অক্সিজেন। পর্ব ৩২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

মেঘ চমকায়

ভাস্বতী সেনের বয়স খুব বেশি না হলেও অন্ততঃ চল্লিশ বছর হবে।একটা মাধ্যমিক স্কুলের টিচার।উত্তরপাড়ায় বাড়ি।ফোনে যোগাযোগ করে গেল ও। শিপ্রাদি পাঠিয়েছে শুনে খুব উৎসাহ নিয়ে কথা বলল। প্রথমেই বলল, “তুমি আমার থেকে বয়সে অনেকটা ছোট।কিন্তু আপনি আজ্ঞে করোনা।তুমি করেই কথা বলো।নাহলে কথা বলা যাবে না।”

মহিলা খুব আন্তরিক।নিজের হাতে বানানো রসবড়া খাওয়ালো।তারপরই বলল শেষ পাহাড়ে গেছি দুহাজার তেরোয়।গ্র্যাজুয়েশানের পর পিজিবিটি ট্রেনিং নিয়ে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টারের চাকরিতে ঢুকি।বরাবর লক্ষ্য ছিল একটার পর একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠব। এইচ এম আই তে একটার পর একটা, তিনবছরে মোট তিনটে ট্রেনিং নিই।ট্রেনিং এর পর প্রথম ‘মুলকিলা টেন’ শৃঙ্গ অভিযানে যাই।মুলকিলা টেনের উচ্চতা ছ’ হাজার পাঁচশো সতেরো মিটার।

কুহুর খুব অবাক লাগছিল।ওর মতই এই মানুষটারও একই নেশা।জীবনের একটাই লক্ষ্য?কথাটা ও বলেই ফেলল।

ভাস্বতীদি একটু তাকিয়ে রইল ওর দিকে।তারপর বলল,“তোমার কী মনে হয় বাঁচা মরা তুচ্ছ করে যে মানুষগুলো পাহাড়ে চাপে,তাদের এই পথচলাটা খুব স্বাভাবিক? ছবি আঁকে, বই লেখে, গান গায়,অভিনয় করে যারা,তারাও কী এভাবেই নেশায় মেতে ছোটেনা?

সিনেমা দেখা, দোকানে পছন্দসই জিনিস কেনা, দলবল মিলে ফূর্তি করা ছেড়ে কেনই বা দিনের পর দিন তারা এসব নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে?কেন এত কষ্ট দেবে নিজেকে?তার পেছনে এই একটাই কারণ, নেশা। নেশা না থাকলে ওই দুর্গম পথ পেরোনোর জন্য জীবন তুচ্ছ করা যায় না।”

কথা বলতে বলতে বেলা বাড়ছিল।বাইরের ঘরে বসেই কথা বলছিল ওরা।অন্ধকার নামছে চারিদিকে। আবার কফি আর বিস্কুট এসেছে ভেতর থেকে।ওর কোন হুঁশ নেই। একভাবে বসে আছে বাইরের ঘরের সোফায়।

ভাস্বতীদির কথায় চমক ভাঙে ওর। “জানো মুলকিলা অভিযানের পর আমি গিয়েছিলাম ‘কামেট’ অভিযানে।ওটার উচ্চতা সাত হাজার সাতশো ছাপান্ন মিটার।তার পরে  গিয়েছিলাম ‘মাউন্ট ভাগীরথী টু’ তে।ওটার ছহাজার পাঁচশো বারো মিটার  উচ্চতা।সারা ভারত থেকে মাত্র দশজন মহিলা পর্বতারোহীকে বেছে নেয় ভারত সরকার।দুজন শেরপা গাইড আর একজন ডাক্তার, মোট তেরো জনের দল।সরকারই অভিযানের ব্যয় বহন করে।যদিও ওই অভিযান সফল হয়নি অনেকটা  গিয়েও ফিরে আসতে হয় আমাদের।”

“কেন কী হয়েছিল?”

“সাংঘাতিক ক্লাউড বাস্ট হয়েছিল।তখন আমরা ওই পাহাড়ে । ছহাজার মিটারের মত উচ্চতায়। অতটা উঠেও অভিযান পরিত্যাগ করতে হয় আমাদের।সেবার বড় ভয়ংকর ব্যাপার হয়েছিল ওখানে।আমরা বেঁচে ফিরব ভাবিনি।”

কুহু খাড়া হয়ে বসে। “ভাস্বতীদি, সেই বিখ্যাত ক্লাউড বাস্টের কথা বলছ?সেই যেটা কেদারে ঘটেছিল?মন্দিরের ক্ষতি হতে হতে বেঁচে যায়?”

“হ্যাঁ আমি তখন আমার দলের সঙ্গে উঠেছি, ছহাজার মিটার উঠেও আমাদের ফিরে আসতে হল।দিনের বেলায়ও ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাত পা নিজেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা,আমরা সারা রাত বসে ক্যাম্প ঝাড়ছি। আবার বরফে ভরে যাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।”

ভাস্বতীদি বলে আর কুহু হাঁ করে শোনে। জান, “সামিটের কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসতে হল। কোন উপায় ছিল না।ওরকম উচ্চতায় চারপাশে মেঘ ডাকছে।থরথর করে পাহাড় কাঁপছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।এমন হাওয়া দিচ্ছে মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে কোথাও ফেলে দেবে।সারারাত না ঘুমিয়ে ক্যাম্প ঝাড়ছি আমরা ।মেঘের গর্জনে পাহাড়ের ধস নামছে।ওই বরফের চাঙড় ভাঙার আওয়াজও কম নয়।একে মেঘের গর্জন তায় বরফ ভাঙার শব্দ।কানে তালা ধরে যাচ্ছে।আমরা সবাই নামতে শুরু করলাম।কোথায় পা রাখছি বুঝতে পারছি না। চার পাঁচদিন ধরেই আমরা নামছি। শেষে আর তাঁবু খুঁজে পাওয়া যায়না। বরফের ঝড়ে ভেঙে পড়েছে।তার ওপর বরফ চাপা পড়ে প্রথমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।বাসনপত্র,স্টোভ কিছু না পেয়ে মাজা ফ্রুটির ছোট ছোট পিচবোর্ডের বাক্সে একটা যে বিউটেন গ্যাস বাঁচানো গেছিল তাতে জল গরম করে খাচ্ছি। চানাচুর বাদাম খাওয়া হচ্ছে। হাঁটলে কোমর অবধি বরফ।অনেকসময় ওপরে বরফের নীচে বড় খোঁদল থাকে।একবার তার মধ্যে ঢুকে গেলে আর ওঠা যায়না।তাই বরফে পা ফেলার সময় স্টিক দিয়ে দেখে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।তারপরেও ভাগ্য খারাপ থাকলে কিছু করার নেই। পাঁচ ছদিন ধরে খাওয়া নেই,ঘুম নেই। সে এক ভয়ংকর অবস্থা!

সেই দুর্দিন আর দুরবস্থার কথা বলে বোঝানো যাবেনা।তাঁবু ভেঙে মাটিতে ঢুকে গিয়েছিল, শাবল গাঁইতি দিয়ে খুঁড়ে তাঁবু বার করা হল । চারপাশের বরফ ছ সাত ফিট উঁচু দেওয়ালের মত ঘিরেছে।চারপাশের বরফ উঁচুতে,আর তাঁবু নীচুতে। তাঁবুর মধ্যে ঠান্ডায় সবাই ঢুকেছে।সেই বারো তেরো জন লোকের গায়ের উত্তাপে বাইরের বরফ গলে তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে আরম্ভ করল।একে ওরকম ঠান্ডা,তার মধ্যে তাঁবুতে বরফ গলা জল।তাঁবুর মধ্যে যেন সমুদ্র।ব্যাগের ওপর বসে আছি সবাই। প্রলয়ের মত পাহাড়ে ওলটপালট হচ্ছে, পাহাড় কাঁপছে। যেন সারা পাহাড়ে ধুন্ধুমার কান্ড হচ্ছে। মনে হচ্ছে পাহাড় ভেঙে আমাদের ঘাড়ে পড়বে। বর্ণনায় ষে অবস্থাটা ঠিক বোঝানো যাবেনা।

পোশাকেও হাওয়ার তোড়ে বরফ ঢুকেছে।হাঁটু অবধি ঢাকা গ্রেটারের ফাঁক দিয়েও  জুতোর মধ্যেও বরফ গলা জল ঢুকেছে। গ্রেটার মানে গামবুটের মত জুতোর ওপরের ঢাকা। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি।খাওয়া ঘুম নেই,ওরকম ঠান্ডা,’হাইপো থারমিয়া’ হয়ে গিয়েছে।মানে বডি টেম্পারেচার নর্মালের নীচে চলে গিয়েছে।হাত পা অসাড়।পায়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট আটকে নিয়ে যাহোক করে বসে আছি আমরা সবাই।বাঁচার আশা একেবারেই ত্যাগ করেছি । ওভাবেই না ঘুমিয়ে বসে থাকা।যাই হোক অনেক কষ্টে গোমুখ পেরিয়ে ভুজবাসায় ঋষিদের আশ্রমে আসা হল।তারপর  আবার গঙ্গোত্রীতে নামতে হবে।

ভুজবাসায় সাধুদের আশ্রম। কোন সাহায্য ওই আশ্রমে আসেনি।তীর্থযাত্রীর দল ভয়ে আতঙ্কে জড়সড় হয়ে আছে।সমস্ত উত্তরাখন্ডেই বিপর্যয়।কিন্তু কেদারের মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে সব মনোযোগ ওদিকেই চলে গিয়েছে।সাহায্যের জন্য সব সৈন্যকে ওখানেই পাঠানো হয়েছে।ভুজবাসা থেকে গঙ্গোত্রী যাবার পথও ভেঙেচুরে একাকার।পুরো পথটাই নদীতে নেমে গিয়েছে। ফোনের টাওয়ার নেই।বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারা যাচ্ছেনা । এবার তীর্থযাত্রীরা ফিরবে কিকরে?ওরা ভয় পেয়ে আমাদের হাতে পায়ে ধরছে।যাতে আমরা ওদের ফিরিয়ে নিয়ে যাই।রীতিমত কান্নাকাটি করছে।”

শুনতে শুনতে কুহুর আতঙ্ক হয়। কিন্তু ভাস্বতীদিকে কোন প্রশ্ন করেনা ও।ভাস্বতীদি নিজের মনে বলতে থাকে।

“শেষে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে আমরা নামতে থাকলাম।একশো জনের মত মানুষ,তার মধ্যে মহিলা, পুরুষ ,বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু সব আছে।বাচ্চাদের কোলে করে,বড়দের হাত ধরে ধসের জায়গা আমরা পার করাচ্ছি।আমাদের কাছে যেসব দড়ি ,যন্ত্রপাতি ছিল, সেসবও আমরা কাজে লাগাচ্ছি। এই ভাবে অনেক কষ্টে গঙ্গোত্রী আসা হল।গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশী বাসে যেতে হয়।সেই বাসরাস্তাও ধসে নদীতে চলে গিয়েছে।দেড়শো দুশো কিলোমিটার এর মত রাস্তা। কোন উপায় নেই। সেই রাস্তা তিনদিন ধরে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন কিলোমিটার করে হেঁটে পেরোন হচ্ছে। রাস্তা নেই,নদীর পার ধরে ধরে আন্দাজ করে পাহাড় ডিঙোন হচ্ছে। এদিক ওদিক হলেই নদীতে পড়তে হবে। খরস্রোতা স্রোত। চারজন ওভাবেই পড়ে মারাও গেল। কিছু করার নেই।অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অবশেষে আমরা ওইসব তীর্থযাত্রীদের নিয়ে উত্তরকাশীতে পৌঁছলাম।”

ভাস্বতীদির কথা শুনতে শুনতে ও কেমন স্থানু হয়ে গিয়েছিল। সামনে বসে থাকা এই মানুষটা সোজা মানুষ নয়। কত বড় যুদ্ধে সৈনিকের মত লড়াই করে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। ও কি পারত?

চমক ভাঙল ভাস্বতীদির কথায়। “আমার কথা যদি শোন তাহলে বলব,আর একটা বছর হলেই তোমার গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট হবে। ওটা করে নাও। তারপর চাকরির চেষ্টা কর। খেলাধূলার সার্টিফিকেট আছে তো? সরকারী চাকরি হলেই ভাল। পাহাড়ে চড়তে প্রচুর টাকাপয়সা লাগে। চাকরি থাকলে লোন পেতেও সুবিধে হবে। শিপ্রাদি তোমার কথা বলেছে আমাকে। তোমার তো বাড়ির পরিস্থিতি তেমন সুবিধের নয়। পাহাড়ে ওঠার নেশা বড় মারাত্মক । সেজন্য সবচেয়ে আগে লাগে টাকা । তোমার লোকবল নেই। অর্থবলও নেই। মাথা ঠান্ডা রেখে, সময় নিয়ে, পরিকল্পনা করে এগোও। লক্ষ্য স্থির থাকলে কে ঠেকাবে তোমাকে?”

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৩২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *