অক্সিজেন। পর্ব ৪০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

অন্য পাহাড়ের কথা

টেবিলে ল্যাপটপ রেখে ঘাড় গুঁজে কাজ করছিল বিলু। আজ ছুটি।লাঞ্চ খেয়ে আবার বইপত্র নিয়ে বসেছে ও।তবে এবার একটু উঠতে হবে। বিদেশের এই শহরে রিসার্চ করার জন্য কয়েকবছর থাকতে হচ্ছে ওকে। হয়ত হত না।হয়ত ও থেকে যেত আমৃত্যু ওর নিজের শহরে।বাইরের এই খোলা বাতাস গায়ে না মেখেই কাটিয়ে দিত বাকি জীবন।

আজও ওর মনে হয় কুহুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা ওর জীবনের একটা মাইলস্টোন।ওর গাড়িটা ওখান থেকেই পথবদল করেছে।

টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল বিলু ।এই এ্যাপার্টমেন্টটায় ও একদম একা এখন।বিনীত বিয়ে করতে দেশে যাওয়ায় পুরোটাই খালি।একা হাত পা ছড়িয়ে আছে।তবে মাঝেমাঝে বড় ফাঁকা লাগে।তখন ‘সে’ এসে দাঁড়ায়।কখনও কিচেনে কফির মগ হাতে খুনসুটি করে।কখনও হাত ধরে বাগানে ঘুরে বেড়ায়।

দরজা খুলে বাগানে বেরিয়ে এলো ও।চারপাশে এখন লম্বা লম্বা কমলা,সবুজ পাতা গাছের ঝোপ।রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে।এখানে বাগান ,বাড়ি ,রাস্তা সব টিপ্‌টপ্‌ থাকে। নিজে পরিষ্কার কর, নিজেই ঠিকঠাক রাখো, এরকম একটা নীতিতে বিশ্বাসী এরা। না মানলে সরকারী নোটিস পাবে।তাই মানতেই হবে।শীত এসেছে । একটু রাতের দিকে গুঁড়িগুঁড়ি বরফ পড়ে। একদিন সকালে উঠে দেখেছিল, বাড়ির সামনের খোলা মাঠটা সাদা হয়ে আছে।

রাস্তাঘাটে বেরোলে নিজের দেশের জন্য বড় মনকেমন করে ওর।জনসংখ্যা কম, তাই মাথাপিছু প্রাচুর্য্য অনেক বেশি ।পথের দুধারের সাজানো বাড়িগুলোর মত রাস্তাঘাট ,যানবাহন সবেতেই শৃঙ্খলার, পরিচ্ছন্নতার আশ্বাস ।আমরা এমন পারি না কেন, প্রশ্নটা মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভিড় আর ভিড়।চারদিকে লোক থিক্‌থিক্‌ করছে।কী করে পারব আমরা?

বিনীত জামসেদপুরের ছেলে।বারবার বলেছিল ওর বিয়েতে যেতে। কেন ও বাড়ি যায়নি এই ক’বছরে, কেন যেতে চায় না ওর বিয়েতে, সেকথা জানার জন্যও পীড়াপীড়ি করেছিল খুব।

ও এড়িয়ে গিয়েছে। কোন বিয়েতেই এখন যেতে পারবে না ও।তবে কেন, কিজন্য সেকথা বিনীতকে বলা যায়না।

ছোটের সঙ্গে কথা হয়েছে ওর। নিজের শহরে কুহুর সম্বর্ধনায় ওরা সকলেই যাবে, শুধু বিলু তখন একা একা বসে থাকবে এই ঠান্ডা কেজো শহরে ।ও কল্পনা করছিল ডায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটিকে। আজ সে এমন এক উচ্চতায় উঠেছে, যা ওরা কেউ কোনও দিন হয়ত ছুঁতে পারবে না।

ছোটে বলছিল, “কিরে?খারাপ লাগছে ?তুই আসতে না পারলে কী হবে,আমরা সবাই যাচ্ছি তো।ফুল রিপোর্ট দেব।ছবিও পাঠাব।”

খারাপ আর লাগেনা ওর।ওসবের বাইরে এখন।

নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর সেই প্রথম ছোটের সঙ্গে কুহুর আসার কথা ছিল ওদের বাড়িতে। শুয়ে শুয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিলু । ছোটের গলার আওয়াজ পেতেই উঠে বসেছিল। ততক্ষণে পিন্টু এসে টুল টেনে বসে পড়েছিল ওর ঘরে।

সমস্যার আর এক নাম পিন্টু। ও বসে থাকা মানেই সব কিছু একদম রেকর্ড হয়ে পরবর্তীতে ছোটের কানে ঢুকে যাওয়া। তাই পিন্টু থাকলেই ওকে বুঝেসুঝে কথা বলতে হত। কুহুকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল ছোটে। ঢুকেই হই হই করে উঠেছিল।

“সারাক্ষণ শুয়ে বসে আছিস কেন? উঠে বস।ডাক্তার তোকে হাঁটতে বলেছে তো। আবার কাজকর্ম করতে হবে না?”

ও জবাব দেয়নি, শুধু হেসেছিল একবার। কুহু দাঁড়িয়েছিল একপাশে।মুখচোখের ভঙ্গিতে স্পষ্ট বিব্রত ভাব।পিন্টু উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বসিয়েছিল সোফায়।পিন্টু সবসময় অমনই করত। যেন ওর দিদিমনিটি ওর একার সম্পত্তি। আর ঠিক তখুনি ঘরে ঢুকেছিল মা। এর আগেও মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে কুহুর। যেন কতদিনের চেনা এমন ভাবেই মা এগিয়ে গিয়েছিল কুহুর দিকে।

ঘরে এত লোক,তার মাঝে কুহু। বিলুর ভাল লাগছিল না একদম। ও দেখছিল পিন্টু কেমন সেঁটে বসেছে কুহুর পাশে।মা কুহুকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কী যেন বলছে, ছোটে হাসছে, ঝরঝরিয়ে কথা বলেই চলেছে।সব দৃশ্যটাই কেমন ‘হযবরল’র মত,আর ও যেন এসবের নিস্ক্রিয় দর্শক। সেদিন বোধহয় কুহু রাতের খাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল মার অনুরোধে। যদিও ওর ঘরে ছিল মিনিট পনেরোর মত।

ওরা চলে যাবার পর মা ওকে বলেছিল, “আমার খুব ইচ্ছে করছিল, কুহুকে কিছু দিই। কিন্তু নিজেকে সংযত করেছি।ওকে দেখেই মনে হয়েছে ও বড় নির্লোভ।তাছাড়া কোন কিছু দিয়ে ওকে কৃতজ্ঞতা জানানোটা বোকামী হবে। ও আমাকে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রাণদান করার ক্ষমতা সবার থাকেনা। ওকে আমি অনেক আশীর্বাদ করে বলেছি তোমার মনস্কামনা পূরণ হোক।তুমি জয়ী হও।”

জবাবে ও মার হাত চেপে ধরেছিল। মা কী বুঝেছিল কে জানে,একটু হেসে চলে গিয়েছিল ঘর ছেড়ে।

ওই দিনটা আজও মনে পড়ে ওর।মা খুব কম লোককে কাছে ঘেঁসতে দেয়।কুহুকে দিয়েছিল।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৪০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *