছেন এত্তবড় দুটো ইলিশ, কেজিখানেক চিংড়ি এবং বেশ বড় দুটো রুইমাছ। তখন বাজার থেকে মাছ কেটে আনার চল ছিল না। ডলি দিদির শ্বশুরবাড়ি ছিল বাড়ির কাছেই। ও এসে মাছ নিয়ে বসে যেত। একটু বড় হয়ে, আমি তখন সেভেন এইটে পড়ি, এই মাছেদের মধ্যে ইলিশ কাটার ভার বহুদিন আমার উপর ছিল। কোটা মাছের ও একভাগ রান্নাঘরে চলে যেত, একভাগ ধুলিদি ভেজে ফেলত। ওদিকে রান্নাঘরে তখন একে একে রাঁধা চলত ডালচচ্চড়ি, চালকুমড়ো-নারকেল, মিষ্টি কুমড়োর তরকারি, কচুশাক… সবার শেষে বসত কামিনী আতপ চালের পায়েস। এখন এ চাল দুর্লভ হয়ে উঠেছে, এখন গোবিন্দভোগই ভরসা। পায়েসের সুগন্ধ যখন নাকে আসত, তখন আমি ঘুমে ঢলে পড়ছি। সেই ঘুমঘুম চোখে দেখতাম, মাসি একসময় রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এল। মানে রান্না সারা। ততক্ষণে বাড়িতে এসে গেছে শিখাদি- কালিজামাইবাবু, ডলিদি তো আগেই এসেছিল, এখন ভোলাজামাইবাবু…কয়েকবছর বাদে, এদের সঙ্গে এসে পড়বে ধুলিদির বর সমীর জামাইবাবু, মলিদির বর প্রবীরজামাইবাবু, শিখাদির মেয়ে কণা, কণার ভাই, ডলিদির ছেলে বাবুলাল মেয়ে মুন্না আর ধুলিদির ছেলে পাপাই, মলিদির ছেলে…

রান্না ঘরের সামনে লম্বা বারান্দায় তখন কলাপাতার পাত পড়ত। প্রথমেই বসব আমরা ছোটরা আর জামাইরা। সবাইয়ের পাতে পড়বে গরম ধোঁয়া-ওঠা ভাত, পাঁচ রকম ভাজা, আর ডাল চচ্চড়ি। বড়মাসি এর মধ্যে করকর করে বলে উঠবে কচু ভাজা কেউ ফেলবে না, সবাইকে খেতে হয়। আমি অন্য তরকারি কিচ্ছু না খেয়ে শুধু ডালচচ্চড়ি চাইব, মুচকি হেসে দিদিদের কেউ একটু বেশি করেই ডালচচ্চড়ি পাতে দেবে। তেলের পিঠে কলার বড়া আজ সবাই একটা করে পাবে। ওগুলো বিশেষত কালকের জন্য। বাসি না হলে নাকি তেলপিঠের স্বাদ হয় না। শেষে আসবে চালতার অম্বল আর সেই সুগন্ধিত পায়েস। এই খাওয়া দাওয়ার মধ্যে একবার লোডশেডিং হবেই। তখন ছোটঘরে জ্বালিয়ে রাখা হ্যারিকেন নিয়ে আসবে দাদারা। আমাদের খাওয়া শেষ হলে কলাপাতা তুলে আমরা বারান্দার এককোণায় রাখা ঝুড়িতে জড়ো করবো। রাতের বেলা এঁটো বাইরে ফেলা যাবে না।

বারান্দা মোছা হলে এবার দিদিরা বসবে, আর জামাইবাবুরা পরিবেশন করবে। কী মজার গল্প আর সহজ হাসিঠাট্টায় ভরে উঠত সেইসব রাত…বড়ো মধুর সেই স্মৃতি।

পরের দিন ভোরে রান্না পুজোর জোগাড় শুরু হত। উনুন লেপে তাতে আলপনা দিয়ে তার মধ্যে কত রকমের মুকুল ফণিমনসার ডাল আর কাশ ফুল দেওয়া হত। আজ উনুনের ছুটি। সারাদিন আর রান্না হবে না। উনুনের পাশে  একটি বর্গক্ষেত্র এঁকে তার ভিতর একুশটা সাপের ছানা আঁকা হত, যাদের মুখটুকু হাঁ করা। সেই মুখে দুধ আর কলা দেওয়া হত। বেকারিতে নৈবেদ্য সাজানো হত আলো-চাল ফল মিষ্টি দিয়ে। আর থাকত বড় কালো পাথরের রেকাবিতে পান্তা ভাত, সব রকমের রান্না, পিঠে, পায়েস। পুজো হয়ে গেলে পাথরের থালার প্রসাদ পেতাম সব্বাই। শেষের দিকে পড়ে থাকা প্রসাদ পাথরের থালাতে আমি কোনো এক দিদির সাথে ভাগ করে খাচ্ছি একথা খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে পায়েসের হাঁড়ি কেঁকে খাওয়ার কথা। ডলিদিদির সাথে একটা ছোট চামচ নিয়ে আমিও পা ছড়িয়ে ওর পাশে বসে যেতাম। আজ সারাদিন রান্না নেই মানে বড় মাসির ছুটি ছুটি মেজাজ, কিন্তু রাতের রান্না সারাদিনের জন্য সামলে রাখতে তাকে অনেক তদারকি করতে হত। চুবড়ি দিয়ে রান্না ঢেকে সেই রান্না বড় একটা থালায় জলের উপর বসানো থাকতো। পান্তার হাঁড়িতে হাত দেওয়া বারণ ছিল। মাসিই একমাত্র নারকেল খোলার হাতায় করে সেই পান্তা পাতে তুলে দিতেন।

আর, আমরা ছোটরা তারপর সারাদিন ধরে তেলের পিঠে আর কলার বড়া ধ্বংস করতাম। এত খেতাম এত খেতাম যে দুপুর বেলায় আর পান্তা খাওয়ার জায়গা পেটে থাকতো না।  তবু, আমি ডালচচ্চড়ির লোভে খেতে বসতাম। এইটুকু পান্তা আর এত্তখানি ডালচচ্চড়ি খেয়ে উঠে পড়তাম।

তারপর বিকেল গড়িয়ে আসত। বড়মাসি বলতেন বৈকাল। বৈকাল হলে মা বাপি চলে আসতো আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। রান্নাপুজোর আনন্দ শেষ হত ফেরার পথে বিশ্বকর্মা ঠাকুর দেখে।

মাসির এই রান্নাঘরে একসময় গ্যাস এলো। কাঠের উনুনের জায়গায় বানানো হল সিমেন্টের গ্যাসের টেবিল। কাঠের রান্নার ঝুলকালি ধোঁয়া থেকে মাসির রান্নাঘর রেহাই পেল। কাঠের উনুনের ঠাঁই হল কলঘরের পাশে। ঐ নেহাতই জলগরম বা বড়োজোর ভাতটুকু তাতে করা হত। বাকি সব রান্না হত গ্যাসের উনুনে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *