খড়কুটোর জীবন : এক মাঘে যায়নি যে শীত। পর্ব ১ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

শীত পড়তেই হাত-পা-গাল ফাটতে শুরু করতো। আমার গাল ফাটতেই বন্ধুরা ছড়া বলে ক্ষেপাতো। সুর করে তাদের ব্যাণ্ড সং — ‘গাল ফাটা কলাই রুটি, গাল ফাটা কলাই রুটি।’ সত্যই গাল জুড়ে শীতের রুক্ষতার রক কনসার্ট চলতো। স্নানের সময় ঘানির সর্ষের তেল গালে মাখতেই হু হু করে জ্বালা করতো। মাঠ ভর্তি  হলুদ সর্ষে ফুল দেখেও সে জ্বালা জুড়োতো না।

যাই হোক তৈল সিক্ত হয়ে শীত রৌদ্রে কিছুক্ষণ লাফা-লাফি করে বাড়ির পাশের পুকুরে দুঃসাহসী ঝাঁপ দিতাম। যখন মাথা মুছতে মুছতে উঠে আসতাম তখন দাঁতে-দাঁতে শীতের আঁতাত। উঠানের রোদ্দুরে বসে বসে  সারকেলে  ধানের মোটা লাল চালের ভাত, কলাই-এর ডাল, বেগুন ভাজা, কলাই বড়ি ভাঙা আর নতুন আলু দিয়ে বাঁধাকপির ঝাল, ফুলকপি আর লাঠা মাছের ঝোল — আহা এককথায় অমৃত সমান।

শীতের বেলা দ্রুত গামী। তাই আমরা বাচ্চারা খাওয়ার পরেই শুরু করতাম খেলা। সে নানান খেলা। কখনো খামারে গাদা দেওয়া ধানের আড়ালে বা পোয়ালের মধ্যে খেলতাম লুকোচুরি খেলা। একজন হতো মুচি। সে সকলকে খুঁজবে। প্রথম যাকে খুঁজে পাবে সে হবে মুচি। আর পিছন থেকে কেউ এসে ধাপ্পাবাজি দিলে মুচি আবার হবে মুচি। ফুল খেলা, গাদি খেলা, ঝাল খেলা, খেটে খেলা, বটি খেলা, ডিগডিগাডিগ খেলা, কিতকিত, কড়ি, ঘুঁটি, ক্রিকেট কিছু না কিছু খেলতেই সন্ধ্যা আসতো ঘনিয়ে।

গরুর নাদার পাড়ে সাঁজাল দেওয়া হতো। গোয়ালেও। নাদার পাড়ের সাঁজালে বড়োরা হাত-পা সেঁকতো আর বিড়ি টানতো। সঙ্গে চলতো নানান গল্প। গোরু চুরি থেকে গঙ্গাসাগর মেলা কিছুই বাদ যেতো না। সাঁজালের আগুনে মাঝে মাঝে পুড়িয়ে খাওয়া হতো লাল আলু যাকে কিশোরী আলু ও বলতাম।

রাত আটটা বাজতে না বাজতে সারা গ্রাম লম্ফ নিভিয়ে সেঁধিয়ে যেতো লেপের আড়ালে। দুটো ধুগড়া কাঁথাতেও অনেকে কাটাতো রাত। শীত রাতের নিস্তব্ধতায় ভেসে আসতো শিয়ালের ডাক। ঠাকুমা গল্প বলতো – ”মা শিয়াল তার বাচ্চা গুলোকে রাতের ঠাণ্ডায় বলে একটু সহ্য করো শীত, সকাল হলেই কাঁথা সেলাই করবো।’ কিন্তু সকালে পিঠে রোদ লাগতেই মা আর ছা সব শিয়াল ভুলে যেতো কাঁথার কথা।” ভাই বিছানায় হিসু করে ফেলতো বলে ঠাকুমা ঘুমের আগে একটা মন্ত্র বলাতো -‘ঘরে শুত্তা, বাইরে মুত্তা।’ তবু শীতের ভয়ে বাইরে প্রস্রাব করতে যাওয়ার চেয়ে বিছানায় সে কম্ম করে সারারাত লেপ জড়িয়ে থাকাকেই শ্রেয় মনে করতো ভাই। মাঝে মাঝে গ্রামে কোনো বাড়িতে ডাকত পড়লে লেপ মুড়ি দিয়েই ভয় থেকে বাঁচতাম । তার পর কখন ভোর হতো জানতে পারতাম মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের শব্দে। খেজুর রস খেতে হলো তো উঠতে হবে। জিরেন কাটের লাল রস আর লাল সূর্য ঘুম ভাঙিয়ে দিতো।

খেজুর রস আর তা থেকে বানানো নলেন গুড় , পাটালি বা তাড়ি যে না খেয়েছে  সে তো মহা অরসজ্ঞ। রসিক সমাজে সে ঠাঁই হীন। খেজুর রস নিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত সেই কবেই লিখেছিলেন —

‘হায়রে শিশির তোর কি লিখিব যশ।
কাল গুণে অপরূপ কাঠে হয় রস।।
পরিপূর্ণ সুধা বিন্দু খেজুরের কাঠে।
কাঠ কেটে উঠে রস যত কাঠ কাটে।।
দেবের দুর্লভ ধন জীবনের ঘড়া।
এক বিন্দু রস খেলে বেঁচে ওঠে মড়া।।’

পুকুর পাড়ে, দিঘির ধারে, জমির আলে সারি সারি খেজুর গাছ। শীত এলেই দেখতাম গলায় কলসী বেঁধে রসের সাগরে মরণ স্বাদের ডুব দিচ্ছে। শিউলিরা সকাল সন্ধ্যে পাখির কণ্ঠে শুনছে — ‘খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন / নইলে রস গড়িয়ে গোড়া পচে হবে যে মরণ।’ আমরা ছেলেরা মাঝে মাঝে রস চুরি করে খেতাম। ঠিলি খালি হয়ে গেলে জল ভরে দিতাম। আমাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য শিউলিরা কলসীতে কচুর ডাঁটি কুচিয়ে রেখে দিত। সেই রস খেয়ে মুখ চুলকাতে চুলকাতে ঘরে ফিরতাম। তারপর প্রতিশোধ নিতে রসের হাঁড়িগুলি গুলতির টিপ প্রাকটিসের বস্তু বানাতাম।

সকালে ঢেঁকিশাল থেকে ভেসে আসতো ধপা -ধপ ঢেঁকির পাড় পড়ার শব্দ। বর্ষিয়সী মহিলারা চাদর জড়িয়ে ঢেঁকির নোটে বার বার ঠেলে দিচ্ছে কোটাই করার শস্য। আর যুবতী কোনো বউ মাজা দুলিয়ে দুলিয়ে তালে তালে দিচ্ছে পাড়। ঘুম ছুটে যাওয়া চোখে তার কাঁচা রোদ। এরপর গরম গরম ভাত হবে। পুরুষেরা ভাত খেয়ে মাঠে যাবে। শীতের কালে চাষীরা একটু বেলা করেই মাঠে যায়। তাই বলে যারা লাঙ্গল বইতে যায় তারা ভোর বেলাতেই যায়। শীতের ধুলোয় গরুর পা আর  চাষীর পায়ের ছাপ রোদে উঠতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাতে কোনো সাপ রাস্তা পার হয়েছে তারও আঁকাবাঁকা দেহ ভঙ্গী আঁকা থাকে ধুলোর পটে। শিশির ভেজা খড়কুটো ছড়িয়ে থাকে পথে পথে। কাঠ মল্লিকার মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভরে থাকে। পাশ দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায়।

হচ্ছিল ভাত খাওয়ার কথা। এতো ধান ভানতে শীবের গীতের মতো হয়ে গেল। তা সকলেই সকালে গরম ভাত খায় না। তারা খায় রাতে জল না দেওয়া করকর ভাত। পান্তা যেমন গ্রীষ্ম স্পেশাল, করকর ভাত তেমন শীত স্পেশাল। করকরা ভাতের সঙ্গে সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে মাখা বেগুন পোড়া। কখনো বিচিবড়ি পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা। আহা! শীত সকালে  যেন স্বাদের তাণ্ডব।

সকালে চট পেতে পিঠে রোদ লাগিয়ে আমাদের ছোটদের চলতো পাঠ পড়া। চিৎকার আর ক্রমাগত দুলুনির সহজ পাঠ। কিশলয় যে কীসে লয় পেতো এখন বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে মাথা চুলকানি। আসলে হনুমান টুপির ফল। পাশে রাখা থাকতো হলুদ কমলালেবু। পড়া শেষ হলেই খাওয়া। রেডিও তে কখনো বাজতো সকালের সংবাদ অথবা কোনো কথিকা অথবা গান। আমার সব থেকে ভালো লাগতো প্রাত্যহিকী নামক চিঠি পাঠের অনুষ্ঠান। আইভি রাহা, বিজয়লক্ষী বর্মণ, দেবাশীষ বসুদের কণ্ঠ ছিলো আমার ভীষণ প্রিয়। অনেক পত্র লেখকও আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। কত গ্রাম, নগরের নাম যেতাম জেনে। আর বিষয় নির্ভর চিঠিগুলি আমাকে মোহিত করতো। পড়া থামিয়ে কান পেতে শুনতাম। বড়োদের ধমক খেয়ে আবার পড়া শুরু হতো । বড়ো হয়ে রবি ঠাকুরের ছিন্ন পত্র পড়তে গিয়ে বুঝেছিলাম চিঠির মহিমা।

ক্রমে শীতের নরম রোদ কঠোর হয়ে উঠতো। ছুটতে হতো স্কুলে।

যেদিন বাড়িতে থাকতাম দেখতাম ঝাঁকা ভর্তি আলু, কপি, ছিম, গাজর, টম্যাটো নিয়ে এসেছে সব্জী ওয়ালা। খামারের নতুন ধান বা নগদ পয়সার বিনিময়ে কিনছে মহিলা মহল। এই সময় আসতো খেজুর গুড়। পিঠে-পুলির জন্য তো তা চাই-ই  চাই। মাঝে মাঝে ধামায় করে মহাদেব মোদক নিয়ে আসতো রসগোল্লা, মিঠাই জিভে গজা, আঙুল গজা, নিমকি। খামারে ধান মাড়াই করতে করতে চাষীদের মাঝে ধানের বিনিময়ে নামতো সেই রসের ধামা। এক খামার থেকে আর এক খামারে বয়ে যেত রসের ধারা।

বাড়ির ভাঙা বেড়া গুলো মেরামত হতো এই সময়। সবার তো আর ইটের প্রাচীর তোলার সামর্থ্য থাকতো না। মাটির প্রাচীর অবশ্য অনেকেই দিতেন । আর অধিকাংশই পাটকাঠি বা বাঁশের কাবারি বা চটা দিয়ে বেড়া দিতো। পাটকাঠির বেড়াই কঞ্চির বাতা দেওয়া হতো কঞ্চিরই চটা দিয়ে। আমাদের ছোটোদের কাজ ছিলো বেড়ার চটা ঘোরানো। মা কালী যেমন সাধক রামপ্রসাদের বেড়ার বাঁধন ঘুড়িয়ে দিয়েছিলেন সেইরকম।

দাদুরা মজা করে বলতেন -‘বলতো, বেড়ার গায়ে ফুল ফুটেছে।’

যেই বলতাম — ‘বেড়ার গায়ে ফুল ফুটেছে।’ অমনি দাদু বলতেন — ‘তোর শাশুড়ির গোঁফ উঠেছে।’

এই না বলে বোকা বানিয়ে দিয়ে সকলে খুব আমোদ করে নিতো। দাদুও শুনতেন কয়েকটি অপশব্দ। তাতে আবার সবার হাসি। সে হাসিতে সহজিয়া সারস উড়ে যেতো আকাশে।

(ক্রমশঃ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *