ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। দ্বাদশ পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের মাইলফলক। এই বিশ্বকাপ ১৯৮৭ পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। এক ধাক্কায় বদলে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। সঙ্গে বাণিজ্যিক দুনিয়া পেয়েছিল তাঁদের সেরা আইডল কাম অ্যাম্বাসাডরদের।

 

প্রথম ম্যাচে কেনিয়াকে হারায় ভারত। শচীন শতরান করেন। দ্বিতীয় ম্যাচে শচীনের ৭১, কাম্বলির ব্যাটিং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জয় এনে দেয় ভারতকে। এদিকে বল হাতে কুম্বলে, শ্রীনাথ ও প্রভাকর সফল হন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৬ রানে ভারত হেরে যায় শচীনের ৯০ সত্বেও। এরপরেই ধাক্কা। তখনই অবধি শ্রীলঙ্কাকে গুরুত্ব না দেওয়া ভারত (২৭১/৪) শচীনের শতরানের জন্য এগিয়ে ছিল। কিন্তু জয়সূর্য ও কালুবিতরণে মাত্র ৩ ওভারে ৪৪ তোলায় ভারত প্রথমেই ভেঙ্গে পরে। ম্যাচও হেরে যায়।

 

লীগের শেষ খেলায় ৩২ রানে ৩ উইকেট হারিয়েও কাম্বলির শতরান ও সিধুর ৮০ ভারতকে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে জয় এনে দেয়।

 

কোয়ার্টার ফাইনালে আমেদাবাদ শহরে ভারত (২৮৭/৮) পাকিস্তান কে (২৪৮/৯) ৩৯ রানে হারিয়ে দেয়। সিধু ৯৩ ও জাদেজা ২৫ বলে ৪৫ করেন। কিন্তু সেমিফাইনালে ইডেনে ১ রানে শ্রীলঙ্কার ২ উইকেট (৩৪/৩, ৮৫/৪) ফেলেও ২৫০ হওয়া আটকাতে পারেনি। উল্টে শচীন (৬৫) আউট হওয়ার পর ধ্বস নেমে যায় (১২০/৮)। মাঠে দর্শকদের তাণ্ডব খেলা বন্ধ করিয়ে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়ে দেয়। অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের অধিনায়কত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে।

 

বিশ্বকাপের ১৯ দিন পরে শ্রীলঙ্কাকে ১২ রানে ও আরেকটি ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ওডিআই খেলায় ৩০০ করে জিতলেও সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

 

এরপরেই আসে ইংল্যান্ড সফর। আজহারের পদ চলে যাওয়া তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সকলেই জানে যে শচীন পরবর্তী অধিনায়ক।

 

এদিকে পাক্কা ৪ বছর ৫ মাস ১৫ দিন পরে আবার আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেন সৌরভ গাঙ্গুলী। আজহার ৬৪ বলে ৭৩ করায় ভারত ২৩৬/৪(৫০) তোলেন। সৌরভ ৮৩ বলে ৪৬ করেন। রাঠোর করেন ৫৪। জবাবে ৪৮.৫ ওভারে ২৩৯/৪ তুলে ইংল্যান্ড জিতে যায়। ব্রাউন ১১৮ করে।

তখনো সৌরভ নিজেকে প্রমাণের সুযোগ তেমন পাননি। তিনটি প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৩২ রান (গড় ৬৬), একটি অর্ধশতরান -৬৪ বনাম গ্লোস্টারশায়ার। বল হাতে ৩ উইকেট। তাঁকে নামানো হতো ৬ কি ৭ এ। লিস্ট এ ম্যাচ ২ টো(odi সহ)। রান করেন ৬৭ । উইকেট ১ টা। দুটি মিসলেনিয়াস ম্যাচে ২১ রান ও ১ উইকেট।

 

প্রথম টেস্টের আগে আরো দুটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ছিলো। এসেক্সের সঙ্গে ২৮-৩০ মে ড্র করে ভারত। রাঠোর প্রথম ইনিংসে ৯৫ করেন। শচীন(এই ম্যাচে অধিনায়ক) ৭৪ করেন প্রথম ইনিংসে। জাদেজা দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৭ করেন। সৌরভ গাঙ্গুলী ৫১ ও অপরাজিত ৩৪ করেন। বল হাতে উইকেট পাননি। অস্ট্রেলিয়া দলের স্টুয়ার্ট ল এসেক্সের হয়ে ১৫৩ (২৬×৪,১×৬) করেন প্রথম ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসে নাসের হুসেন ৮৮ বলে ১০ টি চারের সাহায্যে ৮৫ করেন।

পরের ম্যাচে সৌরভ খেলেননি। ভারত লিচেস্টারের সাথে ড্র করে। রাঠোর ৭১ ও ৯১ , আজহার অপরাজিত ১১১ ( ৮৬ বলে ১০০) ও ৭২(অবসৃত) করেন।

 

৬ ই জুন, এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে গো হারান হারে ভারত। প্রথম দিনেই বিতর্ক। সিধু জানতেন তিনি দলে আছেন। তাই প্যাড পড়তে শুরু করেন। তখন তাঁকে জানানো হয় তিনি দলে নেই। উত্তেজিত সিধু রাগে ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দেন। তাকে শাস্তিস্বরূপ দেশে পাঠানো হয় (‘৩৬ এর লালা অমরনাথ)।

 

লর্ডসের আগে একটাই প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ডার্বির বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে মনোবল হীন ভারত হেরে গেলো। ১১০/৮ থেকে মঙ্গিয়া(অপরাজিত ৭৪) ও আঙ্কোলা(৩৫ বলে ৪৫) দলকে ১৬৮ অবধি টানে। তারপর শেষ উইকেটে মঙ্গিয়া ও রাজু (৬৬ বলে ৩১) ৬১ যোগ করে। ফলে ভারত ২২৯ তোলে। ম্যালকম (৪-৬০) ও হ্যারিস (৩-৬৭) ভারতকে দাঁড়াতে দেয়নি । ডার্বি দলের অস্ট্রেলিয় ক্যাপ্টেন ডিন জোন্স ৯৩ করেন ফ্রিঙ্কেন ৭০। কুম্বলে ১১১ রানে ৪ উইকেট নেয়।জবাবে ভারত ১৯২ রানে শেষ। ম্যালকম(৪/৫০) আবার বিধ্বংসী। সৌরভ গাঙ্গুলী শুধু ৯ টি ৪ এর সাহায্যে ৯২ বলে ৬৪ করেন।

 

অবশেষে এলো সেই দিন। ২০ জুন, ১৯৯৬ । ভারত তথা তৎকালীন বিশ্বের একাদশ তম বাঙালী ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে অভিষেক হলো সৌরভ গাঙ্গুলীর। তাও আবার লর্ডসে। সাথে রাহুল দ্রাবিড়।

 

২০ জুন ডিকি বার্ড শেষ বার আম্পায়ার হলেন টেস্টে। টসে জিতে ভারত বোলিং নিলো এবং প্রথম ওভারেই ০/১। আথারটন আউট। স্টুয়ার্ট আর হুসেন ৬৮ রান যোগ করে। স্টুয়ার্ট ২০ করে আউট। দুটোই শ্রীনাথ। এরপর ৯৮ রানের মাথায় ঘটল সেই ঘটনা। নাসের হুসেন সৌরভ গাঙ্গুলীর বলে রাঠোরের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট ৩৬ করে (ছয় বছর পর, এই লর্ডসে, এই হুসেনের নাকের ডগা থেকে ন্যাটওয়েস্ট কাপ তুলছিলেন সৌরভ, সেই লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে….)। প্রথম টেস্ট উইকেট। খানিক বাদেই দ্বিতীয়। হিক মারতে গিয়ে প্রসাদের হাতে আউট, ১০২/৪। তারপরে প্রসাদ বোল্ড করলো ইরানিকে(১০৭/৫)। যদিও থর্প আর রাসেল দিনের শেষে দলকে ২৩৮/৫ এ আটকালো।

 

২১ জুন, দ্বিতীয় দিন।

প্রথম দিন ১০৭/৫ থেকে থর্প আর রাসেল ২৩৮/৫ ,অবধি নিয়ে গিয়েছিল। আজ শুরুতেই থর্প (৮৯) করে শ্রীনাথের বলে আউট হলো। ইংল্যান্ডের রান ২৪৩/৬ ।

নামলো লুইস। ১৯৯২/৯৩ সালে টেল-এন্ডার হয়ে নেমে ভারত কে খুব ভুগিয়ে ছিল। এবারও ৩১ করে রাসেলের সঙ্গে দলকে ৩২৬ অবধি টানলো। তারপর প্রসাদের বলে আউট হলো। এরপর বাকি তিন উইকেটই প্রসাদই নেয়। ৩৪৪ রানেই শেষ ইংল্যান্ড দল। রাসেল ১২৪ করে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হলো। প্রসাদ ৫/৭৬,শ্রীনাথ ৩/৭৬, সৌরভ গাঙ্গুলী ২/৪৯।

 

জবাবে ২৫ রানের মাথায় রাঠোর (১৫) গেলো। গোটা সফর জুড়ে রাঠোর এটাই করেছিল। টুর ম্যাচে সফল, আন্তৰ্জাতিক খেলায় ব্যর্থ।

 

সারা দুনিয়ার বাঙালিরা দেখলো খেলতে নামছেন সৌরভ গাঙ্গুলী, একাদশ বাঙালী টেস্ট ক্রিকেটার, যাকে সফরে ঠিক মতো সুযোগ দেওয়া হয়নি, দিলেও ৬-৭ এ নামিয়েছে।

খানিক পরেই মঙ্গিয়া (২৪) আউট। ভারত ৫৯/২। দিনের বাকি সময় শচীন ও সৌরভ অবিচ্ছিন। দিনের শেষে ভারত ৮৩/২। সৌরভ অপরাজিত ২৬ ও শচীন অপরাজিত ১৬।

 

২২শে জুন, তৃতীয় দিন।

গতকালের দুই উইকেটে ৮৩ রান থেকে ভারত আবার ব্যাটিং শুরু করে। শচীন এবং সৌরভের খেলতে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। সৌরভ গাঙ্গুলী ধৈর্য ধরে বাজে বলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে বল পেলেই তিনি স্কোয়্যার কাট, স্কোয়্যার ড্রাইভ বা কভার ড্রাইভের মাধ্যমে সেগুলিকে মাঠের বাইরে পাঠাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় দলের রান যখন ১২৩, সেইসময় সেট হয়ে যাওয়া শচীন তেন্ডুলকার লুইসের বলে বোল্ড হয়ে যান। ৮১ মিনিটে ৫৯ বল খেলে ৫টি চারের সাহায্যে ৩১ রান করেন। ব্যাট করতে নামলেন মহম্মদ আজহারউদ্দীন। আর তারপরেই মার্টিনের একটি অফস্টাম্পের বাইরের বল স্কোয়্যার কাট করে মাঠের বাইরে পাঠালেন সৌরভ গাঙ্গুলী। তাঁর হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ হল। ২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ব্যাট করে ১০৭ বলে ৭টি চারের সাহায্যে তিনি হাফসেঞ্চুরিতে পৌঁছন। অধিনায়ক আজহার তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন। রবি শাস্ত্রী শটটিকে ‘শট অফ দ্য মর্নিং’ বলে ঘোষণা করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই লাঞ্চ হয়।

 

লাঞ্চের কিছু পরেই অ্যালান মুলালির বলে রাসেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন আজহার মাত্র ১৬ রান করে। এরপরে ব্যাট করতে নামলেন অজয় জাদেজা। এদিকে সৌরভ অফস্টাম্পের বাইরে বল পেলেই পেটাচ্ছেন। অ্যালান মুলালির একটি বল সৌরভের কাঁধে লেগে স্লিপে ক্যাচ যায় এবং বিশাল অ্যাপিল ওঠে। কিন্তু আম্পায়ার হ্যারল্ড বার্ড তাতে কোনো আগ্রহ দেখাননি। চা-বিরতির মিনিট কুড়ি আগে জাদেজা রনি ইরানির বলে বোল্ড হয়ে যান দেড়ঘণ্টা ব্যাট করে ১০ রান করে। ভারত ২০২-৫। এবার নামলেন রাহুল দ্রাবিড়।

 

১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে সার্ক ক্রিকেট, ইংল্যান্ড এ-র ভারত সফরে দ্রাবিড় ভালো ব্যাট করেছিলেন। এরপরে সফররত নিউজিল্যান্ডের দলের বিরুদ্ধে বোর্ড সভাপতি দলের হয়ে সেঞ্চুরিও করেন। কিন্তু ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সুযোগ আসেনি। বিশ্বকাপের পরেই কয়েকটি টুর্নামেন্টে গোটা চারেক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি এবং চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। ইংল্যান্ড সফরে দলে এসেছিলেন বিকল্প উইকেটকিপার হিসেবে। প্রথম টেস্টে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে একটি ক্যাচ লোফেন এবং দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেয়ে যান।  সৌরভ এবং দ্রাবিড় যখন ব্যাট করছিলেন, তখন কেউ ভাবতে পারেনি এঁরা দু’জনে মিলে ভারতকে টেস্ট ক্রিকেটে ১৯,০০০ রান এবং ৫২টি সেঞ্চুরি উপহার দেবেন।

 

 

ডমিনিক কর্কের অফস্টাম্পের বাইরের একটি বলকে দর্শনীয় কভার ড্রাইভের মাধ্যমে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলী পৌঁছে গেলেন ৯৭ থেকে ১০১ রানে। ৩৬৯ মিনিটে ২১৭টি বল খেলে ১৭টি চারের সাহায্যে তিনি দ্বিতীয় বাঙালি। যিনি টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন। লর্ডসে তিনি তৃতীয় ক্রিকেটার যিনি অভিষেকে সেঞ্চুরি করেন। ভারতের হয়ে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা তিনি ছিলেন দশম ব্যাটসম্যান। এর বেশ খানিকক্ষণ পরে অ্যালান মুলালির একটি নিখুঁত ইয়র্কার সৌরভ গাঙ্গুলীকে পরিষ্কার বোল্ড করে দেয়। ৭ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে ৩০১ বল খেলে ২০টি চারের সাহায্যে তিনি ১৩১ করে যখন আউট হলেন, তখন দলের রান ২৯৬। অজস্র করতালির মধ্যে তাঁর প্রস্থান ঘটলো, এলেন অনিল কুম্বলে।

ওদিকে সাবলীলভাবে খেলে চলেছেন রাহুল দ্রাবিড়। তিনিও দেখতে দেখতে হাফসেঞ্চুরি করলেন তাঁর অভিষেক টেস্টে এবং দিনের শেষে ভারতের রান দাঁড়ালো ৬ উইকেটে ৩২৪। দ্রাবিড় ৫৬ এবং কুম্বলে ৬ রানে ব্যাট করছেন।

 

২৩জুন, চতুর্থ দিন।

দ্রাবিড় আর কুম্বলে ব্যাট করছিলেন। যথেষ্ট আস্থার সাথেই ব্যাট করছিলেন দ্রাবিড়। গতকালই হাফ সেঞ্চুরি করেন। এরই মধ্যে কুম্বলে ৮০ বলে ১৪ করে এল বি ডব্লু হলেন মার্টিনের বলে, ১১৪ মিনিট ব্যাটিং করে। দল তখন ৩৫১। নামলেন আরেক কর্ণাটকী ব্যাটসম্যান জাভাগল শ্রীনাথ। একটু পরেই লাঞ্চ হলো।

 

লাঞ্চের পরে দ্রাবিড় সাবলীল ভাবে খেললেও একটু সমস্যা হচ্ছিল। শ্রীনাথ অবশ্য ৩৮৮ রানের মাথায় মুলালির বলে বোল্ড হলেন ৬২ মিনিটে ৪৭ বল খেলে ১৯ করে। নামলেন মামব্রে।

 

এরপর আরো ৩১ রান যোগ হলো, ভারত ৪০০ টপকে গেছে, দ্রাবিড় ৯৫, সবাই যখন আর একটি অভিষেকেই শতরান ভাবছে, তখন লুইসের একটি বল সামান্য সুইং করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাটের ওপরের অংশের প্রান্তে লেগে রাসেলের হাতে চলে গেলে ৬ ঘন্টা ধরে ২৬৭ বলে করা ৯৫ রানের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য দ্রাবিড় ইনিংসে মাত্র ৬টি চার মারেন। ভারত তখন ৪১৯।

এর কিছু বাদে ৪২৯ রানের মাথায় প্রসাদ আউট হলে ভারতের ইনিংস শেষ হয়। মামব্রে ১৫ করে অপরাজিত (৪২ বলে, ৭৩ মিনিটে)।

লুইস ৩টে, মুলালি ৩টে ও কর্ক ২টো উইকেট পায়। ইংল্যান্ডের বোলিং ভালো হয়নি একেবারেই।

 

৮৫ রানে পিছিয়ে থেকে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস আরও রক্ষণাত্মকভাবে শুরু হয় টি এর আগে। টি এর প্রায় আধঘন্টা পরে আথারটন ১৭ করে কুম্বলের বলে বোল্ড হয়। দলের রান তখন ৪৯। নামলেন হুসেন।

প্রায় দিনের খেলা শেষ হওয়ার মুখে ৬০ রানের জুটি ভাঙলো শ্রীনাথের বলে , দ্রাবিড়ের হাতে ক্যাচ দিলেন হুসেন (২৮)। ৯৫ মিনিট ব্যাটিং করেছেন তিনি। তখন ১০৯/২।

বাকি সময়ের জন্য নামলেন পিটার মার্টিন, নাইটওয়াচম্যান । দিনের শেষে ইংল্যান্ডের রান ১১৩/২। স্টুয়ার্ট ৬৫ রানে ব্যাট করছেন, সঙ্গে মার্টিন (১ ব্যাটিং)।

 

২৪শে জুন , পঞ্চম দিন।

শুরুতেই কেঁপে গেল ব্রিটিশ শিবির। স্টুয়ার্ট (৬৬) করে বোল্ড হলেন ১০ মিনিটের ভেতর শ্রীনাথের বলে। ইংল্যান্ড ১১৪/৩। নামলেন থর্প। মার্টিনের সাথে একঘন্টা কাটানোর পর কুম্বলে তাঁকে ফেরালেন (২১), ইংল্যান্ডের রান ১৫৪/৪। হিক নামলেন। আধঘন্টার মধ্যে প্রসাদ তাকে তুলে নিলেন (৬)। ১৬৭/৫ হয়ে গেল। এরপরেই টেস্টে ৮ গড় রেখে কেরিয়ার শেষ করা পিটার মার্টিন দুঘন্টা ব্যাট করে ২৩ করে প্রাসাদের বলেই আউট হলেন। ইংল্যান্ডের রান ১৬৮/৬। রনি ইরানি আর রাসেল লাঞ্চ অবধি টানলেন।

 

 

লাঞ্চের পর ইরানি আর রাসেল ম্যাচ বাঁচিয়ে দিল। দুজনে মিলে পঞ্চাশ রান ও তুললো না। আউটও হলো না। টি এর পরে গিয়ে ইরানী দুঘন্টা ব্যাট করে ৪১ করে আউট হলো (২২৮/৭)। নামলেন লুইস। তাঁকে নিয়ে আরো একঘন্টা কাটিয়ে রাসেল তিন ঘন্টা ব্যাট করে করলেন ৩৮। সৌরভ গাঙ্গুলীর বলে আজহারের হাতে যখন ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন তখন ইংল্যান্ডের রান দাঁড়ালো ২৭৪/৮। কর্ক নামলেন আর গেলেন (২৭৫/৯)। এর খানিক বাদে দুই অধিনায়ক সম্মতি দিলেন ড্র এর। তখন ইংল্যান্ডের রান ২৭৮/৯, ১২১ ওভারে, ৮ ঘন্টা ২৮ মিনিটে। লুইস ৬১ বলে ২৬ অপরাজিত। কুম্বলে ৩টি, শ্রীনাথ ও প্রসাদ ২টি করে, মামব্রে ও সৌরভ গাঙ্গুলী ১টি করে উইকেট পান।

ম্যাচ ড্র হয়ে সিরিজে ১-০ য় এগিয়ে থাকলেও ভারতের কিছু সমস্যা সমাধানের পথ দেখা গেলো। যদিও মামব্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তিনি এর পরে আর টেস্ট খেলেননি।

 

আগামী দিনের অনেক সমীকরণ বদলে দেওয়া এই ম্যাচকে নিয়ে একটু বেশীই লিখলাম। পরের টেস্টে সৌরভ ও শচীন দুজনেই শতরান করেন।

 

এদিকে এরপরেই ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে লোম্বার্ড চ্যালেঞ্জ কাপ অনুর্দ্ধ-১৫ হয়  ইংল্যান্ডে। সেই সময় টালমাটাল অবস্থা ভারতীয় ক্রিকেটে। ১৯৯৬ সাল। ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনালে হেরে গেছে। তখন পাকিস্তানকে হারিয়ে লোম্বার্ড চ্যালেঞ্জ কাপ অনুর্দ্ধ-১৫ জেতে ভারত। ওই দলে  সোধী,কাইফ আর রীকি ছিল। সোধী ছিল অধিনায়ক। সে ঐ প্রতিযোগীতায় ২৩৬ রান করে আর ১৬টা উইকেট নেয়।

 

 

এরপরে সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচে শচীনের নেতৃত্বে ভারত সরকারী ভাবে প্রথম খেলা শুরু করে সিংহলিজ স্পোর্টস গ্রাউন্ডে। প্রথম ম্যাচে শচীনের শতরানের পরেও ভারত হারে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জয়সূর্যের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য। দ্বিতীয় ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে সহজেই হারায় ভারত। কুম্বলের চার উইকেট সহ শচীন, সৌরভ, আজহার, কাম্বলি, জাদেজা সকলেই রান পান। তৃতীয় খেলায় সৌরভ গাঙ্গুলী ৭ নম্বরে নেমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হাফ সেঞ্চুরী করেন, অনেক ওভার বাকি থাকলেও ভারত লড়াই করে হেরে যায়।

 

এরপরে প্রথম সাহারা কাপ হয় টরেন্টোয়। ভারত ২-৩ এ পাকিস্তানের কাছে হারলেও একটি ম্যাচে দারুন লড়াই করে ২ উইকেটে হারে। অধিনায়ক হওয়ার পরে প্রথম ৮ ম্যাচে ৫ টাই হারলেও প্রায় নতুন দল নিয়ে দুটো ম্যাচ ভারত খুব লড়াই করে।

 

এরপরে দেশে ফিরেই ভারত অক্টোবর মাসের দশ তারিখে একমাত্র টেস্টে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে। নয়ন মোঙ্গিয়ার অপরাজিত ১৫২ ছাড়া বলবার মতো রান করেন সৌরভ গাঙ্গুলী (৬৬) আর বল করেন কুম্বলে (৯/১৩০- ম্যাচে)।

 

এই খেলা শেষ হওয়ার মাত্র চারদিনের মাথায় শুরু হয় টাইটান কাপ। ভারত চ্যাম্পিয়ন হলেও টুর্নামেন্টের ফাইনাল সহ ছয়টি ম্যাচের (১টি পরিত্যক্ত) তিনটি জেতে। তারপরেই ২০ নভেম্বর থেকে ভারত তিনটি টেস্ট খেলে ১৩ই ডিসেম্বরের মধ্যে, জয়ী হয় দুটোয়। অবশেষে ১৬ই নভেম্বর মোহিন্দর অমরনাথ বেনিফিট ম্যাচ জিতে ভারত রওনা দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে সফরে।

 

সেখানে তিনটিটি প্রথম শ্রেণির ট্যুর ম্যাচ, একটা লিস্ট এ ট্যুর ম্যাচ, একটি মিসলেনিয়াস, তিনটি টেস্ট ও ৯টি ওডিআই (ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতা সহ) খেলে ভারত। শেষ ওডিআই বাতিল করে ব্যাপক ধকল সামলানো ভারতীয় দল দেশে ফেরে দুমাসের বিশ্রামে।

 

হিসেব করলে দেখা যাবে বিশ্বকাপ ১৯৯৬ থেকে তিনটি মহাদেশ জুড়ে ভারত ১০টি টেস্ট, ৪২টি ওডিআই, ১১টি অন্য প্রথম শ্রেণির, তিনটি অন্য লিস্ট এ, চারটি মিসলেনিয়স ম্যাচ খেলে। এক বছরের মধ্যে প্রায় ৩৫% দিন ভারত কে মাঠে নামতে হয়। এই খেলা গুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক খেলায় ভারত ১৪টি ওডিআই ও ৩টি টেস্ট জেতে।

 

একবার মনে রাখা উচিৎ, এই বিপুল সংখ্যক আন্তর্জাতিক ম্যাচ বেসরকারী চ্যানেলে সরাসরি প্রচার হওয়ার ফলে দূরদর্শনের চাহিদা কমে বেসরকারী চ্যানেলের গ্রাহক বাড়ে। এই সেই সময় যখন সরকারী বেসরকারী দপ্তর থেকে পাড়ার ক্লাবঘর উপচে পড়তো খেলা দেখার জন্য। যদিও ২৭টি ওডিআই (প্রায় ৭০%) ও চারটি টেস্ট (৪০%) ম্যাচ ভারত হেরে যায় কিন্তু একটি ত্রিদেশীয় কাপ জয়, দুটিতে রানার্স, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যাওয়ার কারণে দর্শকদের উৎসাহ মোটেই কমেনি।

 

তাছাড়া এই সময়ে শচীন ৮৪৫ রান (গড় ৪৫, শতরান- ৩) করেন টেস্টে ও ১৮৬৭ রান ( গড় ৪৬.৬৭, শতরান-৭) করেন ওডিআই খেলায়। সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে আজহারউদ্দিনের কথা। তিনি টেস্টে ৬২৮ রান (গড় ৩৬.৮২, শতরান-৩) ও ওডিআই খেলায় ১২৭৯ রান (গড় ৩৯.৯৯, শতরান -০, অর্ধ – শতরান ৯) করেন। এছাড়া সৌরভ গাঙ্গুলী টেস্টে ৬৯০ রান (গড় ৪৯.২৬, শতরান – ২) ও ওডিআই খেলায় ৫৯৮ রান (গড় ৩৫.১৮, শতরান -০, অর্ধ শতরান – ৩), রাহুল দ্রাবিড় টেস্টে ৪৭৯ (গড় – ২৯.৯৩, শতরান – ১) ও ওডিআই খেলায় ৮৭৬ (গড় ৩০.০৯, অর্ধ-শতরান ৭), জাদেজা ওডিআই খেলায় ৯৭৬ রান (গড় ৩২.৫৩, অর্ধ-শতরান ৫), সিধু ওডিআই খেলায় ৪৮২ (গড় ৩০.১২, শতরান ১) ভালো ব্যাট করেন। কুম্বলে এই সময়ে টেস্টে ৩৬ টি ও ওডিআই খেলায় ৭৫ টি উইকেট পান। শ্রীনাথ  টেস্টে ৪৬ ও ওডিআই খেলায় ৪০টি, প্রসাদ টেস্টে ৪৫ ও ওডিআই খেলায় ৫৫ উইকেট পান।

 

ফলত: বেসরকারী চ্যানেল, সীমিত দলীয় সাফল্য ও বিপুল ব্যক্তিগত সাফল্য ভারতে ক্রিকেটের চূড়ান্ত বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করে।  প্রতিযোগিতা গুলির নাম দেখলেই বিষয়টি আন্দাজ করা যাবে। সিঙ্গার, উইলস, সাহারা, টেক্সাকো, টাইটান, পেপসি প্রভৃতি কোম্পানি গুলো ছিল মূল স্পন্সর।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *