মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৪। আচ্ছে দিন রহস্য । লিখছেন আদিত্য ঢালী

0

কথায় আছে রাখে হরি তো মারে কে। আমরা যখন সবে কৈশোরের গণ্ডি পার করছি তখন থেকেই শুনে আসছি এই বোধহয় কিছুদিন পরেই আচ্ছে দিন আসতে চলেছে। আচ্ছে দিন এসে হয়ত চলেও গেছে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। আপনারা বুঝেছেন কিনা জানি না কিন্তু কালিপদ মিদ্যা বুঝেছিলেন। এবারে প্রশ্ন আসতেই পারে কীভাবে বুঝলেন উনি, আচ্ছে দিনের উপভোগই বা কীভাবে করলেন। তাই সরাসরি লাফ দিচ্ছি আচ্ছে দিনের বর্ণনায়।

প্রায় বছর খানেক হয়ে গেছে অফিসে যোগ দিয়েছি। দিন যে কীভাবে পার করে এসেছি তার খানিকটা টের পেয়েছি আর বাকিটা টের পাওয়ার আগেই কেটে গেছে। এক বিকেলে কাজকর্ম সেরে নারানদার সাথে বসে গ্রামের ঝিলপাড়ের গল্প শুনছি। এতদিন ধরে এটাই শুনে এসেছিলাম গ্রামের ঝিলপাড়ের গল্প নাকি যে শোনে সেই নাকি ঝিলপাড়ে যেতে চায়। ঝিলপাড়ের নাকি এতই মোহ। কিন্তু আমার বয়স অল্প হওয়ায় আমায় সে গল্প শোনাতে এতদিন কেউ রাজি হয়নি। এখন আমি এক বছর পার করেছি কিছুটা সিনিয়র হয়েছি একেবারে আনকোরা আর নেই। অতএব এবারে আমাকে শুনতেই হবে। অনেকদিন ধরেই নারানদার সাথে লেগে ছিলাম যাতে গল্পটা আমায় ও বলে। কিন্তু লাজুক নারানদা কিছুতেই সেই গল্প আমায় বলতে চায়নি। কিন্তু আমিও হাল ছাড়িনি। সাম-দান-দণ্ড-ভেদ কোনটাতেই যখন কাজ হয়নি তখন আমি ছলের আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওকে গিয়ে সরাসরি একদিন বললাম “তোমার শ্রী কৃষ্ণও কিন্তু দ্রৌপদীকে বস্ত্রহীন হতে দেখেছিল এবং তারপর তাকে রক্ষা করেছিল কাজেই তুমি যদি আমায় বয়সের দোহাই দিয়ে ঝিলপাড়ের গল্প না বলো তবে কিন্তু তুমিও রক্ষা পাবে না আমার হাত থেকে। তোমারও অনেক সিক্রেট আমার হাতে আছে, সেসব কিন্তু আমি ফাঁস করে দেব এবারে।” বেচারা কি বুঝল জানি না। কাঁচুমাচু মুখ করে আমায় বলল “না না সেসব কথা আপনি কাউরে বলবেন না। ঝিলপাড়ের গল্প আমি আপনারে একদিন বলে দেব চুপিচুপি।” আমি বুঝলাম ওষুধে কাজ হয়েছে। এদিকে ওর কোন সিক্রেটই আমার জানা ছিল না।

সেদিন অফিস শেষ হওয়ার পর দু’জনে মিলে বসে ঝিলপাড়ের সরস গল্পই সবে শুরু করেছিলাম। ম্যানেজারের ফোনে হঠাৎ একটা ফোন আসার পরই ম্যানেজার আমাদের দু’জনকে ডেকে নিল। নারানদাকে কাছে ডেকে বলল “এই তুমি কালিপদ মিদ্যার ফর্মটা এখুনি বের কর।” আমার দিকে তাকিয়ে বলল “বুঝলে এখুনি যেতে হবে ওর বাড়ি। লোনটা অনেকদিন ধরে এনপিএ হয়ে আছে। হেড অফিস থেকে এখুনি ফোনে বলল যেভাবেই হোক লোনটা ওকে দিয়ে মেটাতে হবে ছাড়ছুড় করে হলেও।” আমি বললাম “চলুন তাহলে, দেরি করে তো লাভ নেই কোন।” আমরা দু’জনে বেরিয়ে গেলাম। বাইকে করে মিনিট দশেক লাগল কালিপদর বাড়ি যেতে। বাড়িটা দেখে মনে হল খুব বেশিদিন হয়নি। বাইরেটা এখনও প্লাস্টার হয়নি। বাড়ির সামনে একটা সাবমারসেবিল আছে। আর তার লাগোয়া পায়খানা বাথরুম। দরজায় কড়া দিতেই বাড়ির গিন্নি বেড়িয়ে এলেন। বোধহয় ঘুম থেকে উঠে এলেন। ব্যাঙ্ক থেকে এসেছি শুনে বেশ গদগদ হয়ে আপ্যায়ন করে ঘরের ভিতর বসতে দিলেন। আমরা চা খাব না বলাতে একটু বেশিই মুষড়ে পড়ে দু’গ্লাস শরবত নিয়ে এলেন। লোন আদায়ে এসে এত আপ্যায়ন এর আগে কখনও পাইনি। যা পেয়েছি তা শুধুই দু’ গাল ভরা অপমান ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এখানে তো একেবারে উল্টো। দু’ ঢোক সরবত খেয়ে ম্যানেজারই কথা শুরু করলেন।

— কালিপদবাবু আছেন?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি খবর পাঠিয়েছি। উনি আসছেন। এই কাছেই আছেন।

এই কথা শেষ হতে না হতেই এক ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সবার আগে ভদ্রলোককে দেখে যেটা চোখে পড়ল সেটা হল ওনার পরচুল। বুঝতে পারলাম আমাদের অনভিপ্রেত আগমনের ফলে ওনাকে ঘরের মধ্যেও পরচুলটা পরে আসতে হল এবং সেটা পরছিলেন বলেই একটু আসতে দেরি হল। কিন্তু তাড়াহুড়োতে উনি পরচুলটা উল্টো পরে এসেছেন। মনে হচ্ছে না উনি সে বিষয়ে অবগত। কিন্তু ওনার স্ত্রী দেখেই সেটা বুঝে গিয়েছেন এবং ওনাকে আড় চোখে ইশারা করে ঠিক করে আসতে বলছেন। উনি সেটা বুঝে আমাদেরকে আরও দু’ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে এই ফাঁকে আমি গলায় ঢকঢক করে শরবতটা ঢেলে দিলাম। ম্যানেজারও দেখলাম আমার দেখাদেখি শরবতটা শেষ করে ফেললেন। ভদ্রলোক মিনিটখানেকের মধ্যেই পরচুলটা ঠিক করে আবার ঘরে ফিরে এলেন। আমাদের সামনেই একটা টুল টেনে বসলেন। ম্যানেজার হাতের গ্লাসটা রেখে বললেন — হেড অফিস থেকে খুব চাপ আসছে বুঝলেন তো। তাই জন্যই আসা। অনেকদিন ধরে এনপিএ হয়ে আছে। এবারে কিন্তু আপনাকে লোনটা শোধ দিয়ে দিতে হবে।

ম্যানেজারের কথা শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন — “লোন? আমার লোন?”

ম্যানেজার মাথা নেড়ে বললেন “হ্যাঁ, আপনার লোনটা। পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছিলেন, কিছুটা সাবসিডি ঢুকেছে আর এখন সুদে আসলে প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার হয়েছে। আপনি কাল ব্যাঙ্কে আসুন আমি কিছুটা ছাড়ছুড় করে দেব। কিন্তু এবারে আপনাকে শোধ দিতেই হবে। টাকাটা নেওয়ার পর আপনি একটা কিস্তিও দেননি। অনেকগুলো বছর কিন্তু হয়ে গেছে। সেই ২০১৫ সালের লোন।”

ভদ্রলোক চোখ বড়বড় করে কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। দেখে মন হল কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে। বহু কষ্টে খুব ক্ষীণ স্বরে বললেন –– “আমি তো কোন লোন নিই নি স্যার।” ম্যানেজার তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “কি? আপনি লোন নেন নি? আপনার নাম কালিপদ মিদ্যা তো? বাবা তারাপদ মিদ্যা?” ভদ্রলোক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। ম্যানেজার এবারে একটু গলা ঝাঁজি দিয়ে বলল

— তাহলে কি মস্করা করছেন আমার সাথে? লোন নেবেন আর শোধ দেবেন না আর টাকা চাইতে এলে অস্বীকার করবেন এটা কি ধরনের ভদ্রতা? টাকাটা নেওয়ার সময় ঠিক নিয়ে গেছেন!

— কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কোন লোন নিই নি। অনেক বছর আগে যখন ছাগলের ব্যবসা করতাম তখন একবার নিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো আমি শোধ দিয়ে দিয়েছি। আগের আরডিও স্যার নিজে আমায় কাগজ দিয়েছিল শোধ হয়ে যাওয়ার পর এবং বলেওছিলেন আরও একটা লোন উনি দিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু আমি তো আর কোন লোন নিই নি স্যার।

ম্যানেজার আর কথা না বাড়িয়ে বলল “আপনি কাল সকালে ব্যাঙ্কে আসুন। যা কথা বলার অফিসে বলব। মনে করে আসবেন কিন্তু।”

ফিরতে ফিরতে ম্যানেজার কপালের ঘাম ঘাম মুছতে মুছতে বললেন “কি ব্যাপার বলত? দেখেশুনে তো ভদ্রলোকই মনে হল কিন্তু এরম অস্বীকার করল কেন?” আমিও ভাবার ভঙ্গি করে বললাম “সেটাই ভাবছি।” জটায়ু থাকলে হয়ত বলতেন “হাইলি সাসপিসিয়াস।”

 

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব…

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *