মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৫। আচ্ছে দিন রহস্য । লিখছেন আদিত্য ঢালী

গত পর্বের পর…

পরদিন সকালে অফিসে এসেই দেখি ভদ্রলোক এক কোণায় বসে অপেক্ষা করছেন। আমাদের আসতে দেখেই ম্যানেজারের টেবিলের সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়ালেন। ম্যানেজার সব গুছিয়ে-টুছিয়ে চেয়ারে বসে বললেন “দেখুন কালিপদবাবু, মেশিন কিন্তু যা দেখাচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে কালিপদ মিদ্যা, সন অফ তারাপদ মিদ্যা — মানে আপনিই লোন নিয়েছেন। এবারে আপনি বলুন কী বলবেন।” ভদ্রলোক হাত দু’টো জড়ো করে বললেন “স্যার, আমি সত্যিই বলছি আমি কোনও লোন নিইনি। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ বলুন?”

ম্যানেজার- “দেখুব সেসব আপনি জানেন আমি কিছু বলতে পারব না। আমার কাছে মেশিন যা দেখাচ্ছে আমি আপনাকে তাই বললাম। আপনি নিজে এসেও দেখতে পারেন।”

কালিপদ- কিন্তু স্যার, আমি কেন লোন নেবো বলুন। আমি তো লোন শোধ দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমি আর কোন লোন নিই নি। আপনি চাইলে আগের আরডিও স্যারের সাথে কথা বলুন।

ম্যানেজার- দেখুন আমি চিনি না আগে কে ছিল, কী বলেছে আপনাকে। আমি শুধু এইটুকু দেখতে পাচ্ছি আপনার নামে লোন আছে আর সেটার একটা কিস্তিও আপনি দেননি।

ভদ্রলোক কী বলবেন ভেবে কূল পাচ্ছেন না। ম্যানেজার আবার নিজে থেকেই বললেন- “দেখুন বাড়ি যান ভালো করে ভাবুন, ভাবলে হয়ত মনে পড়বে। তারপর আসুন না কাল আমি ছাড়ছুড় করে কমে সেটেলমেন্ট করে দেব।”

ভদ্রলোক আর কিছু বললেন না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। আমার মনে কেমন একটা অস্থির ভাব লেগেই থাকল সারাদিন। তিন চার বছর আগে নেওয়া লোন ভদ্রলোকের মনে নেই এটা কি হতে পারে? আবার ভদ্রলোককে দেখে, ওনার সাথে কথা বলেও মনে হচ্ছে না যে উনি মিথ্যে কথা বলছেন। মনে হল একটু গোয়েন্দাগিরি করি। সেই কোন ছোটবেলায় ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী, শার্লক পড়ে আমার মনে হয়েছিল আমিও যদি গোয়েন্দা হই তবে মন্দ হয় না। কিন্তু কালের বিলম্বে সেসব শীতের ঝরা পাতার মত কখন যে কোথায় উবে গেছে তার কোন হদিশ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আমিও যে খুব একটা চেষ্টা করেছি তাও নয়। তাও কৈশোর পার করে যখন যৌবনে ঢুকলাম, যখন থেকে শব্দেরা আমার কিবোর্ড থেকে স্ক্রিনে খুব অবলীলায় ঝরে যেত সেই সময় থেকেই ভাবতাম গোয়েন্দা তো হতে পারলাম না যদি একখানা গোয়েন্দা কাহিনী নামিয়ে দিতে পারি তবে এ জীবনে কিঞ্চিৎ হা-হুতাশের থেকে মুক্তি পাব। এখনও অবধি সে গুড়ে বালি। কিন্তু এরকম একটা রহস্যের কেস আমার সামনে এসে পড়েছে আর আমি কিছু করব না তা কখনও হয় নাকি! আমি আবার আমার মস্তিষ্কের ব্যায়াম শুরু করলাম। জটগুলো যেন এক একটা করে খুলতে লাগল। অনেকগুলো সম্ভাবনাময় রাস্তার হদিশ পাওয়া গেল। নারানদা-কে ডাকলাম। কালিপদ মিদ্যার লোনের ফর্মটা নিলাম। আমার ব্রাঞ্চে কালিপদ মিদ্যার কোন সেভিংস অ্যাকাউন্ট নেই। কাজেই যাচাই করা যাবে না। নিকটতম অন্য ব্যাঙ্কের যে শাখা আছে সেখানকার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সৌমেনদা আমার পরিচিত। বাড়ি ফেরার দিন প্রায়ই দেখা হয়ে ওর সাথে। সেই সূত্রেই পরিচয়। সৌমেনদাকে ফোন করে সবটা বললাম। সৌমেনদা জানাল ওদের ব্রাঞ্চে কালিপদ মিদ্যার নামে কারোর কোন লোন নেই তবে একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু তাতে খুবই কম টাকা পড়ে আছে এবং কাল সন্ধ্যেতেই এটিএমের মাধ্যমে একটা বড় অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকা তোলার খবরটা পেয়ে ভদ্রলোকের ওপর সন্দেহটা এবার একটু ঘনীভূত হল। কাল বিকেলেই আমরা ওনার বাড়ি গিয়েছিলাম আর কাল সন্ধ্যেতেই উনি একটা বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিলেন। কেন? কালিপদ মিদ্যাকে ফোন করলাম। একটু গম্ভীর স্বরে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোন ব্যাঙ্কে ওনার অ্যাকাউন্ট আছে। উনি নির্দ্বিধায় আমাদের নিকটবর্তী অন্য ব্যাঙ্কের শাখার কথাই জানালেন। আমি এবারে জিজ্ঞেস করলাম “গতকাল সন্ধ্যেতে কি আপনি এটিএম থেকে টাকা তুলেছেন”? ভদ্রলোক বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ, কাল তুলেছিলাম। ঐ বিল্ডার্সের দোকানে দেওয়ার ছিল। আগামী সপ্তাহ থেকে বাড়িতে কাজ শুরু হবে তো তাই। ধান ওঠার আগেই কাজটা শেষ করতে চাই। তাই একটু তাড়াহুড়ো করছি।” আমি শুধু ঠিক আছে বলে রেখে দিলাম। ভদ্রলোকের ওপর থেকে সন্দেহটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। সব প্রশ্নেরই উনি সঠিক উত্তর দিয়েছেন এবং কোন ইতস্তত বোধও ওনার সাথে কথা বলে মনে হয়নি। উনি যে সত্যি বলছেন একথা আমি হলফ করে বলতে পারি। সৌমেনদাকে টিফিন টাইমে আবার ফোন করলাম। এটা বললাম ভদ্রলোক সব সত্যি কথাই বললেন। সৌমেনদা বলল “হ্যাঁ রে আমি ওনাকে চিনতে পেরেছি। তুই বলার পর ছবিটা দেখলাম। দেখেই চিনতে পারলাম। মাঝে মাঝেই উনি ব্যাঙ্কে আসেন। আরও মনে আছে কারণ একবার ওনার সই মিলছিল না। আমি নিজে ওনাকে ডেকে মেশিন থেকে সইটা দেখিয়ে ঠিক করে লিখতে বলেছিলাম।” সৌমেনদার কথা শুনে আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। ওকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ভদ্রলোক কি সই করে টাকা তোলেন? টিপ দিয়ে নয়?”

সৌমেনদা বলল- “আরে না না উনি তো সই করে তোলেন। তুই চাইলে আমি ওনার সইটাও তোকে দেখাতে পারি।”

আমি বললাম- “না না সৌমেনদা সেটার এখন কোন দরকার পড়বে না। যদি পড়ে তোমায় আমি জানাব। এইটুকু ইনফরমেশন দিয়েই বোধহয় উদ্ধার হয়ে যাবে। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ!”

ফোনটা রেখেই ম্যানেজারের কাছে গেলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম “ওই ভদ্রলোক লোন নেয়নি। আপনি ডকুমেন্টটা বের করুন।” ম্যানেজার ডকুমেন্ট বের করার পর ওনাকে দেখালাম যে ওটায় টিপ ছাপ দেওয়া আছে। আর এটাও বললাম ভদ্রলোক লেখাপড়া জানেন, উনি সই করতে পারেন। ম্যানেজার কিছুই বুঝতে না পেরে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। আমি আর সময় নষ্ট না করে কালিপদ বাবুকে ফোন করে এখুনি ব্যাঙ্কে আসতে বলে দিলাম। ওনার আসতে আসতে আমি ক্যাশের কাজ সবটা গুছিয়ে নিলাম। উনি আসতেই ওনাকে চেয়ারে বসিয়ে শার্লকিয় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম “আপনার গ্রামে আর কি কোন কালিপদ মিদ্যা আছে?” উনি কিছু বুঝতে না পেরে এদিক ওদিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “আমার গ্রামে? না তো। আর তো কেউ নেই।” আমি ওনার চেয়ারের হাতল ধরে ওনার দিকে ঝুঁকে আবার বললাম “ভালো করে ভাবুন, ভেবে বলুন।” উনি একটু ভেবে যেন একটু তল খুঁজে পেয়ে বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ। তবে ঠিক আমার গ্রামে নয় তবে ওনার মৌজা আর আমার মৌজা একই। কিন্তু ওনার নাম কালিপদ মিদ্যা নয়। ওনার নাম কালি মিদ্যা”। আমি জিজ্ঞেস করলাম-

— বাবার নাম কি?

— বাবার নাম তো জানি না।

— মনে নেই?

— না না আমি জানিই না।

— কাউকে ফোন করুন যে সঠিক বলতে পারবে।

— কাকে ফোন করব বলুন? আমি তো কাউকে চিনি না।

ঠিক এই সময়ই নারানদা কৃষ্ণের মত হাতের তর্জনিতে চক্রের যায়গায় সাইকেলের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে মোক্ষম চালটা দিয়ে দিল। “রাউতদের কাউকে ফোন কর। ওর বাপ বলে দিতে পারবে। ওরা ঠিক চেনে”— নারানদা বলল।

ভদ্রলোক ফোন করলেন। কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করলেন। বোঝা গেল কেউ বোধহয় ফোন ধরে কাউকে ডাকতে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ওপর প্রান্তের কেউ কথা বললেন। ভদ্রলোক শুধু শুনলেন। তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে হতভম্বের মত মুখ করে বললেন “ওর-ও বাবার নাম তারাপদ মিদ্যা।” আমি একদম নায়কীয় কায়দায় ভদ্রলোককে চেয়ার থেকে উঠিয়ে ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লাম মিশন কালিপদ মিদ্যা উদ্ধারে।

রাস্তায় যেতে যেতে ম্যানেজার আমার কানে কানে বলল “ভাই তুমি পুরো ব্যাপারাটা হ্যান্ডেল কর। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না এখনও।” আমি ওনাকে প্রভু যীশুর মত হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করলাম। যে বাড়িটায় উপস্থিত হলাম তার হাল খুবই খারাপ। মাটির বাড়ি। বাড়ির চারপাশ দেখেই দৈন্যতার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। কাশতে কাশতে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। তুলসি তলার কাছে ওনার স্ত্রী দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে লাগলেন। বৃদ্ধ আমাদের কাছে আসতেই আমি নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

— কি নাম আপনার?

— আজ্ঞে কালি মিদ্যা।

— কালি না কালিপদ মিদ্যা?

— আমার নাম বাপু কালি মিদ্যাই। ভোটের কার্ডে ওরা কী সব করে কালিপদ করে দিয়েছে।

— আপনি ঠিক করেন নি?

— গৌড়াটা তো বলেছিল ঠিক করে দেবে কিন্তু সেকি আর করেছে!

— আপনি কি লোন নিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক থেকে?

— না না বাপু আমি কোন লোন নিই নি এখন।

— এখন না আগে নিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকার লোন?

— ওই ম্যানেজার জোর করে দিয়ে দিয়েছিল। দু’হাজার টাকা। আবার বাড়ি থেকে এসে নিয়েও গেছে।

— তা লোন নিয়েছিলেন যখন শোধ কেন দেননি?

— ওমা শোধ দেব কেন?

— সেকি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে এলেন শোধ দেবেন না?

— সেতো মুকুব হয়ে গেছে। শোধ কেন দেব?

— কে বলল আপনাকে মুকুব হয়ে গেছে?

— কেন টিভিতে তো দেখিয়েছে। ভোটের আগেই তো ওরা বলেছিল লাখ লাখ টাকা দেবে লোন মুকুব করে দেবে।

— আপনাকে বলেছে কেউ?

— কেন প্রধানমন্ত্রীই তো সবাইকে বলেছে। আপনি শোনেন নি?

এরপর আমি কি বলব বুঝতে না পেরে ম্যানেজারকে কথা বলতে বলে পিছনে সরে এলাম। আচ্ছে দিনের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা এই বৃদ্ধ ভেবেছে সত্যিই হয়ত আচ্ছে দিন এসেছে। এসে তাঁর লোন মুকুব করে দিয়েছে। এদিকে আদতে আচ্ছে দিন এসে জমায় সুদের হার কমিয়ে লোনে সুদের বাড়িয়ে ওনার পঞ্চাশ হাজার টাকাকে এই কয় বছরে যে পঁয়ষট্টি হাজারে নিয়ে গেছে সে খবর এখনও কোন টিভিতে দেখায়নি। প্রধানমন্ত্রীও বলেন নি। এই লোন কীভাবে আদায় হবে আমার তা জানা নেই। আদৌ আদায় হবে কী না তাও জানি না। শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছি অকস্মাৎ আমরা এসে ভদ্রলোকের আচ্ছে দিনের স্বপ্ন ভাঙিয়ে দিয়েছি।

 

(ক্রমশ)

আদিত্য ঢালী
লেখক | + posts

আদিত্য চলচ্চিত্র-বিদ্যার ছাত্র। নেশায় পাহাড়। মানুষকে দেখা, বোঝা ও আঁকার স্ব-ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর এই কলামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *