অক্সিজেন। পর্ব ৩৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

দুর্যোগের রাত

রেজাল্ট বেরোনোর পর শহরতলির সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার একটা রেওয়াজ বহুবছর ধরেই ওদের বন্ধুদের মধ্যে চালু আছে। এবার একটু দেরিই হয়ে গেল।বিএ পাস করার পর এই প্রথম দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে ওরা। টিকিট কেটে রেখেছিল পাপু। রবিবার বলে বাচ্চুকে আর ছুটি ম্যানেজ করতে হয়নি।অনুর সেই ঝুঁটি বাঁধা প্রেমিকের সঙ্গে বেশ কিছুদিন হল ছাড়াছাড়ি হওয়ায়,  কোন আপত্তি না করেই এসেছে।সবাই পৌঁছে গিয়েছে, কুহু এখনও পথে ।ওদের ঘনঘন আসা  ফোনও ধরছে না ও।

জুহুকে বলছিল ও, “এসব সময়ে দিদির কথাই মনে হয় খুব বেশি করে।ওর সমস্যা এখনও মেটেনি, কোনদিন মিটবে কিনা জানা নেই। তাই মাথায় সবসময় দিদির কথাই ঘোরে। একা একা স্বার্থপরের মত সিনেমা দেখতে চাইনি। ওদের চাপে রাজি হলাম।”

জুহু বলল “ভাল করেছ। মাঝেসাঝে একটু আনন্দ করা ভাল।”

সাইকেলে যেতে যেতে দিদির কথাই ভাবছিল ও।দিদি একেবারে  জড়ভরত হয়ে গিয়েছে।সেই সুইসাইড এ্যাটেম্পট্‌ নেবার পর থেকেই শরীরের জোর, মনের জোর সব হারিয়ে এখন যেন বোবা পুতুল। হাসেনা, কাঁদেনা, অনেকসময় বাথরুমে ঢুকে চান না করে বেরিয়ে আসে। একটা কাজ অবশ্য খুব ভালভাবেই করে। সেটা হল বাবার কাছে চুপচাপ বসে বাবার মাথায় হাত বোলানো। কুহুর মাঝেমাঝে মনে হয় দিদি কী অবচেতনে বাবার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে? নাহলে বাবার ঘরে ওভাবে দিনের পর দিন বসে থাকে কেন?বাবার মাথায় নিরলস ভাবে ওর হাত বোলানোটাও ভারী অদ্ভুত লাগে ওর। বাবাও বারণ করেনা ।চুপচাপ শুয়ে থাকে।

কুহু সব কথাই  বলেছে বন্ধুদের। বলেছে, “পাহাড়ে ওঠার পর ফিরে এসে দিদিকে যেভাবে আবিষ্কার করি,সেটা আমার কাছে বড় একটা ধাক্কা। আজও সেখানেই থেমে আছে ও।ডাক্তার বলেছে ডিপ্রেসানের এটা একটা স্টেজ। কাটতেও পারে, নাও কাটতে পারে।দিদিকে বড় কোনও জায়গায় দেখানোর কথা সবসময়েই ভাবি। তবে এখনও অবধি সুবিধে করতেপারলাম না।বাড়িতে বাবা অসুস্থ।মায়ের ওই চাকরি আর বাবার পেনসানই ভরসা।তাই হয়ে উঠছে না কিছুই। কিন্তু দিদির জন্য কোনও আনন্দেই আর যোগ দিতে ইচ্ছে করেনা আমার। তোরা এটা একটু বোঝ।”

তবে আজ যাবে বলেই ভেবেছে ও ।কয়েকদিনের মধ্যেই পিজিপিটির ক্লাস শুরু হবে। এ্যাডমিশানের জন্য এ্যাপ্লাই করেছিল ও। নানারকম পরীক্ষা দিতে হল।সবটাই খেলাধূলা সংক্রান্ত।ইন্টারভিউ দিয়ে তারপর নাম উঠেছে। পরে এরকম ফাঁকা সময় আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তাই শেষ অবধি  বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে রাজি হয়েছে কুহু ।

এই দেড়বছরে অনেক কিছুই পালটে গিয়েছে। পিন্টুর এখন ক্লাস টেন হবে। ওর এখন বাংলা, ভূগোল আর ইতিহাসে বেশ আগ্রহ হয়েছে। ক্লাসেও প্রথম দু’একজনের মধ্যে থাকে। কিন্তু কুহুকে এখনও ওকে পড়াতে হয়। পিন্টু বা ওর মার কুহু না পড়ালে চলবে না। মাইনে ডবল করতে চেয়েছিলেন ও আপত্তি করেছিল।উনি পুরোটা শোনেন নি। এখন ওকে  দেড়হাজার টাকা দেন।একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে ।এ্যাডভান্স ট্রেনিং করার সময় ওই টাকাটা কাজে লেগেছিল। ট্রেনিংটা সরকার স্পন্সর করলেও হাতে সবসময়েই কিছু টাকা রাখতে হয় তো।

কুহুকে ভাস্বতী সেন বলেছিলেন “পাহাড়ে উঠতে গেলে অনেক টাকা লাগে। লোন করতে হয়।স্থায়ী চাকরি না থাকলে ব্যাঙ্ক তোমাকে লোন দেবে কেন?বাড়ি বাঁধা দিয়ে নিশ্চয়ই পাহাড়ে উঠবে না।আমার মত স্কুলে কাজ করতে হলে বিএ পাশ করার পর পিজিপিটি ট্রেনিংএ ভর্তি হয়ে যাও।চাকরি পেতে তেমন সমস্যা হবেনা।

কথাগুলো ওর মনে ধরেছিল।তাই বিএ পাসের পর পিজিপিটি পড়বে স্থির করে। এখন সব জায়গাতেই কম্পিটিশান।তবু ও ওখানে ভর্তি হতে পেরেছে।

দিদির ঘটনাটা মাকে নাড়া দিয়েছে খুব।একদিন বলছিল, “ভগবান আমাকে জোর শিক্ষা দিয়েছে। সেদিন যদি কেকা সুইসাইড করে ফেলত,আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। ওর ফিরে আসার দিনটা মনে পড়লেই শিউরে উঠি।”

শেষপর্যন্ত সিনেমা হলে পৌঁছে গেল ও।সিনেমার নাম ‘অরুণবাবুর বন্ধু।’ বেশ লাগল দেখতে।পাশের রেস্ট্যুরেন্টে ঢুকে চিকেন রোল খেল ওরা। এসব সময়ে জুহু খুব বিরক্ত হয়। সাইকেল স্ট্যান্ডে যত অচেনা সাইকেলের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে হয় ওকে।

ফেরার পথে সেই কথাই হচ্ছিল।জুহু আস্তে আস্তে ওকে বলল,“ভাল লাগেনা।আমায় এসব জায়গায় এনোনা বাপু।তুমি দরকার হলে টোটোতে আসবে। অচেনা দলের মধ্যিখানে আমি একা ।তারপর এ ধাক্কাচ্ছে,ও ধাক্কাচ্ছে। আমার গায়ে অনেক ঘসা দাগ হয়ে গিয়েছে। দেখে নিও।”

বেচারা জুহুকে ও কিকরে বোঝাবে যেখানে সাইকেলে যাওয়া যায় সেখানে টোটো চাপার বিলাসিতা ও করেনা। এখন টাকাপয়সা বুঝে বুঝে খরচ করাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে ওর।

বড় রাস্তায় পড়ে সাইকেলের স্পীডটা একটু কমিয়ে দিল কুহু। বৃষ্টি পড়ছে।একটু আলোআঁধারি হয়ে আছে চারপাশ। বিশাল বিশাল লরি যাচ্ছে। জুহু একটা কী বলল ফিস্‌ফিস্‌ করে। শোনার আগেই হঠাৎ রাস্তার ওপাশে পড়ে থাকা মটোরবাইকটা চোখে পড়ল ওর। খানিকটা আতঙ্কিত হয়েই রাস্তা টপকে ওদিকে গিয়ে গাড়িটার পাশে দাঁড়াল ও।কিছু একটা হয়েছে এখানে। গাড়িটা কেমন ছেতরে একপাশে পড়ে আছে । তখনই নজরে এলো একটা হেলমেট পরা মাথা, সাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা শরীর । বড্ড চেনা। এত চেনা লাগছে কেন? বুকটা ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করছিল ওর।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৩৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. এই পর্বটির জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। কেকাকে নিয়ে টেনসন ছিল। লেখার এমন মুন্সিয়ানা খানিকটা বলা হলেও টেনসন রইল, সুতরাং পরের পর্বগুলোর জন্য একই রকম প্রতীক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *