অক্সিজেন। পর্ব ২৮। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

সুখেরও লাগিয়া

বাইরে জোর বৃষ্টি পড়ছে। বিলু মন খারাপ করে বসে আছে পড়ার টেবিলের সামনে। বই খোলা।কিন্তু কোনকিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।

বিলুর কাছে খবরটা এসেছে।পিন্টুর দিদিমনি নাকি পাহাড়ে চড়বে এবার।টেবিলের ওপর খোলা বইপত্রের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনটা বড় একঘেয়ে লাগছিল বিলুর।চারপাশে সবাই কত কিছু করছে।আর ওই শুধু সারাক্ষণ চারদেওয়ালের মধ্যে আটকে আছে। বন্ধু বলতে একজন, টুপু। তা সে তো এখন দিল্লীতে। ফোনে কথা বলে ঠিক মজা পাওয়া যায়না।

আর আছে ছোটে । ছোটের সঙ্গে সব কথা বলে সুখ হয়না।তাছাড়া ছোটে সারাক্ষণ কাজে এত ব্যস্ত থাকে, ও ঠিক মন দিয়ে সব কথা শোনেও না।

বিলুর মাঝেমাঝেই ইচ্ছে করছে ঝোলাঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যেদিকে দুচোখ যাবে সেদিকেই চলে যায়।কিন্তু বাস্তবে সেটা তো একেবারেই অসম্ভব।আজ সকালেই চুল কাটতে কাল্টুর দোকানে গিয়েছিল ও।কাল্টুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

আসলে এরকম দু’একজন মানুষ আছে যাদের সঙ্গে ও মনপ্রাণ খুলে কথা বলতে  না পারলেও মন দিয়ে তাদের কথা শুনতে পারে।কেননা সেসব কথা অনেক আলাদা।ও বেশ উপভোগ করে।

কাল্টু আজ বেশ মুডে ছিল।সেলুনেও তেমন ভিড় ছিলনা।ওর সঙ্গে টানা অনেকক্ষণ কথা বলে মনটা হাল্কা লাগছিল।কাল্টু বলছিল, “হরি সামন্তকে চেনেন?”

“হ্যাঁ চিনি ।হরি কাকা তো? উনি তো অনেকদিনই নিরুদ্দেশ।ব্যবসা এখন ওর ছেলে দেখে ।”

“ওই হরি সামন্ত কোথায় গেছে ,কেন গেছে ,সব আমি জানি।আপনাকে বলতে পারি শুনবেন? কাউকে বলবেন না কিন্তু।”

“বল।আমি আবার কাকে বলব?”

“‘না ,মানে ওর ছেলেপুলেরা তখন আমাকে ছিঁড়বে।খতরনাক লোকজন সব।জানেন হরিবাবু আমার কাছে রোজ দাড়ি কামাতে,মাঝেমাঝে চুল কাটতে আসতেন। একেবারে  দোকান খুলতে না খুলতে চলে আসতেন, প্রাণের মনের দুটো কথা ফাঁকায় ফাঁকায় বলবেন বলে।প্রায় বলতেন একটাই কথা, ‘তোকে বলছি কাল্টু, আমার জীবনে কোন সুখ নেই।’”

“আমি বলতাম কেন?সুখ নেই কেন?আপনি তো অনেক পয়সা কামিয়েছেন,বাড়িতে বউ,ছেলে ,মেয়ে,নাতিপুতি ।ভরভরতি সংসার।আপনার আবার কিসের অসুখ?”

উনি হাসতেন, “ওই পয়সাতেই অসুখ বুঝলি।আমায় কেউ চায়না।আমার পয়সা, ব্যবসা, সম্পত্তি নিয়েই ওদের যত মাথাব্যথা!”

“বউদি?তিনি তো আপনাকে দেখেন?”

“না।দেখে না।সে সারাক্ষণ তার সংসার,বাপের বাড়ি, নিয়ে ব্যস্ত।আমার সঙ্গে আগে তার পাওনাগন্ডার সম্পর্ক ছিল।এখন দিনরাত ঝাল ঝাড়ে।কী সে পায়নি, কী তাকে বলেছি, এইসব।”

“তারপর?” বিলু কৌতুহলী হয়।

“মানুষটার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগল জানেন। আমি ভাল করে ওনার মাথায় ঘাড়ে ম্যাসাজ করে দিলাম।বললাম, সংসারী মানুষের কষ্ট থাকে,আনন্দও থাকে।ওসব নিয়ে ভাববেন না।আপনি বরং মাঝেমাঝে বেরিয়ে পড়ুন।”

“তারপর?” বিলুর আগ্রহ বেড়ে যায়। কেসটার সঙ্গে তার নিজের অবস্থার একটু একটু মিল খুঁজে পাচ্ছিল ও।

“আরে ওই বলাই তো কাল হল। দুদিন বাদেই শুনি উনি কাউকে কিছু না বলে ভোরবেলা বাড়ি ছেড়েছেন।একেবারে উধাও।”

“তুমি যে বললে তুমি জান হরি বাবু এখন কোথায় আছেন।আপাততঃ ওনার ঠিকানাটা কী? তোমার সত্যি জানা আছে?”

কাল্টু বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে হাত চালাতে থাকে। তারপর গলা নামিয়ে বলে, “কাউকে বলবেন না।উনি এখন হরিদ্বারে একটা আশ্রমে আছেন।দাড়ি রেখেছেন।চুলে আর কলপ দেন না।এখানে থাকাকালীন আমাকে ফোন করে সেলুন ফাঁকা আছে কিনা জানতে চাইতেন ।কথা বলবেন বলে নিরালা খুঁজতেন তো।আমার ফোন নাম্বার ওনার কাছেই ছিল।”

“তারপর?” বিলু ধৈর্য হারাচ্ছিল।

“ওনার চলে যাবার সপ্তাদুয়েক বাদে একদিন বিকেল চারটে নাগাদ একটা ফোন এলো।সবে খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছি।একটু বিরক্ত হয়েই ফোন অন্‌ করে দেখি হরিবাবু।আমি তো অবাক!

বললেন, ‘কাল্টু রে বড় শান্তিতে আছি।হরিদ্বারে আশ্রমে থাকি।চুল দাড়ির অবস্থা যা,কলপ ছাড়া একদম সাদা,আর বড় বড় ।একটাই সুবিধে, আমাকে কেউ চিনতে পারবে না।টাকাপয়সা ওদের দিয়ে এসেছি।শুধু আমার বাকিজীবন চলার মত কিছুটা সঙ্গে আছে। তোর কথায় বেরিয়েছি,তাই তোকেই সবটা বললাম।আশা করি কাউকে কিছু বলবি না।”

“তা তুমি আমাকে বললে কেন?”

কাল্টু এবার হাসে, “আমার একটা ক্ষমতা আছে জানেন।আমি নিত্যি যাদের ছুঁয়ে দিই, তাদের মনটা টের পাই।আপনার একটা কষ্ট আছে।সুখী মানুষের কষ্ট। কিছু মনে করবেন না, এরকম কষ্ট আমি ঢের দেখেছি।যাদের ভাতের থালা আপনা আপনি মুখের সামনে আসে, এ কষ্ট তাদের। একটা কথা বলব? ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে কিন্তু।বলব? ”

বিলু বোঝে কাল্টু এবার জ্ঞান দেবে ওকে। দিক্‌,অসুবিধের কি আছে?ও বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ বল না।”

“আপনার কষ্ট একেবারে চলে যাবে।একটা টোটকা আছে আমার, সেটা যদি মেনে চলেন।তবে তারজন্য একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।ওই ভাতের থালাটা নিজের হিম্মতে যোগাড় করতে হবে।করে দেখুন।আপনার কষ্ট নিয়ে ভাবনা চিন্তা আর থাকবে না।”

কথাটা কদিন ধরে ভেবেছে ও।ভেবে ভেবে দেখেছে, কাল্টুর কথা শুনতে পারলে হয়ত উপকার হবে।তারজন্য একটা রাস্তাই আপাততঃ খোলা আছে। সেটা হল ‘জি আর ই’ তে ক্লিক করা। তাই সকাল বিকেল বই নিয়ে বসছে ও।সিরিয়াসলি পড়াশুনা শুরু করেছে।

ফেসবুক খুঁজে কুনালের মেসেঞ্জারে লিখেছিল ও। কুনাল ওকে ‘জি আর ই’র ট্রেনিং সেন্টারের   ঠিকানা দিয়েছে। যোগাযোগ করেছিল বিলু ।এই শহরতলি থেকে কলকাতা যেতেও একঘন্টার মত সময় লেগে যাবে।প্রতিদিন দুটি ঘন্টা যেতে আসতে, ক্লাস করতে আরো ঘন্টা দুয়েক। তবুও হাল ছাড়বেনা ও। চেষ্টা করে দেখবে।তারপর যা হয় হবে।

(ক্রমশ)

 

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ২৮। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. খুব ভালো লাগছে। কাল্টুর চরিত্রটা অনবদ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *