উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৬। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

গত পর্বের পর

পর্দার কবিতায় কালু

উড়নচণ্ডীর এলোমেলো জীবনটা আর মুখ ফেরালো না। এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে ছুটে বেড়ায়, ছড়ানো ছেটানো স্মৃতি ঝুলিতে ভরে। কত মুখ। কত না বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ। ফিরে দেখার কালে সেই সব মুখও ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঁকি মারে। এই যেমন হঠাৎই ওর মৃত্যু সংবাদ সব স্মৃতিকে এলো মেলো করে দিয়ে গেল। চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে লাগল কালু। না আমাদের পলাশীর ছোটবেলার কালু নয়। এ আমাদের যৌবনের কালু। এবার তাকে নিয়েই দু-চার কথা হয়ে যাক।

গত শতকের সত্তর দশকের মধ্যম পর্ব। জরুরি অবস্থা চলছে ভারতে। সঞ্জয় গান্ধির সাফাই অভিযান শুরু হয়েছে। চলছে নাশবন্দীর খেলা। গ্রাম-শহরে আড়কাঠিরা পুরুষ-মহিলা ধরে নিয়ে আসছে। দু-মিনিটে নাশবন্দী করে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল ছাড়াও গ্রামগঞ্জে শিবির করে চলছে পরিবার পরিকল্পনার খেলা। হাম দো হামারা দো। দেয়ালে দেয়ালে ত্রিকোণ বিজ্ঞাপন। অন্যদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে গণজোয়ার। কম্যুনিষ্ট, সমাজবাদীরা কারাগারে। এমনই ঝোড়ো সময়ে উড়নচণ্ডী একবার কৃষ্ণনগর, একবার আমোদপুর। তবে আমোদপুরের মিল আবাসেই অবস্থান অধিক সময়। কৃষ্ণনগরে কবি ও কবিতার আসর থেকেও একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এমনই একদিন আমার বন্ধু বঙ্কু, পোশাকি নাম জগৎ লাহা, পেশায় বাস কন্ডাক্টর, নেশায় কবিতা লেখক, প্রকাশ করত ‘অ-আ-ক-খ’ ছোট পত্রিকা, বলল, দুর্গাবাড়িতে কবি সম্মেলন হবে, যাবি?

–কারা করছে?

–একদল নতুন ছেলে করছে?

–তুই কবিতা পড়বি?

–না। এমনি শুনতে যাব।

–চল যাই।

দুপুরের দিকে কবিতা পাঠের আয়োজন। বঙ্কুর সঙ্গে গিয়ে একপ্রান্তে বসলাম নিতান্ত শ্রোতা হয়ে কিছুটা আড়ালে। অনেকেই কবিতা পড়ছে। কিছু নতুন মুখও আছে। কবিতা শুনছি, টানছে না। এরই মধ্যে ফর্সা, রোগা, ঢ্যাঙা এক যুবক কবিতা পড়ল। বেশ টানল কবিতা। কালো ট্রাউজারের সঙ্গে লাল ছোট ঝুলের পাঞ্জাবি পরেছিল। বেশ মানিয়েছিল ওকে। চোখ টানল। বঙ্কুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলেটি কে রে?

–চিনিস না? ও হচ্ছে কালু। ভাল লিখছে ছেলেটা।

–তাই?

–তুই তো এখন থাকিসই না। তাই তোর সঙ্গে পরিচয় হয়নি।

কবিতা পড়ে ফিরে এসে কালু বসল এক মহিলার পাশে। একটু ঝুঁকে দেখি, স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়। বেশ নাম করেছে। ভাল লেখে। বাড়ি শিবনিবাস। এক সময় আমাদের সঙ্গে হই হই করত। কত কবি সম্মেলনে আমরা একসঙ্গে গিয়েছি। ওদের বাড়িতেও গিয়েছ দু-চারবার। ঘুরিয়ে দেখিয়েছে প্রাচীন মন্দির। বেশ মনে পড়ে, সত্তর দশকের শুরু। একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবসান। স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে। শহরের রাস্তার অনর্গল ছুটছে মিলিটারি গাড়ি। ওপার বাংলা থেকে পাক-সেনাদের বন্দী করে আনা হচ্ছে। কোম্পানির বাগানের ওদিকে কোথাও মজুদ করে রাখা হচ্ছে তাদের। এদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের খতম অভিযান স্তিমিত। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর সিপিআই (এম এল) ও ভেঙেচুরে তিন-চারটে দল বা উপদল তৈরি হয়েছে। এক দিশাহারা অবস্থা। সালটা ১৯৭২। রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। শহরে তৈরি হয়েছে অ্যান্টি-নকশাল স্কোয়াড। পুলিশের সহযোগিতায় তারা পাল্টা নিধনযজ্ঞ শুরু করেছে। এরকমই ছিন্ন আবহাওয়ায়, জজ কোর্টের মোড়ে লেখরাজদার চায়ের দোকানে বসে পরিকল্পনা করা হল ‘কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মেলা’ আয়োজনের। টাউন হলের মাঠে তিনদিনের সেই বেসরকারি মেলায় লেখক-শিল্পীরা যেন প্রাণের স্পন্দন শুনতে গেল। গান-নাচ-কবিতা পাঠের সঙ্গে ছিল চিত্র প্রদর্শনী। সেই প্রদর্শনীতেই কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজের ছাত্রী স্নেহলতা তার আঁকা ছবি দিয়েছিল। তখনই পরিচয় হয়েছিল আমাদের সঙ্গে। সে ছবিও আঁকত, কবিতাও লিখত। আমাদের বন্ধু হয়ে গেল অচিরাৎ। হই রই করতে ভালাবাসতো। কাছে-পিঠের কবিসভায় সে ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী।

দিনের পর দিন গড়াতে থাকলে যেমন মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘটতে থাকে, স্নেহলতার সঙ্গেও তেমন ব্যবধান ঘটে গেল। আমার এই উড়নচণ্ডী জীবনটা তখন নানা উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। তবুও স্নেহলতা ছিল আমাদের আড্ডায় একটা নাম হয়ে। কখনো-সখনো উঠে আসত তার নাম। তা এতোদিন পর তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গাভীর মতো চোখ ছড়িয়ে মুখে এক উজ্জ্বল হাসি নিয়ে বলল, আরে তুমি? কেমন আছো? কতদিন পর!

–ভাল আছি। তুমি কেমন?

তারপর নানা কথা। নানাজনের খোঁজখবর। বেশ একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল এই গুমোট গরমে। সেই যে দেখা হল কবিসভায়, তারপর আর দেখা নেই। সেটাই স্বাভাবিক। ফিরে গেছি তখন আমোদপুরে। ফিরলাম সেই সাতাত্তরের নির্বাচনের আগে। তখন শহরে ভোটের পোস্টারে হইচই শুরু হয়ে গেছে।

শহরে ফিরে এসে পুরনো আড্ডায় মশগুল হলেও স্নেহলতা সেখানেও ছিল অনুপস্থিত। তারপর চলে এলাম কলকাতায়। কফি হাউসের কোনও টেবিলেও তাকে দেখতে পেতাম না। একটা কাগজের অফিসে তখন মুসাবিদা করি। কাগজের কাজেই দিন কেটে যায়। সন্ধ্যায় কফি হাউস ছিল মনের আরাম। সেই সময় কলকাতায় শুরু হল বঙ্গসংস্কৃতি উৎসব। রবীন্দ্র সদনের বিপরীতের মাঠে। সেই মেলায় আবার তার সঙ্গে দেখা।

কোনও একটি প্রকাশনী সঙ্গীতবিদ ভি বালসারা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। সেখানেই দেখা পেলাম স্নেহলতার। ছিল কবিতা পাঠের আয়োজন। কবিতা পড়ল সে। কথা হল কিছুক্ষণ। জানলাম ভাষা পরিষদে সে কর্মরতা। অনুরোধ করল যেতে। তখন বেশ নাম হয়েছে তার। কবি মহলে স্বীকৃতও হয়েছে। বলল, ভাষা পরিষদে এসো।

গিয়েছিলাম দিন দুয়েক। বুঝেছিলাম ওর সেই কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সের চপলতা আর নেই। আপাত গম্ভীরতার ছাপ পড়েছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে চাঞ্চল্যের স্রোত বয়ে যেতো। যেতো, কারণ আর সে নেই। গাছ জুড়ে যখন থোকা থোকা সাদা কুরচি ফুল কলকাতার কবিতার বাগান ছেয়ে ফেলছে, তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নিল। না, তা নিয়ে কোনও হইচই হয়নি। ফিসফিস কানাকানি করেই খবরটা ছুট লাগালো অন্ধকার গুহার ভিতর। হারিয়ে গেল স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায় – বাংলা সাহিত্যের একটি বলিষ্ঠ কলম। কতই বা বয়স হয়েছিল তার? কিন্তু মনের ভার কি বয়স মানে?

এই দ্যাখো, বসলাম কালুর কথা বলতে, ফেঁদে বসলাম স্নেহলতার গল্প। বয়সের ভিমরতি আর কি। যাক্‌, কালুর কথাই হোক।

ওই যে কবি সভায় দেখলাম তাকে। সপ্রতিভ চঞ্চল, উজ্জ্বল দুচোখ। মিশুকে। এমনই মনে হয়েছিল তখন। পরিচয় করিয়ে দিল স্নেহলতা। উত্তর দিল, আপনাকে চিনি।

বসলাম পাশে। ওর খাতা থেকে দু চারটে কবিতা পড়লাম। তখন উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে জোর আন্দোলন চলছে। উত্তম দাশ, অমিতাভ গুপ্তরা উত্তর-আধুনিক কবিতা নিয়ে আলোচনা করছেন, প্রবন্ধ লিখছেন, কবিতা লিখছেন। কালুর কবিতায় সেই উত্তর আধুনিক কবিতার প্রভাব দেখা গেল। ওহ্‌ বলতে ভুলে গেছি। স্নেহলতা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, এ হলো বিষ্ণুশ্রবা পালচৌধুরী। হ্যাঁ, ওটাই ওর নাম। ‘কালু’ নামটা বাড়ি, পাড়া বা কাছের জনের ডাকের। আমাদের কাছে ও ছিল বিষ্ণু। এবার থেকে ওই নামেই ডাকব। তা সেই বিষ্ণু কবিতার খাতা নিয়ে কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেছে। কফি হাউসে হাজিরা দিচ্ছে। খ্যাতনামা কবিদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছে। কবি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার এগুলো চিরকালীন পদ্ধতি। বিষ্ণুও সেই পথে পা বাড়িয়েছিল। এই সম্পর্কিত এক আড্ডায় শতঞ্জীব বলেছিল, ‘উহাতে কোনও দোষ নাই’।

যতদূর মনে পড়ছে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে। স্মৃতি কি একটু বিশ্বাসঘাতকতা করল? হতে পারে। তবে এটা মনে আছে, কয়েকজনের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে পাত্রবাজারে শোভন মুদ্রণী থেকে একটা ট্যাবলয়েড বেরোতে শুরু করে। সংবাদ পত্র। সাপ্তাহিক। গ্রাম-গ্রামান্তর। এটুকু মনে পড়ছে এককালীন নকশাল নেতা রামু ব্যানার্জি এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন। চারপৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড। নিউজ প্রিন্টে ছাপা। প্রকাশক ও মুদ্রক প্রেসের মালিক নীহার বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তালো তরুণ কবি ও গদ্যকার শতঞ্জীব রাহার ওপর। (জনান্তিকে বলে রাখি, একসময় শতঞ্জীব বদলে ‘সতঞ্জীব’ করে নিয়েছিল। জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিল, শত বছর নয়, সৎভাবে বাঁচতে চাই।) আর শতনকে (এই নামেই আমরা ডাকতাম) কাঁধ দেওয়ার জন্য ছিল এই উড়নচন্ডী। আমরা অবৈতনিক। কিসের টানে, কোন মতাদর্শে যে সংবাদপত্র করে যাচ্ছিলাম কে জানে! কিন্তু ক্রমশ নেশা হয়ে গেল। সকাল-বিকেল দু’বেলা প্রেসে হাজির। তারই মাঝে খবর সংগ্রহ, টিউশানি, প্রেসে বসে বিস্তর কাজ। লেটার প্রেসের যুগ। হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকি আমরা দুজন। টিউশানির পয়সায় মুড়ি চিবুই। ক্রমশ শহরের অন্য ট্যাবলয়েডকে পিছনে ফেলে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ এগিয়ে গেল।

সেই সময়টা ছিল ট্যাবলয়েডের যুগ। কৃষ্ণনগর থেকে বের হত ‘বিদ্যুৎ’। সাপ্তাহিক প্রতিবাদী কাগজ। বাজারে এলেই অমিল হয়ে যেতো। রানাঘাট থেকে বের হত ‘চ্যালেঞ্জ’। খুব নাম করেছিল সরকার বিরোধী কাগজ হিসাবে। সেই সময় প্রায় সব শহর থেকেই বের হত ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র। কোনটা সাপ্তাহিক, কোনটা পাক্ষিক। বীরভূমের সিউরি থেকে ‘চন্দ্রভাগা’ খুব নাম করেছিল। পরে তো ‘চন্দ্রভাগা’ দৈনিকও হয়েছিল। তবে বেশিদিন জীবিত থাকেনি। আবার সাপ্তাহিকে প্রত্যাবর্তন করেছিল। সারারাজ্যেই ছিল ট্যাবলয়েডের রমরমা। শহর কলকাতাতে এরকম বেশ কিছু ট্যাবলয়েড ছিল। খুব নাম করেছিল ‘কোল্ড ফিল্ড টাইমস’। কলকাতায় হোক, কি মফস্বলে দৈনিক কাগজের সাংবাদিকরা এইসব ট্যাবলয়েডের পিছনে থাকতেন। বেনামে লিখতেন। তবে গ্রাম-গ্রামান্তর এগিয়ে ছিল নিজেদের সূত্র ধরে। গ্রাম পঞ্চায়েতের অনেক বাম নেতার অপকীর্তিও ছাপা হয়েছিল। প্রশাসনেও তার প্রভাব পড়ত। ফলে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ হয়ে উঠল ‘বিদ্যুৎ’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী। বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রিতে ভাঁটা এলো, এগিয়ে গেল আমাদের কাগজ। ঠিক এই সময় যুব কংগ্রেস নেতা উত্তম গাঙ্গুলি বের করল ‘কৃষ্ণনগর সমাচার’। ছাপা হতে থাকল শোভন মুদ্রণীতেই। আমাদের কাগজ বুধবার, ওদের শুক্রবার। পত্রিকার প্রকাশ সময় ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় উত্তপ্ত পরিস্তিতিও তৈরি হয়েছে।

তা, ঠিক সেই সময় বিষ্ণু এলো প্রেসে। আমি আর শতন বসে কাজ করছি। উদ্দেশ্য কবিতার পত্রিকা করবে। নীহারদার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম আমরা। ষোল পৃষ্ঠার কবিতার কাগজ। নিউজ প্রিন্টে ছাপা। সেটাই তখন দস্তুর ছিল গরীব কবিদের। নাম দিল ‘উদাহরণ’। শতঞ্জীব লিনোকাটে নামটা খোদাই করে দিল। শতন তখন লিনোকাট ছবি খোদাইয়ের দিকে মন দিয়েছে। ভাল ছবি আঁকত সে। কবিতার পাশাপাশি গল্প লিখত নিয়মিত। ওর গল্পের খাতা ছিল একটা বই। প্রতিটি গল্পের শুরুতে গল্পের ছবি আঁকত। গল্পের শিরোনামও লিখত বিভিন্ন শৈলীতে। তখন গ্রাফিক্সের খুব চল ছিল। তা বিষ্ণুর ‘উদাহরণ’ বের হতে শুরু হল। শতঞ্জীবই পত্রিকা সাজিয়ে দিত। কয়েকটা সংখ্যা শোভন মুদ্রণী থেকে ছাপা হয়েছিল। তারপর আর বেরিয়েছিল কি না জানা নেই। কেননা ততদিনে সে সিনেমার দিকে ঝুঁকেছে।

বিষ্ণুর এক দাদা কলকাতায় একটা বড় অফিসে কাজ করতেন। সেখানেই চাকরি করতেন ‘দিবারাত্রির কাব্য’ সিনেমার অন্যতম পরিচালক নারায়ণ চক্রবর্তী। দাদার অফিসে যাতায়াতের সূত্রে নারায়ণ বাবুর সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। অমনি সিনেমার পোকাটা তার মাথায় ঢুকে পড়ে। সে সিনেমার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। একদিকে কবিতা চর্চা, অন্যদিকে সিনেমা নিয়ে পড়াশুনো। মাথায় ঢুকল কবিতা নিয়ে ছবি করবে। শর্ট ফিলম্‌। শক্তি চাটুজ্জের ‘অবনী বাড়ি আছো’-র চিত্রনাট্য লিখল। বেশ লিখেছিল। সেই পর্বে উড়নচণ্ডীও তাকে দু-চারদিন সঙ্গ দিয়েছিল। ক’দিন সেই চিত্রনাট্য বগলে নিয়ে কলকাতা প্রযোজকেরও খোঁজ করেছিল। একে নতুন পরিচালক, তার উপর কবিতার ছবি – কে দেবে টাকা? কিন্তু হাল ছাড়েনি সে।

সালটা বোধ হয় ১৯৭৯। কৃষ্ণনগরে এলো এক সিনেমা কোম্পানি। তারা ‘গোপাল ভাঁড়’ ছবি বানাবে। পরিচালক অমল শূরের প্রথম ছবি। তিনি অসিত সেন সহ বেশ কিছু খ্যাতনামা পরিচালকের সহকারি ছিলেন। কিছুদিন ছাত্র পড়িয়েছেন স্কুলে, কলেজে। তা তিনি কৃষ্ণনগরে নাটকের ছেলে-মেয়ের খোঁজ করলেন। তাদের দিয়ে অভিনয় করাবেন বলে। এতে একটা সুবিধা, বিনে পয়সায় সব হয়ে যায়। শুটিং হল নাকাসীপাড়ার কাছে। নদীয়ার ওই গ্রামাঞ্চলে ছিল সিংহরায়দের জমিদারি। কৃষ্ণনগর উকিল পাড়ায় তাদের বাড়ি। বড়ছেলে সৌমেন হয়ে গেল অমল শূরের সহকারি। সেই সব শুটিংয়ের ব্যবস্থা করল তাদের জমিদার বাড়িতে। গোঠপাড়ায়। আমাদের বন্ধু সুবীর সিংহ রায়, মানিক কর অভিনয় করল। ওরা তখন ‘নাট্যচক্র’ দলের অভিনেতা। অভিনয় করল সংলাপের কিশোর বিশ্বাস। মানিক পরেও অমল শূরের ছবিতে অভিনয় করেছে। তা, বিষ্ণু সেই দলে ভিড়ে গেল। সিনেমার শুটিং শেষ হওয়ার পর অমল শূরের সঙ্গে সৌমেন আর বিষ্ণু টালিগঞ্জে পা রাখল। হয়ে গেল পুরোদস্তুর সিনেমার মানুষ। সিনেমার কাজ শিখতে লাগল।

কিন্তু সে তো আর এক জায়গায় থাকার মানুষ নয়। নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ভিতরে ভিতরে সিনেমার খিদেটা বাড়ছে। খুঁজছে আরও ভাল গুরু। পেয়েও গেল। পার্থপ্রতীম চৌধুরী। তার কাছেই চলে গেল। এই পার্থপ্রতীমই ছিল তার প্রকৃত গুরু। সর্ব অর্থে। কিন্তু পার্থপ্রতীম তো তখন নিয়মিত ছবি করছেন না। অধেক লয়ে পড়ে থাকছে। তখন বোধহয় ‘কৃষ্ণপক্ষ’ বা ‘ক্যানভাস’-এর কাজ চলছিল। ছবি দুটি বাজারের মুখ দেখেনি। কিন্তু নিয়মিত ছবি না হলে তো টাকা পাবে না, পেট চলবে না। ফলে অন্য পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করতে হচ্ছে। কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকা, বিয়েও করে ফেলেছে। সুতরাং রোজগারটা তো করতে হবে। টলিউডে বেশ নাম করল। কাজ করল সৈকত ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ‘দুলিয়া’ ছবিতে প্রথম সহকারি। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের ছবি করতে শুরু করেছে। এভাবেই একদিন গিয়ে পৌঁছালো দূরদর্শনে। ততদিনে কবিতা সরে গেছে অনেকটা। বোধ হয় অভিমানে। মনের মধ্যে সিনেমার পোকাটা অবিরাম বকাঝকা করে চলেছে – সিনেমা কর, সিনেমা কর।

কলকাতায় চালু হল ডি ডি বাংলা। শুরু হল বাংলা ধারাবাহিক। বাংলা ধারাবাহিকের প্রথম যুগ। নাট্যকার পরিচালক জোছন দস্তিদার করলেন ‘তেরো পার্বণ’। সাড়া পড়ে গেল। সেটা গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষের দিকে। তখন দূরদর্শনের নিয়ম ছিল প্রতিটি ধারাবাহিক হবে তেরো পর্বের। এখনকার মতো অ্যাতো চ্যানেলও ছিল না। সরকারি চ্যানেল, ফলে বিষয় নির্বাচনেও সতর্ক থাকতে হত পরিচালকদের। পরিচালনায় এলেন তপন সিংহ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ। বাংলা ধারাবাহিককে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন। ঠিক এই সময় বিষ্ণুও এই ধারাবাহিকের খাতায় নাম লেখালো। সম্ভবত ‘পিতা পুত্র’ ছিল ওর তৈরি প্রথম ধারাবাহিক। মনোজ মিত্রের চিত্রনাট্য। এরপর একে একে আরও কয়েকটি তেরো পর্বের ধারাবাহিক করল। দূরদর্শনের পাশাপাশি বেসকারি চ্যানেলেও করেছিল। ক্রমশ সে কবিতার উঠোন থেকে সরে গেছে ক্যামেরার উঠোনে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কবিতা লেখা কি ছেড়ে দিলে?

ওর সস্মিত উত্তর, কেন লিখছি তো। সব কবিতা এখন সিরিয়ালে।

সেই সময় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র করছিল। সে সুনীল ও শক্তি দুই ভালোবাসার কবিকে নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করে। এখনও সেগুলো প্রর্দশিত হয়। দুটি তথ্যচিত্রই বড় সুন্দর।

তবে সে মাত করেছিল ‘জননী’ করে। হিন্দিভাষায় মেগা ধারাবাহিক শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হল। বিষ্ণু মুম্বাইতে গিয়ে মেগা ধারাবাহিক তৈরির খুঁটিনাটি দেখে এলো। বাংলা দূরদর্শনে জমা দিল প্রস্তাব। অনুমোদন পেল। দুলেন্দ্র ভৌমিকের একটি ছোটগল্প নিয়ে শুরু করল পারিবারিক মেগা ধারাবাহিক ‘জননী’। দুলেন্দ্রই প্রাথমিক চিত্রনাট্য লিখে দিতেন। বাংলায় প্রথম মেগা ধারাবাহিক তৈরির কৃতিত্ব অর্জন করল সে। ইতিহাস হয়ে গেল। ‘জননী’-র মধ্যে দিয়েই সে হয়ে রইল বাংলা মেগা সিরিয়ালের জনক। পরে সে দু-একটা বেসরকারি চ্যানেলে কাজ করেছে। কিন্তু এখনকার পরিচালকদের মতো ইধার কা মাল উধার করতে পারত না, বা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কান ধরে হিড়হিড় করে সিরিয়ালকে টেনে নিয়ে যেতে পারতো না বলেই হয়তো ক্রমশ সরে গেল। নিজের অর্জনটাকে সে বিসর্জন দিতে চায়নি।

সে দাঁড়িয়েছিল সিনেমার উঠোনে। প্রথম ছবি করল ‘অপরাজিতা’। প্রখ্যাত কবি গুলজারের গল্প। চিত্রনাট্যও তাঁর। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ছবিটা করেছিল বিষ্ণু। খুব একটা বাজারমূল্য পায়নি। কিন্তু দু-একটা পুরষ্কার পেয়েছিল। দ্বিতীয় ছবি করল ‘নীললোহিত’। কাহিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নীললোহিতের কাহিনি। অপূর্ব ছবি। সেলুলয়েডে কবিতা লিখল বিষ্ণু। এ ছবিও ভাল বাজার পেল না। ভালো বাজার না পেলে তো প্রযোজক এগিয়ে আসে না। তবুও চেষ্টা করতে লাগল। মাঝে কিছু দিন রুপোলি জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সমাজব্রতের কাজে আত্মনিয়োগ করল বীরভূমে। বেশ কিছুদিন পর, বা বলা ভাল কয়েকবছর পর আবার চেষ্টা করতে লাগলো নতুন ছবি করার। ইচ্ছে ছিল সুনীলের আরেকটি ‘নীললোহিত’ নিয়ে ছবি করবে। কিছুটা এগিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়। ইতিমধ্যে সে লিখে ফেলেছে একটি আত্মজৈবনিক কিশোর উপন্যাস। প্রকাশিতও হল। উপন্যাসের নাম ‘পুজোর অসুখ’। সে পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ নায়কের যৌবন নিয়েও আরেকটি উপন্যাসের খসড়া তৈরি করেছিল। সেটি পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়ে গেছে তার পরিবারে। ফিরে এসেছিল কবিতায়। কয়েক বছর আগেও সে কবিতার বই প্রকাশ করার বাসনা প্রকাশ করেছিল। এরই মাঝে সুবোধ ঘোষের একটি ছোট গল্প নিয়ে কাজ করবে বলে এগিয়েছিল। গল্পের সত্ব নিয়ে আলোচনাও চলছিল। এমন সময়ে ওর অসুস্থতা বাড়ল। ধরা পড়ল কর্কট। তারপর অনেক লড়াই। মাথা উঁচু করে বারবার জিতে যাওয়া বিষ্ণু এবার হেরেই গেল।

সেই যে যৌবনের প্রথম পর্বে কবিতার সঙ্গে সিনেমা ওর মগজ দখল করেছিল, সারা জীবন তার সঙ্গী হয়ে রইল। বহু বাধা পেরিয়ে সে নিজের সৃষ্টিতেই ছিল মশগুল। হ্যাঁ, পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয়তাকেও সে অস্বীকার করেনি। স্ত্রী-পুত্র, বাড়ি, গাড়ি সবই সে করেছিল সেলুলয়েডে কবিতা লিখে। তার জীবনসীমার শেষ দিকে অভিনয় শেখার একটি স্কুলও খুলেছিল। সেটিও বন্ধ করে দিতে হয় অসুস্থতার কারণে। সেই যে কৈশোরে কৃষ্ণনগরে কৃষ্টি সংসদে পরিচালক সুনির্মল সমাদ্দারের কাছে অভিনয়ের পাঠ নিয়েছিল, সেই অধীত শিক্ষা সে লালন করেছিল নিজের ভিতর। ভালো অভিনেতা তৈরির বাসনা থেকেই স্কুল খোলা। কিন্তু হল না। সে কাহিনি নিয়ে ভাবত। সে চলচ্চিত্রই হোক, কি দূরদর্শন ধারাবাহিকই হোক। এক সময় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প নিয়েও ভেবেছে। তার কবিসত্তা তাকে কাহিনি নির্বাচনেও প্রভাবিত করতো হয়তো। এখন বিভিন্ন চ্যানেলে চলতি ধারাবাহিকের জঙ্গলে চোখ রাখলে মনে হয় বিষ্ণু এখানে মিস ফিট। সেও বোধহয় জানতো। সেজন্যই বর্ষার কালো মেঘের মতো অতৃপ্তি নিয়ে ঠোঁটের ঝকমকে হাসি ছড়িয়ে চলে গেল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *