অক্সিজেন। পর্ব ৩০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

রজনীগন্ধা

হাওড়ায় ট্রেন থেকে নামার পর কুহু খুব অবাক হয়ে দেখল পিন্টু ওর সেই দাদার সঙ্গে ওকে নিতে এসেছে। সবাইকার সামনে খুব লজ্জা করছিল ওর। সোমাদির স্বামী এসেছেন ছেলেকে নিয়ে,আরো দু’একজনের বাড়ির লোক ও এসেছে। কিন্তু ওর ব্যাপারটা সত্যিই অভাবিত। ওর জন্য আসার তেমন কেউ ছিল না তো ।সেই ফাঁকটাই ভরাট করে দিল পিন্টুরা। পিন্টুর হাতের রজনীগন্ধার গুচ্ছ হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে অন্যরকম এক আনন্দে ভেতরটা ভরে যাচ্ছিল ওর।ওদের পেছনে বাচ্চু,পাপু, অনুও এসে দাঁড়াল যখন, বড় বেশি দিশেহারা হয়ে গেল কুহু।

সোমাদি মুচকি হেসে বললেন, “নাঃ!তোমার এভারেষ্টে ওঠা কেউ আটকাতে পারবে না।শুরুতেই এত?

এগিয়ে এসে পিন্টু ওর হাত থেকে একটা ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে বলল, “গাড়ি আছে।মা বলেছে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে।”

ও সাদা জামা পরা পিন্টুর দাদাভাইএর দিকে তাকাল একবার। একটু দূরত্ব রেখেই দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। ও লক্ষ্য করল সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখছে ওদের গোটা দলটাকে।ওই ছেলেটাকে সবসময় কেন যে ওর খাঁচার পাখি মনে হয়। যেন কোথায় আটকে আছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে ও পিন্টুর দিকে তাকিয়েই বলল,কী ব্যাপার রে?আমাকে নিতে চলে এলি যে?

পিন্টুর হয়ে ওর দাদাভাই বলল, “ছোটে, মানে মাসি পাঠিয়েছে আমাদের।”

পিন্টু বলল, “সবটা বলছ না কেন?বল। মা বলেছে, ‘পাহাড় জয় করে এলো মেয়েটা। সোজা কথা? ও একাএকা ট্রেনে ফিরবে কেন?যা, ওকে তোরা হাওড়ায় গিয়ে নিয়ে আয়।”’

এই হল পিন্টুর মা! ওনার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।ওর এতটা বয়সে এরকম কাউকেই দেখেনি ও। ওকেও ভীষণ ভালবাসেন, কোন কারণ ছাড়াই।

বাচ্চু ওর অফিসের মালিকের সামনে খুব একটা স্বাভাবিক হতে পারছিল না।স্বভাব বিরুদ্ধভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। পাপু আর অনু কখনওই বেশি কথা বলেনা।অনুর আবার ফোন এলো।ও দূরে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

কুহু সোজাসুজি বলল পিন্টুর দাদাভাই কে, “এক জায়গাতেই তো যাব আমরা।আমার বন্ধুদের যদি একটু,…।”

কথা শেষ করার আগেই পিন্টুর দাদাভাই হেসে ঘাড় নাড়ল।“ নিশ্চয়ই, কোন অসুবিধে নেই।”

সোমাদিরা সকলেই বিদায় নিয়ে যে যার মত ট্রেন ধরতে গিয়েছে।পিন্টুর পাশাপাশি হাঁটছিল কুহু।মালপত্র সব বাচ্চুদের জিম্মায়।ওর মনে হচ্ছিল হাওড়া স্টেশনে ওর জন্য  একটা দামী কার্পেট পেতে দিয়েছে কেউ।ও তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

গাড়িতে মাঝের সিটে অনুকে নিয়ে উঠল কুহু। পিন্টু তাড়াতাড়ি এসে বসেছে কুহুর পাশে। সেই থেকে ও একবারও কুহুর কাছছাড়া হচ্ছেনা।বাচ্চু অগত্যা আড়ষ্ট হয়ে সামনের সিটে গিয়ে বসল।একদম পেছনের সিটে পাপু।স্টেশনে দাঁড়িয়ে একবার সবাই মিলে চা খেয়েছে ওরা।দাম দিয়েছে বাচ্চু।কুহু খেয়াল করেছিল, পিন্টুর দাদা অম্লানবদনে চায়ে চুমুক দিয়েছে।একবারও দাম দেবার জন্য জোরাজুরি করেনি। ছেলেটার অহং কম,মনে মনে ভেবেছিল ও।

চা খাবার ঠিক আগে, “আমার নতুন চাকরি হয়েছে আর কুহু এলো পাহাড়ে চড়ে। চা আমিই খাওয়াব।” কথাটা একটু লাজুক গলায় ঘোষণা করেছিল বাচ্চু।

“বিস্কুটের দাম আমি দিই।”পাপু ফুট কাটতেই বাচ্চু বলেছিল, “ অত কমে হবেনা ব্রাদার।ওটা বরং তোলা থাক।“

পাপু সবার কান বাঁচিয়ে স্বগোতোক্তি করেছে, “আহা কী শুনলাম!এই প্রথম বাচ্চুর পুরো বাক্য ‘ম’ কারান্ত ছাড়া। লক কিয়া যায়ে।”

মাঝের সিটে বসে কুহু ঘামছিল।গাড়ি ছুটছে জি টি রোড দিয়ে।কুহুর মাথায় ঘুরছে বাবা কেমন আছে? মার কী অবস্থা কে জানে?এদের সঙ্গে তবু ফোনে সামান্য হলেও কথা হয়েছে।দিদির খবর ও একটুও পায়নি।বাড়ি গিয়েই দু’একদিনের মধ্যে দিদির খবর নিতে হবে।

পেছন থেকে চিমটি দিয়ে পাপু ওকে দেখাল বাচ্চু আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে।পেছন ফিরে দেখা তো দূরের কথা,নড়ছে না অবধি।কুহু পাপুকে চোখ দিয়েই ধমকালো। তারপরেই ওর নজর গেল পিন্টুর দিকে।পিন্টু মন দিয়ে ওদের লক্ষ করছে।

ট্রেন থেকে ওরা নেমেছিল সকালে।এখন বেলা বেড়েছে।রবিবারের ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় এঁকেবেঁকে গাড়ি চলেছে।পিন্টুর দাদা গাড়ি খারাপ চালায় না।যে যার জায়গায় নেমে গেল বন্ধুরা।

বাড়ির দরজায় গাড়ি থামতে ওকে নামিয়ে পিন্টুরা চলে গেল।ও প্রথমেই দেখল মাকে।মা কেমন রোগা হয়ে গিয়েছে বলে মনে হল ওর।ওকে দেখে কোন কথা না বলে জড়িয়ে ধরল একবার। অনেক দিন বাদে মায়ের গায়ের পাউডার গন্ধ  নাকে ঝাপটা দিল।মা আস্তে করে বলল, “জামাকাপড় ছেড়ে বাবার কাছে যাবি তো?তুই যা।আমি চা নিয়ে আসছি।”

ঘরে ঢুকতেই চমক লাগল ওর। দিদি বসে আছে বাবার মাথার গোড়ায়।চুপ করে বসে বাবার মাথায় হাত বোলাচ্ছে ।‘দিদি’ বলে ডাকতে তাকাল ওর দিকে।নিস্প্রাণ চাহনি। হাসল না। বাবা বোধহয় ওর গলা শুনে চোখ মেলল। চোখে চিকচিক করছে জল। ট্রেনের কাপড়ে বাবার বেশি কাছে যাওয়া উচিত হবে না। কুহু দাঁড়াল না আর।

একটু পরে বাইরের পোশাক ছেড়ে হাত পা ধুয়ে কুহু মায়ের কাছে গেল।মা রান্নাঘরে রান্না চাপিয়ে কুটনো কুটছে।সেই আগের মত,কিন্তু চেহারায় আগের জেল্লা নেই।যদিও মায়ের রোগা হওয়ার রহস্য এতক্ষণে ওর কাছে পরিষ্কার।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৩০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. বাপরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না পরের পর্বটা কবে হাতে পাব!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *