সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
গ্রাহাম সায়েবের ইস্কুল, সাম্রাজ্যচিন্তা ও একটি দেয়ালছবি
এক
হোমের ভিতরে ঢুকে একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না, সাম্রাজ্য ব্যাপারটা গ্রাহাম সায়েবের ভাবনা এবং তাঁর তৈরি ইস্কুলের চৌহদ্দি থেকে কদাচ দূরে ছিলো না। ইস্কুল প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝামাঝি, গ্রাহামের আবক্ষ মূর্তি। ডানদিক বাঁদিকে মেটে হলুদ রঙের ছোট বড় বাড়িঘর, তাদের মাথায় হাল্কা লাল রঙের টিনের চাল, ঘন সবুজ কাঠের বাঁধুনিতে কাঁচের জানলা, সায়েবি বাড়িতে যেমন হতো। হোমে ঢুকে ক্যাথরিন গীর্জার দিকে যাচ্ছি, বাঁহাতে একেবারে বাচ্চাদের ইস্কুল বা কিন্ডারগার্টেন। হোমের বাকি বাড়িগুলোর মতো, এই বাড়ির হলুদ গায়েও গাঢ় সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে শ্বেতপাথরের ফলক, সেখানে লেখা:
এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন
হিজ এক্সেলেন্সি
লার্ড ব্র্যাবোর্ন
জি. সি. এস. আই, জি. সি. আই. ই, এম. সি,
বাংলার গাভর্নর
১৯শে মে, ১৯৩৮
এই লেখা যখন লিখছি, সেটা ২০২৪-এর মে মাস, অর্থাৎ ওই ফলক বসানোর পর থেকে নয় নয় করে ৭৬ বছর অতিক্রান্ত। ব্র্যাবোর্ন সায়েবের নাম জানা ছিলো, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাঁর নামের সঙ্গে লাগানো ওই আপাত দুর্বোধ্য অক্ষরজটলার অর্থ কি, জানতে বড় ইচ্ছে হলো। মনেই হচ্ছিলো খেতাব টেতাব হবে, ভালো করে খুঁজে দেখি, ভারতে সায়েবসাম্রাজ্য পত্তন ও রক্ষার তামাম বৃত্তান্তের ইতিহাস(অন্তত শেষ শ খানেক বছরের তো বটেই) ওই অক্ষরগুলোয় ঢুকে আছে।
জি. সি মানে গ্র্যান্ড কম্যান্ডার, এস. আই মানে স্টার অব ইন্ডিয়া। জি.সি. এস. আই খেতাবের পুরো অর্থ হচ্ছে নাইটস গ্র্যান্ড কম্যান্ডারl সায়েবরাজত্বের সে আমলে এই ধরণের নানান খেতাবের চল ছিলো। নানান খেতাব, তাকে ধারণ করার মতো নানান খেতাবপংক্তি, অর্থাৎ ‘অর্ডার‘। জি সি এস আই খেতাবটি যে পংক্তিভুক্ত, তার নাম ‘ভারতনক্ষত্র-র সর্বাপেক্ষা মহত্তম পংক্তি’, বা ‘দি মোস্ট এক্সাল্টেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া’। কপিরাইটবিহীন পুরোনো গুগল বইয়ের তাকে স্ট্যাটিউটস, অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া নামক নীল মলাটের একটি চটি পুস্তিকায় এই ‘অর্ডার’ স্থাপনার বিশদ নিয়ম-বিবরণ পাওয়া গেলো। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৮৬৬ সালের ১৯শে এপ্রিল, মহারাণী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং এই বিবরণ জারি করছেন। শুরুর দিকে যে বয়ান আছে, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নিছক ভারতের জন্যই একটি বিশেষ খেতাবপংক্তি শুরু হচ্ছে, যার শীর্ষে আছেন রাণী(কিম্বা রাজা, অর্থাৎ ‘সভ্রেইন’)। অতঃপর, ভারতের ভাইসরয় বা মহামান্য লাটসায়েব, যিনি কিনা এই পংক্তির পংক্তিমুখ্য বা গ্র্যান্ড মাস্টারও বটেন, সেই সুবাদে পংক্তির প্রধান গ্র্যান্ড কম্যান্ডারও। তাঁর নিচে মোট ২৫ জন নাইটস গ্র্যান্ড কম্যান্ডার, পংক্তির প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে ৫০ জন নাইটস কম্যান্ডার, তৃতীয় ধাপে ১০০ জন সঙ্গী, বা ডেজিগনেটেড কম্প্যানিয়ন। এই যে মোট ১৭৫ জন আদি পংক্তিসদস্য বা মেম্বর অব দি অর্ডার, এঁরা ছাড়াও রাণীর দরকারমতো বা ইচ্ছেমতো, তিন শ্রেণীতেই আরো সদস্য নেওয়া যাবে।
প্রথম থেকেই, রাজানুগত দেশীয় রাজাদের পংক্তির অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিলো। প্রথম ২৫ জন জি. সি. আই. এ বা গ্র্যান্ড কম্যান্ডারদের মধ্যে ১৫ জন আসবেন দেশীয় রাজা বা গোষ্ঠীপ্রধানদের মধ্য থেকে, বাকি ১০ জন ব্রিটিশ প্রজা। সেই সব রাজা, গোষ্ঠীপ্রধান বা ব্রিটিশ প্রজা খেতাবের জন্য বিবেচিত হবেন যাঁরা রাজানুগত্য ও একনিষ্ঠ সাম্রাজ্যসেবা মারফত ‘রাজানুগ্রহ লাভের ‘উপযুক্ত’। গোটা নিয়মবিবরণ বা স্ট্যাটিউটস জুড়ে এমন সব শব্দের ছড়াছড়ি, যাতে মনে হয়, এই নব্য নাইটকূল সত্যি সত্যিই ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধযাত্রী, এবং সময়টা নিতান্তই প্রথম মধ্যযুগ, শিল্প বিপ্লবের পরেরকার আধুনিক ব্রিটেন নয়। পংক্তিসদস্য নাইটদের শব্দ, ভঙ্গী, আদবকায়দা, রঙ, সব কিছুতে সজুত হতে হবে, কিছুমাত্র বেচাল চলবে না। আজকের সময়ে এহেন নাইটবৃত্তান্ত শুনে হাই উঠতে পারে। অথচ, সাম্রাজ্য বা এম্পায়ার বলতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা কি কি বুঝতেন, ঠিকমতো বুঝতে গেলে এ গল্পমধ্যেও ঢোকা প্রয়োজন। সাম্রাজ্যের প্রান্তে স্থিত কালিম্পং গ্রামের, সেই গ্রামের যে গল্প আমরা করতে চাইছি, তার সঙ্গেও এই ‘বড়’ ও ‘অন্য’ গল্পের নিগূঢ় সম্পর্ক। সে কথায়, প্রসঙ্গে দ্রুত ফেরত আসা যাবে। এখন, ভারতনক্ষত্র স্ট্যটিউটস-এর একটি ছোট টুকরোয় চোখ বুলোনো যাক।
নিচের উদ্ধৃতি মূলত পোশাক ও চিহ্ন(রোবস অ্যান্ড ইনসিনিয়া) সংক্রান্ত। পংক্তিসদস্যদের আনুষ্ঠানিক সমাবেশে এবং অন্যান্য মহতী উপলক্ষ্যে, নাইটরা কি পোশাক পরবেন? কি চিহ্ন/অভিজ্ঞান ধারণ করবেন?
…ধার্য করা যাইতেছে পংক্তিমুখ্য গ্র্যান্ড মাস্টার… ও অপরাপর গ্র্যান্ড নাইট কম্যান্ডারসকল যথোপযুক্ত পোশাক পরিধানপূর্বক ও অভিজ্ঞান ধারণ করত: সভাস্থলে উপস্থিত থাকিবেন…উহাদিগের পরিধেয়মধ্যে ক্ষীণ নীলাভ সাটিন আঙ্গরাখাবস্ত্র থাকিবেক, তাহাতে শ্বেত রেশম, শ্বেত রেশমনির্ম্মিত রজ্জু দ্বারা এই বস্ত্র বান্ধিতে হইবে, সেই রজ্জু সহিত নীলাভ এবং রৌপ্যসদৃশ রেশমনির্ম্মিত চামর গুচ্ছ সংযুক্ত থাকিবেক, আঙ্গরাখার বাম পার্শ্বে নাইট গ্র্যান্ড কম্যান্ডার-এর নক্ষত্র সূচিকর্ম থাকিবে, যাহাতে ক্ষীণ নীলাভ বৃত্তাকার ভূমির উপর পঞ্চকৌণিক হীরকখণ্ড হইতে স্বর্ণাভ রশ্মি বিচ্ছুরিত হইতেছে এইরূপ, তন্মধ্যে পংক্তির মুখ্য বিধান খোদিত থাকিবেক, ‘স্বর্গের আলোক আমাদিগের পথনির্দেশ করে’… এবং আমরা এতদ্বারা আদেশ করিতেছি যে, সকল নাইটস গ্র্যান্ড কম্যান্ডারগণ পংক্তির স্মারক রূপে নক্ষত্রচিহ্ন আপনাপন পরিচ্ছদোপরি সর্বদা ধারণ করিবেন…ইহা ভিন্ন সকল ‘কলার’ দিবসে একটি স্বর্ণ নির্মিত কলার পরিধান করিবেন, যাহাতে তালপত্রপরি একটি পদ্ম পুষ্প গ্রথিত থাকিবেক, এই সমগ্রটি একটি শ্বেত ও রক্তবর্ণ গোলাপপুষ্প সম্বলিত গ্রন্থি দ্বারা বান্ধিতে হইবেক… ‘কলারে’র মধ্যবিন্দুতে আমাদিগের মহারাজকীয় মুকুট থাকিবে…এই সকলই যথোপযুক্ত বর্ণশোভামন্ডিত থাকা প্রয়োজন, স্বর্ণশৃঙ্খল দ্বারা মুকুট ও অন্যান্য অংশ যুক্ত থাকিবেক, উক্ত মুকুট হইতে প্রথম পংক্তির স্মারক অভিজ্ঞান আলম্বিত থাকিবেক…
(ক্রমশ)