সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

সোনা, রুপো, হীরে, শ্বেত, নীল, রেশম, সাটিন। নক্ষত্র, বৃত্ত, পংক্তি। পদ্ম, গোলাপ। রশ্মি, আলো। স্বর্গ। রাজা, রাণী, রাজকীয় নাইটদল। ওপরের টুকরো বয়ান থেকে, বৈভব, ক্ষমতা ও আধিপত্যের অপরিমিত প্রদর্শনী ছাড়া, সাম্রাজ্যের নির্যাস হিসেবে ধরা দিচ্ছে ন্যায় ও ধর্মধারণার এক অমোঘ রত্নবলয়। ভারতে নাইটদল গঠনের দরকার, কেননা, সিপাই বিদ্রোহের অন্তে, ভারতে মহারাণীর শাসনপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিধর্মী, বর্বর ও অসভ্যদের বশ্যতা মানতে বাধ্য করা গেছে, ধর্মযুদ্ধ জেতা গিয়েছে। ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে সায়েব ঔপনিবেশিকদের সন্দেহ ছিলো না, উপনিবেশ পত্তনের সময় এবং পরবর্তীতে, ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্প স্থাপনের নামে লুটপাট, শোষণ ও চুরিডাকাতির অব্যাহত ও অবিরল প্রক্রিয়াকে তাঁরা বস্তুত ধর্মযুদ্ধের অঙ্গ হিসেবেই দেখতেন।

সুতরাং, খেতাবের পর খেতাব, পংক্তির পর পংক্তি। লাট এবং লার্ড ব্র্যাবোর্ন সায়েবের নামের পরে লেখা ছিলো জি.সি.আই.ই, নিগলিতার্থ, নাইটস গ্র্যান্ড কম্যান্ডার, দি মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার, অর্থাৎ ‘ভারত সাম্রাজ্যের প্রখ্যাততমদের পংক্তি’ভুক্ত নাইট। এটার স্ট্যটিউটস পাওয়া গেলো না, তবে উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেলো এটাও চালু হয়েছিলো ভিক্টোরিয়ার আমলে, ১৮৭৮ নাগাদ। ডেব্রেটস, অর্থাৎ ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ উপনিবেশের তামাম হীরেনক্ষত্র জ্যোতির্মন্ডলি অর্থাৎ কিনা লার্ড, ডিউক যথা অভিজাত ও তুলনায় পাতি নাইটদের ঠিকুজি কুলুজির হিসেবনিকেশ রাখে যে বিখ্যাত সংস্থা, তাদের ওয়েবসাইটে ভারতীয় নাইটপংক্তির উল্লেখমাত্র বর্তমানে নেই। ব্রিটিশ সরকার একদা নিয়মিত ভারতে বা এই অঞ্চলে কর্মরত তাঁদের রাজপুরুষ ও সায়েবসুবোর তালিকা ছাপতো ইন্ডিয়া লিস্ট নামে। সে সব লিস্টে বিস্তর নাইট ইত্যাদির নামঠিকানা দেওয়া থাকতো, এখনো দেখা যায়।

গ্রাহাম সায়েবের ইস্কুলের ভিতরকার কিন্ডারগার্টেন, যার উদ্বোধন ঘটেছিলো লার্ড ব্র্যাবোর্ন সায়েবের হাতে, এবং যে প্রসঙ্গে সাম্রাজ্য ইত্যাদি নিয়ে এত কথার আমদানি, ১৯৩৮ সালে তৈরি সেই বাড়ির ডানদিকের দেয়ালে ম্যুরাল গোছের একটা দেয়ালছবি আছে। পুরোনো ছবি, দেয়ালে বৃষ্টির ছাঁট মেঘকুয়াশা লেগেছে এতগুলো বছর ধরে, তথাপি হোম কর্তৃপক্ষ এটিকে রঙটঙ করে কলি ফিরিয়ে যত্নে লালন করেছেন। সাদা জমিতে সরু লাল দাগে ফুটিয়ে তোলা সে ছবিতে কি আছে? দেখা যাচ্ছে, বড় বড় পাল তোলা নৌকো বন্দরে এসে লাগছে, কিম্বা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু হচ্ছে। দ্বিতীয়টাই হবে, কারণ ছবির একেবারে বাঁ পাশ ঘেঁষে যে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে, তা মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ড কি য়ুরোপের অন্য কোথাও হতে বাধ্য। আধা কাঠ, আধা ইট বা চুনসুরকি দিয়ে বানানো যে বাড়িগুলোকে ইদানীং ‘হাফ-টিম্বার্ড’ বলে অভিহিত করা হয়, সেরকম বাড়ি সব। সায়েবরা আমাদের পাহাড়ে সমতলে গেঁড়ে বসে এরকম বাড়ি বানাতেন প্রথম প্রথম। পরে সর্বত্র দিশি নেটিভরা সব ওইরকম ‘হাফ-টিম্বার্ড’ বাড়ি বানাতে শুরু করলো, সেই দার্জিলিং-য়ের পাহাড়চুড়ো থেকে কালিম্পং হয়ে নিচের তরাই ডুয়ার্সের সমতল, মায় আসাম, খাসিয়া পাহাড়, কোথায় নয়! সেই দেখেটেখেই বোধহয় সায়েবরা বেশি বেশি করে পাথর ইট দিয়ে মজবুত পাকা বাড়ি বানাতে থাকলেন। কালিম্পং শহরে ঢোকার মুখে, শহরের ভিতরে, রিল্লি উপত্যকায়, এখনো এরকম ‘হাফ-টিম্বার্ড’ বাড়ি প্রচুর দেখা যায়, কচ্চিৎ কখনো লোকে বানানও, বিশেষ করে লেপচারা। এরকম একটা কল্পকথা বা ম্যিথ চালু হয়ে গেছে, এই বাড়িগুলোই নাকি এলাকার মানুষের আদি বাড়ির উত্তরসূরী। উত্তরাধিকার হলে সেটা যে আসলে সায়েবসভ্যতার, ঔপনিবেশিকদের, কে কাকে বোঝায়? দেখতেশুনতে ভালো বলে অনেকের মতো আমিও চিরকাল বলে এলাম, দেখ হে, ওই হচ্ছে এখানকার, অর্থাৎ এলাকার আদি ইন্ডিজিনস স্থাপত্য। আসল পুরোনো বাড়িঘর, যেগুলো প্রায় সবটাই বাঁশ আর মাটি বা কখনো সখনো পাথর দিয়ে তৈরি হতো, সেসব এখন আর মাথা খুঁড়লেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সে যাক, ছবির কথায় ফিরি। নৌকো ভর্তি করে আছেন রাজপুরুষের দল, হয়তো বা রাজাও। তাঁদের পরণে মধ্যযুগীয় য়ুরোপীয় অভিজাতদের পোশাক। ছবির বাঁ কোণে একজন ধর্মযাজক, তাঁর হাতে খোলা বই, হয়তো বাইবেল। তাঁর সঙ্গে আরো ধর্মযাজক, কিছু মহিলাও। ছবির মাঝখানে হাঁটু মুড়ে নিচু হয়ে বসে আছেন সম্ভবত রাজা। তাঁর পিছনে অস্ত্র(কিম্বা তিনকোনা পতাকা) হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এক যোদ্ধা। ছবির একেবারে ডানদিকে লালচে ধ্বজ বা পতাকা কাঁধে নিয়ে চলেছেন আর এক যোদ্ধা। বিভিন্ন নৌকো থেকেও ওই পতাকা উড়ছে।

কিন্ডারগার্টেন অর্থাৎ শিশুদের ইস্কুলবাড়ি, তার দেয়ালে এই ছবি কেন? ছবিটা কি বোঝাতে চাইছে? আদি ঔপনিবেশিক সময়ের সমুদ্রযাত্রার কথা বলা হচ্ছে স্পষ্টত:, নৌকোর ধরণ দেখেই বোঝা যায়। দীর্ঘ দন্ডের মাথায় বাঁধা তিনকোনা পতাকা মানে হয়তো আরো আগেকার কথা, ভাইকিং-দের সময়কালের ব্রিটেনে রাজাদের পরিচয়জ্ঞাপক ধবজ বা স্ট্যান্ডার্ড ওইরকম দেখতে হতো। লাল পতাকা ব্রিটিশ রাজত্বের, পরে ব্রিটিশ উপনিবেশদের(অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড) পরিচয়জ্ঞাপক পতাকা হয়ে ওঠে। বিশেষত সতেরো শতকের প্রথম দিক থেকে যে কোন ব্রিটিশ জাহাজে বা নৌকোয় লাল পতাকা লাগানো বাধ্যতামূলক, সমুদ্রযাত্রার ক্ষেত্রে তো বটেই। পতাকা/ ধ্বজ ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে শ খানেক বছর আগেকার একটা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলো। ব্রিটিশ ফ্ল্যাগস নামের এই বইটা লিখেছিলেন উইলিয়ম গর্ডন পেরিন, তৎকালীন ব্রিটিশ নৌবহরের গ্রন্থাগারিক। ১৯২২ সালে কেম্ব্রিজ য়ুনিভার্সিটি প্রেস থেকে ছাপা এই বইতে ব্রিটিশ ভূখন্ডে ও উপনিবেশসমূহে বিভিন্ন পতাকা কিভাবে প্রচলিত ও গ্রাহ্য হয়, তার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণ, বিশেষ সমুদ্রযাত্রার ক্ষেত্রে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *