অক্সিজেন। পর্ব ৩১। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রেমে অপ্রেমে
মীরা ব্যালকনিতে কাপড় শুকোতে দিতে এসেই টের পেয়েছে কুহু এসেছে।বড় একটা গাড়ি পিছু হটে ফিরে যাচ্ছিল জি টি রোডে।নির্ঘাৎ কুহুই এলো। ওকে নামিয়ে দিয়েই ফিরে যাচ্ছে গাড়িটা। খাঁচার কাছে যেতেই রাধা ছটফটিয়ে দাঁড়ে ঘুরল একবার। তারপর পরিষ্কার উচ্চারণে বলল ‘কু…হু’।
আজকাল আর ওর কথা শুনে অবাক হয়না মীরা। ওর এই ঠিকঠাক কথা বলাটা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।কুহুকে ও নির্ঘাৎ ওর খাঁচা থেকে দেখেছে।তাই ওভাবে খবর দিল।সকাল থেকে মীরা নিজে অনেকবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে।কুহু সকালে আসবে যে ওর মা বলেছিল। কিভাবে,কখন এসে পৌঁছবে জানা ছিল না। ভেতরে ভেতরে কেমন নিশ্চিন্ত লাগছে তার।একটা অদ্ভুত নির্ভার ভাব। ওর পাহাড়ে যাওয়া নিয়ে বড় চিন্তা ছিল।কিছু বিপদ আপদ হয়নি,ফিরে এসেছে। দুশ্চিন্তা কাটল।অনেকদিন ধরেই মেয়েটা বড় কাছে টানছে তাকে।অলীক স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ‘এতটা ভালো নয়’ বলে মাঝেমাঝেই নিজেকে নিজেই ধমক দিতে হচ্ছে ।এই মুহূর্তে তো ওদের বাড়ি যাওয়া হবে না।যাক্ পরেই নাহয় দেখা হবে।
কদিন ধরেই বড্ড ডামাডোল যাচ্ছে ওবাড়িতে ।এই তো সেদিন রঞ্জিত বাজার থেকে এসে বলল একটা কান্ড হয়েছে। বলছি। তুমি রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রেখে এখানে এসো।
বিয়ের পর থেকেই দেখেছে ও, রঞ্জিত খুব ঠান্ডা লোক।হইচই ওর ধাতে নেই।একমাত্র কাগজের হেড লাইন দেখে, অথবা টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে রঞ্জিত খুব উত্তেজিত হয়।বিভুর রেজাল্ট ভালো হলে খুশি হয়ে আগডম বাগডম জিনিস কিনে এনে ছেলের হাতে দিয়ে আহ্লাদ দেখাত। সামাজিক বা পারিবারিক কোন সমস্যায় কোনকালেই তেমন মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি ওকে।তাই মীরা তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
“কী হয়েছে গো?” মীরা অধীর হয়।
রঞ্জিত মাস্কটা খুলে স্থির হয়ে তাকাল তার দিকে। “একটা অঘটন হতে হতে আটকে গেছে।ঘটলে আফশোসের শেষ থাকত না।”
“মানে? কী হয়েছে খুলে বলবে তো।” মীরা উত্তেজিত হয়ে একদম কাছে এসে দাঁড়াল রঞ্জিতের।
“পাশের বাড়ির কেকা, রেললাইনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল।একটি ছেলে ওকে ধরে ফেলেছে।কাজটা করতে পারেনি, তবে অবস্থা দেখে মনে হল ওর মাথার গোলমাল হয়েছে।”
মীরা ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়ে। “ও মাগো, এত কান্ড!ভাগ্যিস ছেলেটার হাতে ধরা পড়েছিল।কিন্তু তুমি এতকিছু জানলে কি করে?তুমি তো বাজারে গিয়েছিলে।”
“আরে একটা কাগজের দরকার ছিল।কোথাও না পেয়ে স্টেশনের হকারের কাছে যাই।ওখানে গিয়ে দেখি জটলা চলছে।স্টেশনের একটা বেঞ্চের চারধারে খুব ভিড়।একটি মেয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে।সে নাকি সুইসাইড করতে যাচ্ছিল।পারেনি।কথা বলছে না।তার বাড়ি কোথায়, এসব নিয়ে কথাবার্তা চলছে…।”
রঞ্জিতকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মীরা বলে ওঠে, “তারপর?”
“আরে কেকাকে দেখে আমি হতবাক।তারপর একটা টোটোতে বসিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলাম।যে ওকে ধরে ফেলে বাঁচিয়েছে, সে ওই গাড়িতে ওর সঙ্গে এলো।আমার সাইকেল ছিল তো।একদম নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।আমাকে চিনতে পারল না।অনেকদিন খাওয়া দাওয়া করেনি মনেহয়।”
“আর ওর মা,মানে নীপাদি বাড়িতে ছিলেন?” মীরা জানতে চায়।
“না।উনি তখনও স্কুল থেকে ফেরেননি।আমি আয়া মেয়েটির হাতে দিয়ে এলাম। একটু গরম দুধ খাওয়াতে বলেছি।তুমি একবার যাবে নাকি?” রঞ্জিত আবার বলে, “আমার চা আমি করে নেব।তুমি যাও দেখে এসো।কিছু যদি করতে হয়।”
মীরা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই দৌড়েছিল সেদিন।যাওয়াটা দরকার ছিল।সোজা হয়ে বসাতে পারা যাচ্ছিল না কেকাকে।শরীর এলিয়ে দিচ্ছিল কেমন। আয়া মেয়েটা একা ঘাবড়ে যাচ্ছিল খুব।একপাশে বসেছিল সেই ছেলেটা।কেকাকে চিনতে পারছিল না মীরা।রোগা হয়েছে তার সঙ্গে একটা ফ্যাকাশে ভাব।আচ্ছন্ন দৃষ্টি।কিছু পাড়া প্রতিবেশী ভিড় করেছিল।মিষ্টি কথায় তাদের বাড়ি পাঠিয়ে ,আয়া মেয়েটিকে ওই ছেলেটির জন্য এক কাপ চা করতে বলেছিল ও।
কেকাকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরের চৌকিটাতে শুইয়ে দেওয়া হল।দুধ এককাপও পুরো খাওয়ানো গেলনা। ঠিক সেসময়েই বাড়ি ঢুকলেন নীপাদি ।কেকাকে দেখে ,তাকে আর ওই ছেলেটিকে দেখে, মীরা যতটা ভেবেছিল, ততটা ঘাবড়ালেন না।
একটা অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় তাকে বললেন, “সবই আমার পাপের ফল।কী ঘটেছে কেউ আমাকে বলবে?”
ছেলেটি নিজে থেকেই সবটা বলতে শুরু করল তখন। মীরা বাড়ি চলে আসবে ভেবে একবার উঠেছিল ।তাকে হাতের ইসারায় বসতে বললেন নীপাদি ।চা খাওয়া শেষ হতে ছেলেটি চলে গেল।
মীরার খুব অপ্রস্তুত লাগছিল।কর্ত্তব্যের খাতিরে ছুটে যাওয়া।নাহলে কারুর ব্যক্তিগত ব্যাপারের মধ্যে ঢোকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে থাকেনা তার।নীপাদি বললেন, “আমি জানতাম এরকম একটা কিছুই হবে।তাই অবাক হচ্ছিনা।বাড়িতে একটা রুগী ছিলই,আর একজন বাড়ল।শোন, তুমি কুহু ফোন করলে কিছু বলোনা ।এসে যা দেখার দেখবে।তুমি এসো মাঝে মাঝে।ভেবোনা,আমি ঠিক সামলে নেবো।এই পেটেই তো হয়েছে , সামলাতে তো হবেই।”
মীরা বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিল কোন জিনিসই বিশুদ্ধ ভাল নয় বোধহয়। বিশুদ্ধ প্রেমের এই তো পরিণতি!
(ক্রমশ)