লাস্ট মেদিনীপুর লোকাল। শেষ পর্ব। লিখছেন আদিত্য ঢালী

কথায় বলে একবার ছেড়ে গেলে আর ফিরে আসে না কেউ। সত্যি নাকি? জানি না। আমার এখনও ছেড়ে যাওয়ার সু্যোগ কখনও আসেনি। স্কুল ছেড়েছি, কলেজ ছেড়েছি, ইউনিভার্সিটি ছেড়েছি, শহর ছেড়েছি। কিন্তু দুঃখরা কখনও খুব বেশি আঁকড়ে ধরে থাকেনি। স্কুল ছেড়েছি যখন তখন আঠেরোও পূর্ণ হয়নি। স্কুল ছিল একদম বাড়ির কাছে। সাইকেল চালিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে যেতাম স্কুলে। বন্ধু বান্ধব যারা ছিল সকলেই ছিল স্থানীয়। তাই স্কুল ছাড়ার পর কাউকেই ছেড়ে যেতে হয়নি। আমরা সকলেই একে অপরকে আঁকরে ধরে বাঁচতাম। মনে পরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে একবন্ধু বাইরে চলে যাচ্ছিল। আমরা দুইজন মিলে তাঁকে স্টেশনে ছাড়তে গিয়েছিলাম। ট্রেন চলে যাওয়ার পরে কিছুটা আবেগের বশবর্তী হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু একেবারে ভেঙে পরিনি। কারণ ছেড়ে যাওয়ার অনুভূতি ততদিনে কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছি। কয়েক মাস পরেই হঠাৎ সেই বন্ধু ফোন করে জানাল সে কলেজ বদলাবে কয়েকদিনের মধ্যে শহরে ফিরবে। আমরা সদলবলে চললাম তার ব্যাগপত্তর সমেত তাকে ফিরিয়ে আনতে। দুটো ট্রেন বদলিয়ে যখন সেখানে পৌছালাম ততক্ষণে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এদিকে খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড। পকেট তখন গড়ের মাঠ। কলেজ যাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে যেটুকু পকেটে থাকে সেইটুকুই সম্বল আমাদের প্রত্যেকের। বাবামায়েরা হাতখরচ বলতে বুঝত শুধু পুজোর সময়ে। বাকি সারা বছরে কলেজ যাওয়ার টাকা বাবদ আর কিছুই হাতে থাকত না। সেই টাকা জমিয়েই কত ম্যাটিনি শো-এ সিনেমা দেখেছি। বিনা টিকিটে লোকালে চেপে গড়ের মাঠে ঘুরে এসেছি। খিদে পেলে মুড়ি মাখায় পেট ভরিয়েছি। কিন্তু কোনদিনও এসবের জন্য হাহুতাশ ছিল না। আমরা যারা শহরতলীতে বেড়ে উঠেছি আমাদের যাদের কাছে কলকাতায় যাওয়াটা ছিল এক থ্রিল, তাদের যৌবনে প্রেম ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কিছুর জন্য কখনও হাহুতাশ করতে হয়নি। তখন বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন ফিরে দেখলে মনে হয় ধীরে ধীরে আমাদের আড্ডার গণ্ডি ছোটো হচ্ছিল, আমাদের জীবনে থ্রিল কমে আসছিল। কিন্তু আমরা প্রাণপণ ছুটছিলাম। কেউ কেউ কলেজ পাশ করে চাকরির জন্য ছুটছিল, কেউ কেউ আবার উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটছিল শুধু আমি ছিলাম যে সব কিছু ছেড়ে পালাবার জন্য ছুটছিলাম। কিন্তু চাইলেই কি পালানো যায়? পৃথিবী গোল। ঘুরে ফিরে আবার সেখানেই ফিরে আসতে হয়। আমাকেও আসতে হয়েছিল। কোন এক দুপুরে দূরপাল্লার ট্রেন আমায় আবার হাওড়া ষ্টেশনে নামিয়ে দিয়েছিল। আমি মিনি বাসে উঠে যখন বাড়ি ফিরেছিলাম তখন বিকেল হয়ে গেছে। আমাদের খেলার মাঠগুলোতে এখন হাইরাইজ বিল্ডিং হয়ে গেছে। চাইলেও মাঠের ওপারের কিছু দেখা যায় না।

মেদিনীপুর লোকালে চেপে শহর, নিজের বাড়ি, বন্ধুবান্ধব, প্রেম সবকিছু ছেড়ে আসার একটা দুঃখ ছিল। সময়ের সাথে সাথে সেই দুঃখে প্রলেপ পড়েছে। কখন যেন এই ধীরগতির লোকাল ট্রেন জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে গেছে। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরা ও সপ্তাহ শুরুতে ফিরে যাওয়ার আমার একমাত্র উপায় এই মেদিনীপুর লোকাল। হকারদের কুচকাওয়াজ, নিত্যযাত্রীদের ভিড় ঠেলে আধো ঘুমে আধো জেগে কখন যেন পৌছে যাই গন্তব্যে। সময়ের কাটা যেন ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলে। এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলেছিলেন স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির পর আমরা আর বন্ধু বানাই না। হয়ত ঠিকই বলেছিলেন। মেদিনীপুর লোকালে আমার কোনো বন্ধু নেই। বন্ধুদের মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেক। ফিরে যেতে হয় নিজের গৃহে। ফোন ঘুরিয়ে বলতে হয় “কী রে কী করছিস? বেরোবি?”। ব্যস্ততার নিরিখে সময়কে পরিমাপ করে ঠিক করতে সঠিক সময়ের অনুপাত। নইলে রোজকার এই সমাজে আমরা ধীরে ধীরে একা হয়ে যাব। সেই একাকীত্ব তখন কোনো মাল্টিপ্লেক্সে পপকর্ন চিবিয়েও কাটে না। মেদিনীপুর লোকাল আমার জীবনে নিঃসঙ্গতার প্রতীক। মেদিনীপুর লোকাল আমার জীবনে একা বেড়ে ওঠার সামঞ্জস্য। এইসব টালবাহানা ফেলে যখন বাস্তবে ফিরে আসি তখন ফেলে আসা সময়ের হিসেব কষতে বসে মনে পরে কত কী ফেলে এলাম আর কী কী কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। এ জীবনে সঞ্চয়ের পরিমাণ কম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার প্রবণতা বেশি।

আকাশে মেঘ করে এলে পাখিরা যেমন বাসায় ফিরে আসে তেমনি সময় ফুরিয়ে এলেও আমরা মানুষরা বুঝতে পারি। ফুল কুড়িয়ে ফিরে যাওয়ার সময় এলে কে আর গান না গেয়ে থাকে। আমার অবস্থাও তাই হয়েছে। সেই কতদিন ধরে ফিরে যেতে চেয়েছি। চেয়ে চেয়ে চাতক পাখির মতো বসে থেকেছি। এক ঘটি জল দিয়ে কেউ তৃষ্ণা মেটায়নি। বয়স বেড়েছে। যন্ত্রণা বেড়েছে। উপশম পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবারে বুঝতে পারছি ফেরার সময় হয়েছে। বুড়ো মেদিনীপুর লোকালকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে। তবে এর মানে এই ভেবে বসবেন না যেন শহরে নিজের আস্তানায় ফিরে যাচ্ছি। আমরা যারা নিজের ইচ্ছে, স্বপ্নের সাথে আপোস করেছি, আমরা যারা ভালো থাকার কথা না ভেবে ভালো রাখার কথা ভেবে এসেছি, আমাদের যাদের সাফল্য মাস গেলে উপার্জিত আয়ের উপর নির্ভর করে, আমরা যারা পছন্দের কবিতাদের কাছে দুদণ্ড বসে জিরিয়ে নিইনি, তাদের ফেরার রাস্তা বড়ই কঠিন, অমসৃণ। দীর্ঘ সময় লাগে ফিরতে। কুড়ি পর্বের মেদিনীপুর লোকাল জীবনের স্যাটায়ারের থেকেও আদতে হাহুতাশের দিনলিপি। এই ডিজিটালের যুগে যা মেটা ডেটা হয়ে থেকে যাচ্ছে আগামীর জন্য। যদি কখনও যা হারিয়েছি তার তালিকা করতে বসি তাহলে মেদিনীপুর লোকালের পাতা হবে আমার সার্ভের পেজ। যেখান থেকে অ্যানালাইসিস করে তুলে আনতে হবে আবেগের রামধনু।
উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার পর মোটামুটি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবাই তখন বইতে মুখ গুঁজে থেকেছে। ভালো নম্বর পাওয়ার কৌশল রপ্ত করেছে। ক্যালকুলাসের পাতা থেকে থার্মোডায়ানমিক্সের পাতায় লাফ দিয়েছে জয়েন্টের র‍্যাঙ্কের কথা ভেবে। তাই স্কুলের শেষে ফেয়ারওয়েল হয়নি। হওয়ার কথাও ছিলনা। আমরা বন্ধুরা শুধু রেজাল্ট বেরোনোর পরে স্প্রাইটকে শ্যাম্পেন মনে করে ছিটিয়ে ছিলাম এর ওর গায়ে। কলেজ সবার আলাদা। যাতায়তের পথঘাটও অনেক আলাদা। তবু দেখা হত। সুতোর মতো লেগে ছিলাম আমরা একে অপরের সাথে। উৎসব অনুষ্ঠান সকলে একত্রে কাটিয়েছি। শহরতলির এই একটা গুণ। ছোট যায়গায় সকলে মিলে মিশে দেখা করে থাকা যায়। খুব বেশিদিন দেখা না হয়ে উপায় নেই। পথেঘাটে, মাঠে ময়দানে, ষ্টেশন চত্বরে বা লোকাল ট্রেনের কামরায় আমাদের দেখা হয়ে যেত ঠিকই। কলেজে আমার সেরম বন্ধু হয়নি। তবুও ফেয়ারওয়েলের দিন আমরা সকলে একত্র হয়েছিলাম। এর ওর সাদা জামায় লিখে দিচ্ছিলাম কতটা মিস করব আমরা একে অপরকে, কী কী মেমরি আমাদের আছে, কাকে কী বলে এখনও খেপাই ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শেষ করে বন্ধুর মেসে চলেছিল বহুক্ষণের নির্ভেজাল আড্ডা। সেইসব আড্ডা পার করে যখন বাড়ি ফিরেছিলাম তখন রাত হয়েছে, আমার চোখ লাল হয়েছে। ততদিনে বাড়ির লোকেরা বুঝে গিয়েছিল মফঃস্বলি আবহাওয়ায় মাঝে মাঝে চোখ লাল করে চুপচাপ ঘরে ফিরে আসাটা একপ্রকার আমরা অধিকার বলে মেনে নিয়েছি। ইউনিভারসিটির ফেয়ারওয়েলেও, সে কলেজ স্ট্রীট হোক বা যাদবপুর, আমাদের মজার কোনো শেষ ছিল না। উন্মুক্ত পাখির মতো আমরা একে অপরের সাথে আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। সময় এমন ছিল যে আমাদের ফেরার কোনো তাড়া ছিল না। শুধু যে সময়টা আমরা সকলে একত্রে পার করে এসেছি আজ যেন তার মূর্ছা যাওয়ার পালা, তাই শেষবার সবাই বুক ভরে সুবাস টেনে নিচ্ছি। ততদিনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম ফেরার পথ প্রশস্ত হয়, তাই একবার ফিরে এলে আর ফেরা যায় না। সময়ের কাছে আমরা সব কিছুকে মুক্ত করে ফিরে আসি।
মেদিনীপুর লোকালে চেপে এবারে আমায় ফিরতে হবে। হয়ত চিরতরে। এই গ্রাম, গ্রামের মানুষ, আমার সহকর্মী সবাইকে ছেড়ে হয়ত চলে আসতে হবে। এদিকে পানে আর হয়ত ফেরাও হবে না। যাদের সাথে সপ্তাহে নিয়ম করে দেখা হয় রোজ, খোশ গল্পে মেতে উঠি যাদের সাথে মাঝে মাঝেই আর কিছু সময় পরে তাদের সাথে আর দেখা হবে না। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ হয়ে থেকে যাব আমরা সবাই সবার মেমোরিতে। যোগাযোগ কিছু সময় পরে একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। হয়ত বহু বছর পর কোনো কারণে বা অকারণে ফোন আসবে বা ফোন করব, কথা হবে, পুরাতনের কথা উঠে আসবে, আমাদের ব্রেন ম্যাপ করে নেবে অতীতের সেইসব স্ম্রিতিকে। আমরা নস্টালজিক হব কিছুক্ষণ। কিন্তু তারপর কাজের অজুহাতে আবার সব ভুলে যাব। জীবন এভাবেই বয়ে চলে। এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার সহকর্মী নারানদা, যার কথা বারে বারে উঠে এসেছে মেদিনীপুর লোকালের পাতায়, সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। কবে সুস্থ হয়ে সে ফিরে আসবে আমি জানি না। আমি জানি না আবার তার সাথে আমার দেখা হবে কিনা। তবুও এই যে কয়েক বছরের পরিচয় এতেই আমরা একে অপরকে মনে রাখব। প্রমাণ হিসেবে থেকে যাবে এই মেদিনীপুর লোকালের পাতা। যা আজ প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। এবারে তার বিশ্রাম। কারশেড জুড়ে এবারে সে তার সমস্ত যন্ত্রণা, কষ্ট, দুঃখকে সঙ্গী করে থাকবে। আর সমস্ত কিছু অসহ্য হয়ে গেলে প্রবল যন্ত্রণায় সারারাত ধরে গোঙাবে। আমাকে আবার সকালে উঠতে হবে। এবারে অন্য ষ্টেশন, অন্য লোকাল, অন্য গ্রাম, অন্য মানুষ আবার অন্য জীবন।।

(শেষ)

আদিত্য ঢালী
লেখক | + posts

আদিত্য চলচ্চিত্র-বিদ্যার ছাত্র। নেশায় পাহাড়। মানুষকে দেখা, বোঝা ও আঁকার স্ব-ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর এই কলামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *