অক্সিজেন। পর্ব ৩৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

2

গত পর্বের পর

“ভালবেসে সখী…”

শিপ্রা চুপ করে বসেছিল গানের ঘরের চৌকিতে।সামনে হারমোনিয়াম।খাতাটা খোলা।একটু আগেই এখানে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।একজন পঞ্চাশোর্দ্ধ যুবক একটি পঞ্চাশোর্দ্ধ তরুনীকে প্রেম নিবেদন করেছে। ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর এখনও না কাটায় তরুনীটি নিজের গান শেখানোর জায়গা থেকে নড়তে পারছে না।

আজ সকাল শুরু হয়েছিল বেশ ভালভাবেই। তবে টুকটাক ঝামেলা চলছে কদিন ধরেই।শীলা মেয়েকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসার পর থেকেই গোলমালের ধাক্কা বেড়েছে। টুপু বাইরে চলে যাওয়ার পর থেকেই বৌদির মেজাজ টঙে। শীলা যে ওর মেয়েকে নিয়ে এবাড়িতেই থাকবে, কথাটা  যে জানেনা তা নয়। কিন্তু একটা গোলমাল অশান্তি না করে ভালভাবে কাজটা কিছুতেই হতে দেবেনা।

বউদি ঘুমচোখে নেমে দরজা খোলে প্রতিদিন। সেদিনও তাই করতে গিয়েই ঠোক্কর খায়। দেখে দুটো ব্যাগে বিস্তর মালপত্র নিয়ে শীলার হাতধরে ওর মেয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

বৌদি তখনই ছুটে আসে ওর কাছে। “দেখো কে এসেছে? শীলার মেয়ে। শীলাকে তুমি বলেছিলে এমাসেই মেয়েকে এবাড়িতে ঢোকাতে?”

ও তখন কোন উত্তর দেয়নি। গরম জলে লেবু মিশিয়ে খাচ্ছিল। ধীরে সুস্থে গ্লাস নামিয়ে রেখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল শীলার সামনে। ওর মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হয়েছিল শিপ্রার।বছর দশেক বয়স হবে। মুখটা মিষ্টি,গায়ের রঙ ফরসা না হলেও উজ্জ্বল।চুলে বেড়াবিনুনীর মত করে মাথায় তুলে লাল ফুল বাঁধা হয়েছে। একটা গোলাপী ঝকমকে ফ্রক আর রবারের রঙিন চটি পরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা ঠিক দরজার মুখেই। যেন শিপ্রা বাড়িতে ঢুকতে বারণ করলে বেরিয়ে যাবে।

ও কাছে গিয়ে বলে, “যাও মায়ের সঙ্গে মায়ের ঘরে যাও। উঠোনের কলতলায় পা ধুয়ে নিও।”ওর পাশেই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল শীলা। বৌদির ব্যবহারে ও যে ক্ষুব্ধ সেটা ওর মুখেচোখে ফুটে উঠেছে। ছেলেমেয়ের ব্যাপারে সব মা  খুব স্পর্শকাতর  হয়। বৌদি একেবারেই বোঝে না, আজ ওকে ছাড়িয়ে দিলে কাল ও কাজ পেয়ে যাবে। মাঝখান থেকে ওদের অবস্থা খারাপ হবে। যতীনকে পুরোটাই ও দেখাশুনা করে। ওর অবর্তমানে সেটা শিপ্রাকেই করতে হয়। অথচ বৌ্দিকে কিছু বললে বৌ্দি না বুঝে এমন চেঁচাবে, সব গুবলেট হয়ে যাবে।

ব্যাপারটা বেশি পাত্তা দিলে চলবে না। ও বলে, “যাও মেয়েকে জামা কাপড় ছাড়িয়ে কিছু খেতে দাও। নিজে খাও। সেই কোন সকালে বেরিয়েছ।”

বৌ্দি একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। শিপ্রা গম্ভীরভাবে নোটিস জারি করার ভঙ্গিতে বলেছিল , “তোমাকে বলেছি আগেই শীলা মেয়েসমেত এবাড়িতে থাকবে। তোমার যদি আপত্তি থাকে বলো।তাহলে কিন্তু যতীনের যাবতীয় দেখাশোনা তোমাকেই করতে হবে । আমি শীলাকে একেবারেই চলে যেতে বলব।”

এসব ঘটনা কদিন আগের। তারপর থেকে বৌ্দির গলার আওয়াজ তেমন পাওয়া যায়নি। চুপচাপ আছে । রান্নাঘরে ঢুকল শিপ্রা। খানিকটা ময়দা মেখে বৌ্দি চলে গিয়েছে। এটাই অভ্যেস।কিছুটা করে, কিছুটা ছেড়ে দেয়।কয়েকটা পরোটা বেলল ও। শীলা কাপড় কাচছে।আপাততঃ জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। পরোটা ভাজতে ভাজতেই ও টের পেল শীলা এসে দাঁড়াল পেছনে।

“তুমি সরো । আমি করে নিচ্ছি।”

শীলা শুরু করায় নিজের ঘরে চলে এসেছে ও। শীলাকে বলে এসেছে ফ্রিজ থেকে দুটো পান্তুয়া বার করে মা মেয়ে যেন নিয়ে নেয়। সকালে ও নিজে একবাটি স্যুপ ছাড়া আর কিছু খায় না। হারমোনিয়াম সাজিয়ে বসতে বসতে সাড়ে নয় বাজল। এক এক করে এবার ছাত্র ছাত্রীরা ঢুকবে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এসব এক ধরনের বন্ধন। নিজে পছন্দ করে দাঁড়িয়ে থেকে বাবা বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শিপ্রা রাজি হয়নি শুধুমাত্র ওই বন্ধনের জন্য। ও গান নিয়ে একটা স্বাধীন পৃথিবী তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন বাড়ির সব দেকভাল করা ছাড়াও সবকটি সদস্যের মান অভিমান, ইচ্ছে অনিচ্ছের জের মেটাতে হচ্ছে তাকে। তারই মধ্যে গানের ট্যুশানির ক্লাস নিয়মকরে ঘড়ি ধরে সামলাতে হচ্ছে।তার নিজের বন্ধনমুক্তি হল কই?

অডিশান দিয়ে আকাশবানীতে পাস করেছিল। মাঝেমাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম পায় । সেভাবে নিজের জন্য রেওয়াজ করার সময় পায় না। নতুন করে আর কোথাও গান শিখতে যাওয়া হল না। এই একান্ন বছর বয়সেই দায় দায়িত্বের বোঝা নিয়ে একটার পর একটা দিন কাটছে।। শরীরে যাই থাক মনের দিক  থেকে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ।

নিজের কথা ভাবতে ভাবতে একটু আচ্ছন্ন হয়েছিল। সজল বাবুর ক্লাসে ঢোকাটা টের পায়নি। ভদ্রলোক নিঃশব্দে এসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাখা সতরঞ্চীতে বসেছিলেন। একটু পরে দুবার গলা ঝাড়তেই শিপ্রা ধড়মড়িয়ে  সোজা হল।

“আপনি কতক্ষণ?” বিরক্তি নিয়েই বলে ও।

“এই একটু আগে। ক্লাস হবে তো? মেয়ের পরীক্ষা তাই এলোনা। আপনার কি শরীর খারাপ?”

অনেকদিনের চেপে রাখা বিরক্তি ছড়িয়ে শিপ্রা বলে, “সেটা আপনি জেনে কী করবেন?”

আশ্চর্য্য! এতবড় কথাতেও সজলবাবু এতটুকু ঘাবড়ান না, বরঞ্চ ধীরে সুস্থে মৃদু হাসতে হাসতে বলেন, “না, মানে জানতে পারলে ভাল লাগত।”

শিপ্রা ওই হাসি আর অগ্রাহ্যের ভাব দেখে রেগে যায়। “সজলবাবু আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন। আমি খুব বিরক্ত হচ্ছি। বাড়ির অন্দরেও প্রায়ই ঢুকে যাচ্ছেন, খাবার -দাবার আনছেন, এসবের মানে কী?”

সজলবাবু এবার শান্তভাবে তাকান শিপ্রার চোখের দিকে, তারপর গলাটা খাদে একটু নামিয়ে বলেন, “এতো ভারী সহজ কথা। আমার আপনাকে বড্ড ভালো লেগেছে। মানে আপনাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।”

বলার পরে ‘আজ আসি’ বলে নাটকীয়ভাবে চলে গিয়েছেন সজলবাবু। শিপ্রা ভীষণ হতবম্ব হয়ে যায়।কোন শব্দই উচ্চারণ করতে পারেনি। সেইথেকে একভাবে বসে সজলবাবুর দুঃসাহসের কথা ভাবছে।রবিবার, ছুটির দিন। আজ আরও কেউ কেউ এখনই গান শিখতে আসবে। নিজেকে সামলে নিতে হবে।কিন্তু পারছে না।

শিপ্রা বসে বসে ভাবছে,সজলবাবু বললেন, কথাটা সহজ। কিন্তু সত্যিই কথাটা অতটা সহজ কী?

(ক্রমশ)

Author

2 thoughts on “অক্সিজেন। পর্ব ৩৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. সহজ কথার মতো শক্তিশালী সত্যিই আর কিছু আছে কি!?

  2. দারুণ এগোচ্ছে। একদিকে রোমহষর্ক অন্যদিকে সম্পর্কের টানাপোড়েন, কৌতুহল তৈরি করছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *