ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। একাদশ পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।

0

(গত পর্বের পর)

যখন কুড়ি ওভারের সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট কারোর সুদূর পরিকল্পনাতেই আসেনি, সেই সময় একটি ক্রিকেটীয় ফরম্যাট ছিল ডাবল উইকেট। নিঃসন্দেহে ডাবল উইকেট ক্রিকেট খেলার অন্যতম বৈপ্লবিক রূপ যেখানে দুইজন খেলোয়াড়ের একটি জুটি দল হিসেবে খেলতো।

যদিও এই ফর্ম্যাটের অস্তিত্ব অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের দশক থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু ক্রিকেটের এই ফর্মটি ১৯৭০ এরপর চরম জনপ্রিয়  হতে শুরু করে যখন শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির তারকা খেলোয়াড়রা খেলতেন। কারণ ছিল অফ সিজনে কিছু অর্থ উপার্জন বা কোনোও অবসর প্রাপ্ত ক্রিকেটারের জন্য অর্থ সংগ্রহ। পেপসি দ্বারা স্পনসর করা এমনই একটি ডাবল উইকেট টুর্নামেন্ট ১৯৯০ সালের অক্টোবরে মুম্বাইতে খেলা হয়েছিল।

ভারত দুইটি দল (জুটি) অংশ নিয়েছিল এবং বাকি ছয়টি সক্রিয় টেস্ট খেলতে থাকা দেশ দুটি শীর্ষ খেলোয়াড়কে একটি জুটি করে দল পাঠায়।  লিগ পর্যায়টি চার ওভারের ছিল যেখানে সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে যথাক্রমে ছয় ও আট ওভার।  দুই খেলোয়াড়কে দশবার আউট না হওয়া পর্যন্ত খেলা চলতো  এবং প্রতিটি আউটের জন্য পাঁচ রান খরচ হবে। ভারতীয় জুটি কপিল দেব-শচীন তেন্ডুলকার এবং রবি শাস্ত্রী-মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে।

১৭ বছর বয়সী তেন্ডুলকার ফাইনালের তারকা ছিলেন কারণ চারবার আউট হওয়া সত্ত্বেও তিনি ৩৩ বলে ছয়টি ছয় এবং পাঁচটি চারের সাহায্যে ৭৫ রান করেছিলেন। তেন্ডুলকার ও কপিলের জুটিতে ৫ উইকেট হারিয়ে ৯৫ রান। এর মানে রান কাটানোর পরে তাদের চূড়ান্ত স্কোর মোট ৭০ ছিল। জবাবে আজহারউদ্দিন-শাস্ত্রী জুটি মাত্র ২৭ রান করে, কারণ তারা সাত উইকেট হারিয়ে ৬২ রান তোলে।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এই ফর্ম্যাটটি একটি সফল উদ্যোগে পরিণত হয় এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলি পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও খেলা হয়। ১৯৯৪/৯৫ সালে এমনই এক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে শ্রীলঙ্কার জুটি অরবিন্দ ডি’সিলভা ও অর্জুন রণতুঙ্গ সংবাদ মাধ্যমকে জানায় যে তাঁদের দেশে ক্রিকেটের প্রচলন কম, তাঁরা যে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা জিতেছেন, তার জন্য যেন তাঁদের কিছু প্রচার করে দেওয়া হয়। এর মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই তাঁরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন।

১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে কয়েকটি চ্যাম্পিয়নশিপে সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কিছু ক্রিকেটারকে দেখানো হয়েছিল। পাকিস্তান সেই প্রতিযোগিতায় সহজেই সবচেয়ে সফল দল ছিল কারণ বোর্ড কিছু বড় নামকে অংশ নিতে দেয়। এই ফরম্যাট ছাড়াও ক্রিকেটারদের অর্থ উপার্জনের আরেকটি পথ ছিল মসালা ম্যাচ। মূলত বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত বিশ্ব একাদশ বা অবশিষ্ঠ বিশ্ব একাদশ বনাম একটি কোনও দল, বা কোনো প্রাক্তণ বা সদ্য প্রাক্তণ তারকাদের নিয়ে গঠিত দল করে খেলানো হতো। এই ধরণের ও আরও কিছু প্রাক টি টোয়েন্টি যুগের আর্থিক উদ্দেশ্যে আয়োজিত ক্রিকেট ম্যাচের বর্ণনার আগে আমরা ভারতীয় ক্রিকেটের একটি ঐতিহাসিক উল্লম্ফন নিয়ে আলোচনা করবো।  সেই বিষয়টি হলো টিভি সম্প্রচার।

১৯৫৯ সালে ভারতে টিভি সম্প্রচার শুরু হয়। ক্রমে বড় শহরের উচ্চবিত্ত মহলে টিভি প্রবেশ করে ষাটের দশকে। ১৯৬৬ সালে ভারতে প্রথম টিভিতে ক্রিকেট দেখানো শুরু হয়। তবে ১৯৭০ এর আগে টিভি খুবই কম মধ্যবিত্ত পরবারের অংশ হয়। ঘটনাচক্রে ভারতের একটা বড় অংশের মানুষ যুগপৎ টিভি ও ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হন ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বজয়ের পরে।

তখন ভারত ছিল নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দেশ। ভয়ঙ্কর আমলাতান্ত্রিক ও গতানুতিগকভাবে কাজ হতো। একদিকে ধীরে চলো নীতি ও  অন্যদিকে লাইসেন্স রাজ। ভারতীয় পুঁজিপতিরা নিশ্চিত বাজারের জন্য রাজনৈতীক নেতা, দল ও সরকারের সঙ্গে আঁতাত তৈরী করতো। তাঁর সঙ্গে ছিল সোভিয়েত মডেল ঘেঁষা প্ল্যানিং কমিশন। ফলে আক্ষরিক অর্থে টিভি ভারতে জনপ্রিয় হতে সময় নিয়েছে অনেক বেশি। ষাটের দশকে আগমন ঘটলেও মধ্যবিত্ত ভারতীয় ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে টিভির নাগাল পায় সম্পূর্ন রূপে। অবশ্য সর্বস্তরের মানুষের নাগালে যেতে আরও একদশক লেগেছিল। প্রতিবেশী পাকিস্তান কিন্তু সত্তরের দশকেই টিভির নাগাল পেয়ে গেছে।

ভারতে ক্রিকেট খেলা দেখানো হতো খুব নিম্ন মানের প্রযুক্তি এবং মাত্র দুটো (বেশিরভাগ সময় একটা) ক্যামেরা দিয়ে। দেশের মাটিতে টেস্ট ও ওয়ানডে সবই দেখালেও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ছাড়া টেস্ট দেখানো হতো ‘নির্বাচিত অংশ’। ওয়ানডে সবই দেখানো হতো। তখন দূরদর্শন খেলা দেখানোর জন্য বিসিসিআই থেকে টাকা নিতো, কোনোও টাকা দিতো না। উপরন্তু খেলা দেখানোর মাঝখানে অদ্ভুত সব অনুষ্ঠানের সূত্রপাত ঘটানো হতো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সহ চিড়িয়াখানা উদ্ভাবন সব দেখানো হতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ চলাকালীন।

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ধীরে ধীরে দূরদর্শন সাধারণ ভারতীয়ের ঘরে প্রবেশ করে, যদিও তখন মেট্রো শহর গুলো বাদ দিয়ে কোথাও দুটোর বেশি চ্যানেল ছিল না। এমন সময় ১৯৯১/৯২ বেশ কিছু উল্লেখ করার মতো ঘটনা ঘটে:-

(১) সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

(২) পূর্ব ইওরোপে কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টি পরিচালিত সরকারগুলোর পতন।

(৩) বার্লিনের প্রাচীরের পতন।

(৪) ভারতের অর্থনৈতিক সংকট।

(৫) ভারতে মুক্তবাজার।

(৬) উপসাগরীয় যুদ্ধ।

এই প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখতে হবে যে ভারতে বেসরকারী চ্যানেল গুলির আগমন কোন সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। প্রতিনিয়ত খবরের বন্যায় জনসাধারণ কে আপডেট রাখতে আরও বেশী টিভি চ্যানেলের দরকার ছিল। দরকার ছিল ধুঁকতে থাকা চলচ্চিত্র জগৎ কে বে-আইনি ভিডিও পার্লারের হাত থেকে টিভি চ্যানেলের হাতে আনা, যাতে টেলিকাস্ট থেকে আর্থিক মুনাফা হয় অন্য দিকে চলচ্চিত্র জগৎ লাভবান হয়। উল্লেখ্য, ১৯৮৬-১৯৯২ প্রায় ৭৫% ফিল্ম দুসপ্তাহের বেশি প্রেক্ষাগৃহে চলতই না।

অবশ্যই ১৯৮২/১৯৮৬/১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল, ১৯৮৩/১৯৮৭/১৯৯১-৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস প্রভৃতি বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পাশাপাশি নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রীড়াকে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়েছিল। এর জন্য আরও বেশি টিভি চ্যানেল দরকার ছিল।

এমতাবস্থায় ভারতে প্রবেশ ঘটলো কেবল নেটওয়ার্কের। প্রায় একই সময় অর্থাৎ ১৯৯২/৯৩ নাগাদ ইংল্যাণ্ড ভারত সফরে এলে ‘ ট্রান্স ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ‘ নামে একটি কোম্পানি চুক্তি করলো বিসিসিআই এর সঙ্গে। দূরদর্শনকে এই চুক্তির জন্য ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার দিতে হবে, বিসিসিআই এর ফলে ৬ লক্ষ মার্কিন ডলার মুনাফা করবে।

দূরদর্শনের এবার টনক নড়লো। সিএবি -র ৬৫ বছর উপলক্ষে আয়োজন হওয়া হিরো কাপ দেখানোর জন্য  তাঁরা ১ কোটি ভারতীয় মুদ্রা (৩,২০,০০০ মার্কিন ডলার) দেওয়ার প্রস্তাব দিল বিসিসিআই কে। কিন্তু তখন ‘ট্রান্স ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ অফার দিয়েছে ১কোটি ৭৬ লক্ষ এবং সারা বিশ্ব থেকে যে ‘রেভিনিউ’ আসবে তার ৭০%। ফলে বিসিসিআই দূরদর্শন কে পাত্তাই দিলো না। দূরদর্শন কিন্তু হারতে রাজি নয়। তারা এবার এক টাকাও দিতে রাজি হলো না। উল্টে ম্যাচ দেখানোর জন্য ম্যাচ প্রতি ৫ লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা দাবি করলো।

হিরো কাপ শুরুর দুইদিন আগে ঘটে গেলো সর্বাধিক বড় দুটো ঘটনা। প্রথমটা হলো, ১৮৮৫ সালের টেলিগ্রাফ আইনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো ‘ভারতের মাটি থেকে যেকোনো অনুষ্ঠানের আপ- লিংকিং  সিগনাল এর একমাত্র অথরাইজড অধিকারি ভারত সরকার এর সংস্থা।’ এই আপ লিংকিং সিগনাল কে ভারতীয় জনগণের যৌথ সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হলো।

দ্বিতীয় ঘটনা হলো ‘ট্রান্স ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ জিনিসপত্র এর দিল্লী, বোম্বে ও কলকাতা বিমানবন্দরে আটক করলো কাস্টমস। তৎক্ষণাৎ সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ জারি করে ছাড়ানো হলো।

এদিকে সমস্যা ঘনীভূত দেখে দক্ষিন আফ্রিকা হুমকি দিলো তাঁদের দলের সঙ্গে জিম্বাবুয়ের খেলা যেন দক্ষিন আফ্রিকার জনগণ দেখতে পায়, নাহলে আগামী বিশ্বকাপের আয়োজনে ভারত কে করা সমর্থন তাঁরা তুলে নেবেন। তাছাড়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিজেদের ঘরোয়া ক্রিকেট বিদেশ সফরের দোহাই দিয়ে আসেনি। পাকিস্তান শিবসেনার হুমকির ভয়ে আসেনি। ফলে কানপুরে ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা ম্যাচে অন ফিল্ড বিজ্ঞাপন প্রায় ছিলই না। বাস্তবিক, ইডেনে দিন রাতের ম্যাচ, প্রথম কৃত্রিম আলোয় কলকাতায় ক্রিকেট, ঐতিহাসিক সেমিফাইনাল – সেই দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে শচীনের শেষ ওভারে বোলিং বা ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অনিল কুম্বলের ১২ রানে ৬ উইকেট – এই সব শেষ পর্বের ঘটনা ছাড়া সম্ভব ছিল না হিরো কাপে লাভের মুখ দেখার।

অবশেষে ১৯৯৫ সালের ফেব্রয়ারি মাসে জাস্টিস পি বি সাবন্ত, বি পি জীবন রেড্ডি ও এস মোহন এক ঐতিহাসিক রায়ে স্বীকার করলেন যে ভারতের মাটি থেকে যেকোনো অনুষ্ঠানের আপ- লিংকিং  সিগনাল  ভারতীয় জনগণের যৌথ সম্পত্তি।  ফলে ভারতীয় জনগণের অধিকার আছে সবথেকে সেরা মানের অনুষ্ঠান দেখার। ফলে ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার জন্য এই ক্ষেত্রে একটি পাবলিক অথরিটি তৈরী হবে, যাঁরা এই বিষয়ে নজর রাখবে কোনো অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা। এই ঘটনা ও রায় বেসরকারী চ্যানেলকে এগিয়ে দিলো বহুদূর, নয়া উদারবাদ শক্ত হলো। আজ আই পি এল দেখানোর পঞ্চ – বার্ষিকী সত্ব স্টার স্পোর্টস কিনে নেয় ১,৬৩,৪৭৫ মিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রায়।

১৯৮৯  সালে শচীন যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসেন তখন ভারতে চ্যানেল দুটো। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় চ্যানেলের সংখ্যা ৫০ এর বেশি।

বিশ্বকাপ ১৯৯৬ ছিল নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সর্বাপেক্ষা বড় লীলা ক্ষেত্র। সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব রকমের জিনিস ক্রিকেট দ্বারা বিজ্ঞাপনের আওতায় পড়লো। ডিকি বার্ড থেকে কোর্টনি ওয়ালশ, সবাই মডেল হলেন, অফিসিয়াল চিউয়িং গাম থেকে অফিসিয়াল ঠাণ্ডা পানীয় সব কিছুই এলো; আবার কোনও কোনও ঠাণ্ডা পানীয় বিজ্ঞাপন দিলো ‘নাথিং অফিসিয়াল এবাউট ইট’। রঙিন পোশাক, সাদা বল আগেই ১৯৯১/৯২ এর বিশ্বকাপে এসেছিল। সেবারই শুরু হয়েছিল দ্রুত গতিতে রান তোলা বা পিঞ্চ হিটিং, যা সফল করলেন শ্রীলঙ্কার সনৎ জয়সূর্য। সঙ্গে নয়া উদারবাদের সর্ববৃহৎ ক্রিকেটীয় হাতিয়ারের জয়যাত্রার সূত্রপাত ঘটলো।

১৯৯৬-২০০১ ভারতে টিভি সম্প্রচারে এলো বিরাট পরিবর্তন। প্রচুর টিভি চ্যানেল, সস্তার কেবল কানেকশন, ঘরে ঘরে কমদামী কালার টিভি এবং ক্রিকেটের সর্বগ্রাসী প্রচার। এই সর্বগ্রাসী প্রচারের মূল ভিত্তি ছিল শচীন তেন্ডুলকরের পারফরম্যান্স। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এর মধ্যবর্তী পর্বে শচীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১,০০০ এর বেশী রান করেন (টেস্ট ও ওডিআই মিলিয়ে)। ৪০ টি শতরান সহ। একবার তাকিয়ে দেখা যাক এই সময়ের কিছু স্মরণীয় পারফরম্যান্স।

বিশ্বকাপে ২টি শতরানের পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২টি শতরানের ইনিংস খেলেন শচীন। এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে টেস্টে দুটি শতরান করেন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কার বিরূদ্ধে একটি ও দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি শতরান করেন। ফলে টিভি চ্যানেল গুলোর সামনে থেকে দর্শকদের উঠে যাওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। ১৯৯৬ এ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা ছাড়াও শচীনের অধিনায়কত্বে টাইটান কাপ জেতা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দেশের মাঠে টেস্ট সিরিজ জিতে নেয় ভারত।

গোটা ১৯৯৭ জুড়ে ভারত শচীনের নেতৃত্বে চূড়ান্ত ব্যর্থ। কেবল টরেন্টোয় সাহারা কাপ জেতা ছাড়া (৪-১) ভারত বাদবাকি খেলার মধ্যে odi ম্যাচে মাত্র ৬টা ম্যাচ জেতে। যদিও টেস্টে হার হয় মাত্র দুটি টেস্টে, কিন্তু জয় একটাতেও আসেনি, উল্টে ১০টা টেস্ট ড্র হয়।

কিন্তু শচীন হয়ে ওঠেন অতিকায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে ১৬৯, জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১০৪, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে ১১৭, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৫ টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরী অর্থাৎ মোট ৬টি শতরান করেন।

১৯৯৮ সালে অধিনায়কত্ব ফিরে পান মহম্মদ আজহারউদ্দিন। ভারত অস্ট্রেলিয়া কে টেস্টে ২-১ ব্যবধানে হারায় ও পাকিস্তানের বিরূদ্ধে সিরিজ ১-১ করে। যদিও জিম্বাবুয়ে ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-০ তে হেরে যায়। কিন্তু দুবার শারজা ও একটি দূর্বল ত্রিদেশীয় সিরিজ জেতে ভারত। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ ২-২ হয়। জিম্বাবুয়ে কে হারিয়ে দেয় ২-১ এ। জয়ী হয় শ্রীলঙ্কার ইনডিপেন্ডেন্স কাপে।

শচীন ওডিআই খেলায় এই বছর ৯টি শতরান সহ ১৮৯৪ রান করেন (আজও একবছরে করা সর্বোচ্চ রান)।  তাছাড়া টেস্টে ৪টি শতরান করেন। শেন ওয়ার্নের রাতের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠা, শারজার মরুঝড় সবই এই বছর। শচীন হয়ে উঠলেন একপ্রকার ডেমি-গড।

১৯৯৯ ভালো গেলো না। তাও টেস্টে ৫টা ও ওডিআই খেলায় তিনটে শতরান হলো। এর মধ্যে বিশ্বকাপ চলাকালীন পিতার মৃত্যু, তড়িঘড়ি দেশে ফেরা, দেশ থেকে মাঠে নেমেই শতরান। সবই টিভির পর্দায় ধরা পড়লো। সেই বছর বিশ্বকাপের পরে আবার অধিনায়কত্ব, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে প্রথম ডবল সেঞ্চুরি ও অস্ট্রেলিয়া সফর।

সেই যুগে বাজাজ কোম্পানির বিজ্ঞাপনে শোনা যেত ‘বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবির’ … ‘বুলন্দ’ এর  ‘সশক্ত ভারত’ এ পরিবর্তন তখনও স্বপ্নের অগোচর। এদিকে বোম্বে শহরে তখনই বেসরকারি চ্যানেলের কথা শোনা যাচ্ছে, এমন সময় শচীন তেন্ডুলকার এলেন ‘ব্যান্ড এডের’ বিজ্ঞাপন নিয়ে। কিশোর টেস্ট তারকাকে দেখা গেলো পাড়ার শিশুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে। অতঃপর শিশুদের ‘স্বাস্থ্য সচেতনতা’র ভরসা জোগাতে তিনি এলেন এনার্জি ড্রিঙ্কের কাপ হাতে ‘বুস্ট ইস দ্য সিক্রেট অফ মাই এনার্জি’ পাশ থেকে কপিলদেবের আবির্ভাব’ আওয়ার এনার্জি’ বলে। অন্যদিকে শচীনের ব্যাট এমআরএফের লোগো। তিনি তখন তাঁদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ। মুক্তবাজারের ধাক্কায় খুলে যাওয়া ভারতে তখন নরম পানীয়ের হুড়োহুড়ি। সেই সময় পেপসি তাঁকে মডেল করলো। অতঃপর দেখা গেলো একটি মাত্র পেপসি বোতলের জন্য তিনি ও বন্ধু কুম্বলে পাঞ্জা লড়ছেন। কিন্তু তাঁদের বিভোর হয়ে পাঞ্জা লড়ার মাঝখানে কখন যে আজহার এসে পেপসি খেয়ে নিয়েছেন এটা তাঁরা দেখেননি। নরম পানীয়ের বিচিত্র বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন শচীন। বিচিত্র তার কন্টেন্ট। কখনও সেখানে তিনি বিদেশি খেলোয়ারদ্বারা কিডন্যাপ, কখনও ১৯৯৮ সালের অতিমানবিক পারফরম্যান্স এর জন্য বন্দনা হচ্ছে। সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনে রামাইয়া ওস্তাবইয়া’র সুরে গাওয়া হল ও শচীন আয়া রে ভাইয়া’। অজস্র ভাষায় সেই বিজ্ঞাপন প্রচারিতহল। বাংলায় তার তর্জমা হল ‘দেখো ভাই শচীন এলো’। এমনকি কলম কোম্পানির বিজ্ঞাপন ও করেছেন শচীন। যুগ বদলানোর সঙ্গে বিমা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে দেখা গেল তাঁকে। বয়স বাড়ছে। বিস্ময় বালক থেকে কিংবদন্তি ব্যাটার, অধিনায়ক, ১০০ কোটির ভরসা, ফলে শচীনের মুখ থাকলে হয়তো বিমা কোম্পানির ওপর ভরসা বাড়বে। এছাড়া গাড়ি, তেল, গ্রাচুইটি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে। জন-সচেতনতা যেমন পালস পোলিও, নির্বাচন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তিনি থেকেছেন। লক্ষনীয়, দেশের আর্থিক সংকট যত বেড়েছে ততই শচীনকে মুখ দেখাতে হয়েছে ব্যাঙ্ক বা বিমার বিজ্ঞাপনে। তুলনামূলক সুস্থির অবস্হায় তিনি করেছেন গাড়ির বিজ্ঞাপন।

এমনকি অবসরের ঘটনার বিষয়কে হাতিয়ার করে ফাঁকা ড্রেসিংরুমে বসিয়ে একটা বিজ্ঞাপন হয় ‘প্রথম শচীন বিহীন আই পি এল’-কে প্রমোট করতে। দেশ পাল্টেছে, যুগ পাল্টেছে, নয়া উদারীকরণ যুগের প্রায় শেষ দশায় এসে পৌঁছেছে অর্থনীতি। আজও বিজ্ঞাপন করেন শচীন। ‘রোড সেফটি’-র জন ক্রিকেট খেলাও বিজ্ঞাপনেরই অংশ।

 

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *